অটিজম শিশু বোঝা নয়, পরিবারের সম্ভাবনার চাবিকাঠি

সানজানা রহমান যুথী অটিজম শব্দটি আমাদের সমাজে এখনো অনেকের কাছে এক ধরনের আতঙ্কের নাম। কোনো শিশুর অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার আছে জানতে পারলে অনেকেই অজ্ঞতা ও ভুল ধারণার কারণে সেই পিতামাতাকে এড়িয়ে চলেন, এমনকি অটিজম শিশুকে অন্য স্বাভাবিক শিশুদের থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেন। অথচ বাস্তবে, অনেক মানুষ এখনো জানেন না-অটিজম আসলে কী, কেন হয়, বা কীভাবে একজন অটিজম শিশুকে বোঝা ও সহায়তা করা উচিত। অটিজম সম্পর্কে এই ভুল ধারণা দূর করতে ও সচেতনতা বাড়াতে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন সাজিদা ফাউন্ডেশনের সাইকো-সোসিয়াল কোঅর্ডিনেটর এবং সাইকোলজিস্ট মোহাম্মদ মোকাদ্দেস আলি। তিনি সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করেছেন অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারের বাস্তব চিত্র, কারণ, লক্ষণ ও করণীয় কী। জাগো নিউজ: অটিজম আসলে কী?মোহাম্মদ মোকাদ্দেস আলি: অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার হলো এমন একটি অবস্থা, যেখানে শিশু মৌখিকভাবে বা ইশারা-ইঙ্গিতের মাধ্যমে স্বাভাবিকভাবে যোগাযোগ করতে পারে না। সামাজিক মিথস্ক্রিয়াতেও তারা পিছিয়ে থাকে। পাশাপাশি তাদের আচরণে দেখা যায় একধরনের পুনরাবৃত্তি-একই কাজ, আগ্রহ বা আচরণ বারবার করতে থাকে, যা আমাদের কাছে অস্বাভাবিক মনে হ

অটিজম শিশু বোঝা নয়, পরিবারের সম্ভাবনার চাবিকাঠি

সানজানা রহমান যুথী

অটিজম শব্দটি আমাদের সমাজে এখনো অনেকের কাছে এক ধরনের আতঙ্কের নাম। কোনো শিশুর অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার আছে জানতে পারলে অনেকেই অজ্ঞতা ও ভুল ধারণার কারণে সেই পিতামাতাকে এড়িয়ে চলেন, এমনকি অটিজম শিশুকে অন্য স্বাভাবিক শিশুদের থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেন। অথচ বাস্তবে, অনেক মানুষ এখনো জানেন না-অটিজম আসলে কী, কেন হয়, বা কীভাবে একজন অটিজম শিশুকে বোঝা ও সহায়তা করা উচিত।

অটিজম সম্পর্কে এই ভুল ধারণা দূর করতে ও সচেতনতা বাড়াতে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন সাজিদা ফাউন্ডেশনের সাইকো-সোসিয়াল কোঅর্ডিনেটর এবং সাইকোলজিস্ট মোহাম্মদ মোকাদ্দেস আলি। তিনি সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করেছেন অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারের বাস্তব চিত্র, কারণ, লক্ষণ ও করণীয় কী।

জাগো নিউজ: অটিজম আসলে কী?
মোহাম্মদ মোকাদ্দেস আলি: অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার হলো এমন একটি অবস্থা, যেখানে শিশু মৌখিকভাবে বা ইশারা-ইঙ্গিতের মাধ্যমে স্বাভাবিকভাবে যোগাযোগ করতে পারে না। সামাজিক মিথস্ক্রিয়াতেও তারা পিছিয়ে থাকে। পাশাপাশি তাদের আচরণে দেখা যায় একধরনের পুনরাবৃত্তি-একই কাজ, আগ্রহ বা আচরণ বারবার করতে থাকে, যা আমাদের কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়। নির্দিষ্ট কোনো জিনিস, বিষয় বা কর্মকাণ্ডের প্রতি তারা অতিরিক্ত আসক্তিও দেখাতে পারে।

জাগো নিউজ: বর্তমানে অটিজমসম্পন্ন শিশুর সংখ্যা কি দিন দিন বাড়ছে?
মোহাম্মদ মোকাদ্দেস আলি: হ্যাঁ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী অটিজমসম্পন্ন শিশুর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের দেশে গড়ে প্রতি ৫৮৯ জন শিশুর মধ্যে একজন অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত।

শহরাঞ্চলে এই হার তুলনামূলকভাবে আরও বেশি-প্রতি ১০ হাজার শিশুর মধ্যে প্রায় ২৫ জনের মধ্যে অটিজমের লক্ষণ পাওয়া যায়। মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের মধ্যে আক্রান্ত হওয়ার হার দ্বিগুণেরও বেশি।

জাগো নিউজ: একজন পিতামাতা কীভাবে বুঝতে পারবে যে তার শিশুর মধ্যে অটিজমের বৈশিষ্ট্য রয়েছে?
মোহাম্মদ মোকাদ্দেস আলি: অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারসম্পন্ন শিশুদের আচরণ ও বিকাশে কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। এগুলোর ভিত্তিতে পিতামাতা প্রাথমিকভাবে ধারণা করতে পারেন যে সন্তানের মধ্যে অটিজমের লক্ষণ থাকতে পারে। যেমন-

১. পিতামাতা শিশু দিকে তাকিয়ে হাসলে সাধারণত শিশুরা হাসে, কিন্তু অটিজমসম্পন্ন শিশু অনেক সময়ই সেই প্রতিক্রিয়া দেখায় না।

২. পরিবারের সদস্যদের শব্দ, অঙ্গভঙ্গি বা চলাফেরা অনুকরণ না করা।

৩. জন্মের ১০ মাসের মধ্যে ‘মা-মা’, ‘বা-বা’ ধরনের বাবলিং না করা।

৪. চোখে চোখ রেখে যোগাযোগ না করে বেশিরভাগ সময় প্রতিক্রিয়া দেখানো

৫. পিতামাতা লুকিয়ে গেলে তাদের খুঁজে না বের করা।

৬. একই আচরণ বারবার করা- গোল হয়ে ঘোরা, আঙুল বা হাত-পা বারবার একইভাবে নড়ানো, বা শরীরের নির্দিষ্ট অংশে অস্বাভাবিক নড়াচড়া করা।

৭. পিতামাতা কোলে নিতে চাইলে আগ্রহ না দেখানো।

৮. নাম ধরে ডাকলে সাড়া না দেওয়া।

৯. বয়স অনুযায়ী হাঁটা-চলা বা অন্যান্য দক্ষতা অর্জনে দেরি হওয়া।

জাগো নিউজ: অটিজম সম্পর্কে আমাদের সমাজে প্রচলিত ভুল ধারণাগুলো কী কী?

মোহাম্মদ মোকাদ্দেস আলি: অটিজম নিয়ে আমাদের সমাজে এখনো অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। সবচেয়ে বড় ভুল ধারণা হলো- অনেকে মনে করেন অটিজম নাকি বাবা-মায়ের পাপের ফল। যখন পিতামাতাকে বলা হয় যে তাদের শিশুর মধ্যে অটিজমের লক্ষণ রয়েছে, তখন তারা ভেঙে পড়েন। বিশেষ করে মায়েরা নিজেদের দোষী ভাবেন। কিন্তু বাস্তবে নির্দিষ্ট শিশু অটিজমের কোনো নির্দিষ্ট কারণকে চিহ্নিত করা যায় না। সাধারণত দুটি কারণকে বিবেচনা করা হয়-জেনেটিক এবং পরিবেশগত। তাই মায়ের কোনো দোষ নেই, এবং এ ধরনের অপরাধবোধ একেবারেই অমূলক।

আরেকটি ভুল ধারণা হলো, অটিজমসম্পন্ন শিশুরা নাকি পরিবারের বোঝা। এটি সম্পূর্ণ ভুল। যথাযথ থেরাপি, শিক্ষা ও যত্ন পেলে তারা স্বাভাবিকভাবেই জীবনযাপন করতে পারে। বরং অনেকেই বিশেষ প্রতিভার অধিকারী হয়। আপনারা জেনে খুশি হবেন-ধর্মীয়, জাতীয় ও ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সরকার যে আমন্ত্রণ কার্ড ব্যবহার করে, তার বেশিরভাগই তৈরি করে অটিজমসম্পন্ন শিশুরা।

প্রত্যেক অটিজমসম্পন্ন শিশুর ভেতরেই থাকে আলাদা এক দক্ষতা-যা সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা পেলে সাধারণ মানুষের চেয়েও অনেক এগিয়ে যেতে পারে। তাই আপনার সন্তানই একদিন পরিবারের সবচেয়ে সক্ষম ও উপার্জনক্ষম সদস্য হয়ে উঠতে পারে।

জাগো নিউজ: একজন অটিজমসম্পন্ন শিশুর চিকিৎসার জন্য কোথায় যেতে হবে?
মোহাম্মদ মোকাদ্দেস আলি: অটিজমসম্পন্ন শিশুর সঠিক ও উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বেশ কিছু নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার শিশু হাসপাতালের শিশু বিকাশ কেন্দ্র সবচেয়ে পরিচিত ও বিশ্বাসযোগ্য একটি জায়গা। একইভাবে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইপনা, দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে স্থাপিত শিশু বিকাশ কেন্দ্র, সেনাবাহিনী পরিচালিত প্রয়াশ এবং সিআরপি অটিজম চিকিৎসা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

অটিজমের আচরণগত ব্যবস্থাপনায় দক্ষ পেশাদারদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য এডুকেশন, স্কুল, ডেভেলপমেন্ট, কাউন্সেলিং ও ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টদের পাশাপাশি অটিজম বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞ এবং স্পেশাল এডুকেটরদের তত্ত্বাবধানে থাকা জরুরি। সঠিক সময়ে সঠিক বিশেষজ্ঞের কাছে গেলে অটিজমসম্পন্ন শিশুর অগ্রগতি তুলনামূলক দ্রুত হয়।

জাগো নিউজ: অটিজমের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেলে পিতামাতার করণীয় কী ?

মোহাম্মদ মোকাদ্দেস আলি: শিশুর মধ্যে অটিজমের বৈশিষ্ট্য দেখা দিলে পিতামাতার প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে বিষয়টি প্রফেশনালদের মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া। কারণ সঠিক মূল্যায়ন না হলে পরবর্তী করণীয়গুলো যথাযথভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব হয় না। অটিজিজম নিশ্চিত হওয়ার পর প্রয়োজনীয় থেরাপি গ্রহণ, শিশুর জন্য উপযোগী বিশেষ পদক্ষেপ তৈরি, এবং একটি সুনির্দিষ্ট ওয়ার্ক প্লান অনুসরণ করে নিয়মিত কাজ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

শিশুর জন্মের প্রথম পাঁচ থেকে ছয় বছরের মধ্যেই যদি প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া যায়, তাহলে উন্নতির গতি অনেক বেশি হয়। তাই দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়াই সবচেয়ে জরুরি।

অটিজমসম্পন্ন শিশু কখনোই পরিবারের বোঝা নয় বরং সঠিক পরিচর্যা ও অনুপ্রেরণা পেলে তারা পরিবার ও সমাজের সম্পদ হয়ে উঠতে পারে। অনেক ক্ষেত্রেই বিশেষ দক্ষতা ও আগ্রহের কারণে তারা ভবিষ্যতে পরিবারের উপার্জনক্ষম সদস্য হিসেবেও ভূমিকা রাখতে পারে।

আরও পড়ুন:
কোলবালিশ প্রেমীদের জন্য সুখবর, জানুন গবেষণায় পাওয়া তথ্য
এইচআইভি পজিটিভ হলেই জীবন এখন আর থেমে যায় না

এসএকেওয়াই/জেআইএম

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow