চিকুনগুনিয়াকে দীর্ঘমেয়াদি জনস্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন গবেষকরা

চিকুনগুনিয়া এখন কেবল জ্বরের রোগ নয়, দীর্ঘমেয়াদি জনস্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ। চট্টগ্রামের এক হাজার একশ রোগীর ওপর ভিত্তি করে চিকুনগুনিয়ার ওপর গবেষণা চালিয়েছেন গবেষকরা। তাদের দাবি, এটি চিকুনগুনিয়ার ওপর দেশের বৃহত্তম গবেষণা। এতে উঠে এসেছে, বাংলাদেশে বিশেষ করে চট্টগ্রামে চিকুনগুনিয়া এখন একটি দ্রুত বিস্তারমান মশাবাহিত ভাইরাসজনিত রোগ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।  গবেষণার ফল অনুযায়ী, এই রোগ কেবল স্বল্পমেয়াদি জ্বরেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং দীর্ঘস্থায়ী অস্থিসন্ধির ব্যথা, কর্মক্ষমতা হ্রাস এবং উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছে। গবেষণায় আরও দেখা যায়, ডেঙ্গু (১০ শতাংশ) ও জিকার (১ দশমিক ১ শতাংশ) সঙ্গে চিকুনগুনিয়ার একসঙ্গে সংক্রমণ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া সংক্রমণ পরিস্থিতি বোঝা ও ভবিষ্যৎ জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবিলায় যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণের লক্ষ্যে এসপেরিয়া হেলথ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন চলতি বছরের জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বিস্তৃত পরিসরে এই গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, অধিকাংশ রোগীর ক্ষেত্রে তীব

চিকুনগুনিয়াকে দীর্ঘমেয়াদি জনস্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন গবেষকরা

চিকুনগুনিয়া এখন কেবল জ্বরের রোগ নয়, দীর্ঘমেয়াদি জনস্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ। চট্টগ্রামের এক হাজার একশ রোগীর ওপর ভিত্তি করে চিকুনগুনিয়ার ওপর গবেষণা চালিয়েছেন গবেষকরা। তাদের দাবি, এটি চিকুনগুনিয়ার ওপর দেশের বৃহত্তম গবেষণা। এতে উঠে এসেছে, বাংলাদেশে বিশেষ করে চট্টগ্রামে চিকুনগুনিয়া এখন একটি দ্রুত বিস্তারমান মশাবাহিত ভাইরাসজনিত রোগ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। 

গবেষণার ফল অনুযায়ী, এই রোগ কেবল স্বল্পমেয়াদি জ্বরেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং দীর্ঘস্থায়ী অস্থিসন্ধির ব্যথা, কর্মক্ষমতা হ্রাস এবং উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছে। গবেষণায় আরও দেখা যায়, ডেঙ্গু (১০ শতাংশ) ও জিকার (১ দশমিক ১ শতাংশ) সঙ্গে চিকুনগুনিয়ার একসঙ্গে সংক্রমণ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।

চট্টগ্রাম অঞ্চলে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া সংক্রমণ পরিস্থিতি বোঝা ও ভবিষ্যৎ জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবিলায় যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণের লক্ষ্যে এসপেরিয়া হেলথ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন চলতি বছরের জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বিস্তৃত পরিসরে এই গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, অধিকাংশ রোগীর ক্ষেত্রে তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী অস্থিসন্ধির ব্যথা তিন মাসের অধিক স্থায়ী হয় (৬০ শতাংশ)। ভুল রোগ নির্ণয় এবং পর্যাপ্ত রিপোর্ট না হওয়ার কারণে প্রকৃত রোগের বোঝা অনেকাংশেই অজানা থেকে যাচ্ছে (৩০ শতাংশ)। পাশাপাশি জনসচেতনতার অভাব এবং চিকিৎসা ব্যয়ের চাপ (গড়ে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা) রোগ ব্যবস্থাপনাকে আরও কঠিন করে তুলছে।

গবেষকরা মনে করছেন, চিকুনগুনিয়া এখন আর কেবল একটি সাময়িক জ্বরের রোগ নয়, এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি জনস্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ। শুধু ডেঙ্গুকেন্দ্রিক নিয়ন্ত্রণ কৌশল দিয়ে এই রোগ মোকাবিলা যথেষ্ট নয় বলে গবেষণায় মত দেওয়া হয়েছে।

চিকুনগুনিয়ার হটস্পট নগরীর ৭ থানা ও ৩ উপজেলা : গবেষকরা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের এলাকার মধ্যে কোতোয়ালি, বাকলিয়া, ডবলমুরিং, আগ্রাবাদ, চকবাজার, হালিশহর, পাঁচলাইশ এলাকায় সংক্রমনের মাত্রা সবচেয়ে বেশি পেয়েছেন। আর উপজেলা এলাকায় সীতাকুণ্ড, বোয়ালখালী, আনোয়ারাতে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ পেয়েছেন।

গবেষণায় দেখা গেছে, গোড়ালি (৮৫ শতাংশ), হাঁটু (৮২ শতাংশ), কবজি (৮০ শতাংশ) ও হাতের অস্থিসন্ধি (৬৫ শতাংশ) সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়। বহু রোগীর ক্ষেত্রে সকালে অস্থিসন্ধি শক্ত হয়ে যাওয়া (৬০ শতাংশ) ও ফোলা ভাবের (৪৫ শতাংশ) লক্ষণ পাওয়া গেছে।

গবেষণায় জিনগত বিশ্লেষণের মাধ্যমে ভাইরাসের জিনগত বৈচিত্র্য শনাক্ত করা হয়েছে, যেখানে দেখা যায় এই ভেরিয়েন্ট এর আগে পাকিস্তান, ভারত, থাইল্যান্ডে দেখা গেছে। আর চট্টগ্রামের ভাইরাসের প্রকরণে অর্ধশতাধিক জিনগত পরিবর্তন বা মিউটেশন আছে।

ডেঙ্গু আক্রান্তদের অর্ধেকই তরুণ : চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের অর্ধেকই ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী তরুণ জনগোষ্ঠী, যা শতকরার হিসাবে ৪৮ দশমিক ৪। শিশু-কিশোর যাদের বয়স ১৮ এর নিচে তাদের আক্রান্ত হওয়ার হার ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ। আর মধ্যবয়সী প্রাপ্তবয়স্কদের আক্রান্ত হওয়ার হার ২২ শতাংশ।

চট্টগ্রামের ১ হাজার ৭৯৭ জন ডেঙ্গু রোগীর ক্লিনিক্যাল ও বায়োলজিক্যাল ডেটা গবেষণায় এই চিত্র উঠে এসেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ডেঙ্গুতে নারীর চেয়ে পুরুষরাই বেশি আক্রান্ত হয়েছেন। 

পুরুষদের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার হার প্রায় ৬০ শতাংশ। আর গ্রামের তুলনায় শহরাঞ্চলের মানুষজনই বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। শহরাঞ্চলের মানুষের আক্রান্তের হার ৬২ শতাংশ।

গবেষণায় দেখা যায়, ডেঙ্গু রোগীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিদ্যমান ছিল উচ্চ রক্তচাপ (৫ দশমিক ৫ শতাংশ) ও ডায়াবেটিস (৪ দশমিক ৫ শতাংশ)। এ ছাড়া মূত্রনালির সংক্রমণসহ অন্যান্য সহ-সংক্রমণও একটি অংশে পাওয়া গেছে (৩ শতাংশের মতো)। ডেঙ্গুজনিত জটিলতার মধ্যে কাশি (৩১ শতাংশ) এবং রক্তক্ষরণ (২৩ দশমিক ৯ শতাংশ ) সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে। কিছু রোগীর শরীরে তরল জমে যাওয়ার লক্ষণও পাওয়া গেছে (পেটে পানি জমা ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ; ফুসফুসে পানি জমা ১৪ দশমিক ২ শতাংশ)। রক্ত পরীক্ষার ফলাফলে অধিকাংশ রোগীর শরীরে তীব্র সংক্রমণের সূচক শনাক্ত হয়েছে (৭২ দশমিক ৭ শতাংশ), যা সাম্প্রতিক সংক্রমণের ইঙ্গিত দেয়। ডেঙ্গুতে জ্বর ও পরিপাকতন্ত্রজনিত উপসর্গ ছিল প্রধান লক্ষণ এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগটি তুলনামূলকভাবে নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে ছিল, যেখানে গুরুতর জটিলতা কম দেখা গেছে।

গবেষণায় দেখা যায়, আক্রান্ত রোগীদের একটি বড় অংশ সতর্কতামূলক লক্ষণসহ ডেঙ্গুতে ভুগছিলেন, যার হার প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি (৪৪ দশমিক ৮ শতাংশ)।

ক্লিনিক্যাল উপসর্গ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রায় সব রোগীরই জ্বর ছিল (প্রায় ৯৯ শতাংশ)। পাশাপাশি বমিভাব ও বমি (৭১ দশমিক ৪ শতাংশ), মাথাব্যথা (৬২ দশমিক ৫ শতাংশ), মাংসপেশি (৪২ দশমিক ৪ শতাংশ) ও চোখের পেছনে ব্যথা (৩৯ দশমিক ৭ শতাংশ), পেটব্যথা (৩৫ দশমিক ৮ শতাংশ) এবং ডায়রিয়ার (২৩ শতাংশ) মতো উপসর্গ উল্লেখযোগ্য হারে উপস্থিত ছিল।

‘চট্টগ্রামে ডেঙ্গু, জিকা ও চিকুনগুনিয়া সংক্রমণের সার্বিক পরিস্থিতি, জনস্বাস্থ্যে প্রভাব, চিকিৎসা পদ্ধতি এবং ভাইরাসের জিনোমের স্বরূপ উন্মোচন’ শীর্ষক এই গবেষণায় নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক এইচ এম হামিদুল্লাহ মেহেদী, রেলওয়ে হাসপাতালের চিকিৎসক আবুল ফয়সাল মোহাম্মদ নুরুদ্দিন ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. আদনান মান্নান।

গবেষক দলে আরও ছিলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ডা. এম এ সাত্তার, ডা. মারুফুল কাদের, ডা. নুর মোহাম্মদ, ডা. হিরন্ময় দত্ত, ডা. ইশতিয়াক আহমদ, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের ডা. এ এস এম লুৎফুল কবির শিমুল, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের ডা. রজত বিশ্বাস, ইউএসটিসির আইএএইচএসের ডা. আয়েশা আহমেদ, অ্যাপোলো ইম্পেরিয়াল হাসপাতালের ডা. মোহাম্মদ আকরাম হোসেন, নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ডা. অরিন্দম সিং পুলক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিয়ারিং বিভাগের ড. মো. মাহবুব হাসান ও মহব্বত হোসেন, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এএমএএম জুনায়েদ সিদ্দিকি।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow