ছোট-মাঝারি কম্পন বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত, বিপর্যয়ের মুখে পড়বে ঢাকা

শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিট। সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় তখনো অনেকে ছিলেন ঘুমিয়ে, কেউ নাশতা করছিলেন, কেউবা ছিলেন বাজারে। হঠাৎ কম্পন। প্রথমে কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেলেও কয়েক সেকেন্ডেই বোঝা গেল, আঘাত হেনেছে ভূমিকম্প। যার ঝাঁকুনি ছিল অত্যাধিক। দেশের মধ্যে স্মরণকালে এমন কম্পন কেউ অনুভব করেনি। রিখটার স্কেলে এ ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৭, অর্থাৎ মাঝারি। কিন্তু উৎপত্তিস্থল ঢাকার পাশে নরসিংদীর মাধবদীতে হওয়ায় তা পুরো দেশকে নাড়িয়ে দেয়। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে উৎপত্তি হওয়া সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প ছিল এটি। এতে অবকাঠামোগত প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। শিশুসহ নিহত হয়েছে অন্তত ১০ জন। আহত আছে কয়েক শ। বিশেষজ্ঞদের মতে, সম্প্রতি হওয়া ছোট ও মাঝারি ভূমিকম্প সামনে বড় মাত্রার ভূমিকম্পের ইঙ্গিত দিচ্ছে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে তেমন ঝুঁকিতেই রয়েছে বাংলাদেশ। বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ঢাকা শহর। কারণ এ শহরের বেশির ভাগ ভবন বিল্ডিং কোড মেনে নির্মিত হয়নি। এছাড়া এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতি কমাতে তেমন ব্যবস্থা নেয়নি কোনো সরকার। সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, গত বছরের শেষ দিকে এবং চলতি বছরের প্রথমে ও মাঝামাঝি সময়ে দেশে

ছোট-মাঝারি কম্পন বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত, বিপর্যয়ের মুখে পড়বে ঢাকা

শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিট। সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় তখনো অনেকে ছিলেন ঘুমিয়ে, কেউ নাশতা করছিলেন, কেউবা ছিলেন বাজারে। হঠাৎ কম্পন। প্রথমে কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেলেও কয়েক সেকেন্ডেই বোঝা গেল, আঘাত হেনেছে ভূমিকম্প। যার ঝাঁকুনি ছিল অত্যাধিক। দেশের মধ্যে স্মরণকালে এমন কম্পন কেউ অনুভব করেনি।

রিখটার স্কেলে এ ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৭, অর্থাৎ মাঝারি। কিন্তু উৎপত্তিস্থল ঢাকার পাশে নরসিংদীর মাধবদীতে হওয়ায় তা পুরো দেশকে নাড়িয়ে দেয়। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে উৎপত্তি হওয়া সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প ছিল এটি। এতে অবকাঠামোগত প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। শিশুসহ নিহত হয়েছে অন্তত ১০ জন। আহত আছে কয়েক শ।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সম্প্রতি হওয়া ছোট ও মাঝারি ভূমিকম্প সামনে বড় মাত্রার ভূমিকম্পের ইঙ্গিত দিচ্ছে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে তেমন ঝুঁকিতেই রয়েছে বাংলাদেশ। বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ঢাকা শহর। কারণ এ শহরের বেশির ভাগ ভবন বিল্ডিং কোড মেনে নির্মিত হয়নি। এছাড়া এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতি কমাতে তেমন ব্যবস্থা নেয়নি কোনো সরকার।

ছোট-মাঝারি কম্পন বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত, বিপর্যয়ের মুখে পড়বে ঢাকা

সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, গত বছরের শেষ দিকে এবং চলতি বছরের প্রথমে ও মাঝামাঝি সময়ে দেশের আশপাশে বিভিন্ন মাত্রার অর্ধশতাধিক ভূমিকম্প হয়েছে। গত ১৫ বছরে ছোট-বড় ভূমিকম্প হয়েছে দেড় শতাধিক, যা আশঙ্কাজনক।

৯ মাত্রার ভূমিকম্পের শঙ্কা
বিশেষজ্ঞরা জানান, বাংলাদেশে সিলেট থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত পার্বত্য এলাকায় শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেই সঙ্গে ভারতের মণিপুর, মিজোরাম ও মিয়ানমারের পার্বত্য এলাকাও ঝুঁকির মধ্যে আছে।

এছাড়া কিশোরগঞ্জের হাওর দিয়ে মেঘনা নদী হয়ে বঙ্গোপসাগর ও আন্দামানের পাশ দিয়ে দক্ষিণে যদি একটি রেখা কল্পনা করা যায়, এটি হচ্ছে দুটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থল। এ দুটি প্লেটের মধ্যে পূর্বে অবস্থিত মিয়ানমার প্লেট ও পশ্চিমে ভারতীয় প্লেট। এর সংযোগস্থলের ওপরের ভাগটি অর্থাৎ সুনামগঞ্জ থেকে শুরু হয়ে পূর্বে মণিপুর ও মিজোরাম পর্যন্ত অঞ্চলটি লকড হয়ে আছে। দুটি টেকটোনিক প্লেটে গত শত বছরেও বড় কোনো ভূমিকম্প হয়নি। তাই জমেছে দীর্ঘদিনের সঞ্চিত শক্তি। যা যেকোনো মুহূর্তে ৮ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পের মধ্য দিয়ে হাজির হওয়ার আশঙ্কা আছে।

ভারত ও মিয়ানমারের প্লেট এবং বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক অবস্থান বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা বলছেন, যেকোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হানবে। রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প আর এর কেন্দ্র ঢাকার চারপাশের এলাকা হলে রাজধানীর প্রায় দুই লাখ ভবন পুরোপুরি ধসে পড়বে। এমন ঝুঁকি থাকলেও ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় নেই পর্যাপ্ত প্রস্তুতি। গ্যাস-বিদ্যুতের অপরিকল্পিত লাইন ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প হলে মৃত্যুকূপে পরিণত হতে পারে পুরো ঢাকা শহর।

বড় ভূমিকম্প নেই প্রায় ৭৫ বছর
মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের তথ্যমতে, বাংলাদেশ ভূকম্পনের সক্রিয় এলাকায় অবস্থিত। দুর্যোগ সূচক অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ভূমিকম্পের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ২০টি শহরের মধ্যে রয়েছে ঢাকা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ছোটোখাটো কম্পন দেশে আরও শক্তিশালী ভূমিকম্পের আশঙ্কা নির্দেশ করে।

ঐতিহাসিকভাবে ১৮৬৯ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে রিখটার স্কেলে ৭-এর বেশি মাত্রার পাঁচটি ভূমিকম্পে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৮৮৫ সালের ভূমিকম্প এবং ১৯১৮ সালের শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্পের প্রতিটিরই কেন্দ্র ছিল বাংলাদেশের মধ্যে এবং যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছিল। এরপর এ অঞ্চলে বড় ভূমিকম্প প্রায় ৭৫ বছর ধরে ঘটেনি। তাই শিগগির একটি বড় ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি।

ভূমিকম্পের অনুঘটক টেকটোনিক প্লেট
তিন ধরনের পারস্পরিক প্লেট সীমানার কথা জানা যায়। এগুলো হচ্ছে সমকেন্দ্রাভিমুখী সীমা, অপসারী সীমা ও পরিবর্তকচ্যুতি সীমা। সমকেন্দ্রাভিমুখী সীমায় একে অপরের দিকে অগ্রসরমান দুটি প্লেট কেন্দ্রাভিমুখী হয়ে অবশেষে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, তখন একটি প্লেট অপরটির নিচে চাপা পড়ে। এ ধরনের সংঘর্ষের ফলে পর্বতমালার সৃষ্টি হয় এবং প্লেট প্রান্তিকের আশপাশে আগ্নেয়গিরির কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়। অপসারী সীমার ক্ষেত্রে দুটি প্লেট একে অপরের কাছ থেকে সরে যেতে থাকে। এ ধরনের প্লেট সীমানার ফলে নতুন সমুদ্র তলদেশের এবং সামুদ্রিক আগ্নেয়গিরির সৃষ্টি হয়। আর যখন দুটি প্লেট একে অপরকে অতিক্রম করে যায়, তখন তাকে পরিবর্তকচ্যুতি সীমা বলে। তিন ধরনের প্লেট বিচলনেই ভূমিকম্প সংঘটিত হয়।

ছোট-মাঝারি কম্পন বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত, বিপর্যয়ের মুখে পড়বে ঢাকা

বঙ্গীয় অববাহিকার অধিকাংশই পড়েছে বাংলাদেশে। ভারতীয় প্লেট ও এশীয় প্লেটের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে এর উৎপত্তি। ক্রিটেসিয়াস যুগের পূর্বে (সাড়ে ১২ কোটি বছর আগে) বাংলাদেশের অংশবিশেষসহ (বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চল) ভারতীয় প্লেট অ্যান্টার্কটিকা, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকার সঙ্গে যুক্ত থেকে গন্ডোয়ানাল্যান্ড নামে একটি বৃহৎ মহাদেশ গড়ে তোলে। বাংলাদেশের অবশিষ্টাংশের তখন অস্তিত্ব ছিল না। অতঃপর গন্ডোয়ানাল্যান্ডে ফাটলের ফলে ভারতীয় প্লেটের উত্তরমুখী সঞ্চরণ ও সবশেষ এশীয় প্লেটের সঙ্গে এর সংঘর্ষের ফলে হিমালয় পর্বতমালা ও বাংলাদেশের ব-দ্বীপীয় সমভূমির সৃষ্টি হয়।

ভারতীয় প্লেট ও এশীয় প্লেটের মধ্যে পর্যায়ক্রমিক সংঘর্ষ ইয়োসিন যুগে (পাঁচ কোটি থেকে সাড়ে পাঁচ কোটি বছর আগে) হিমালয়ের প্রারম্ভিক উত্থানের সময় প্রথম সংঘটিত হয়। নবীন ইয়োসিন যুগে (সাড়ে তিন কোটি থেকে চার কোটি) ভারতীয় প্লেট ও এশীয় প্লেটের মধ্যবর্তী টেথিস সাগরের সবশেষ চিহ্ন সম্ভবত বিলীন হয়ে যায়। এই সময়েই ভারতীয় প্লেটের অভিসরণ দিক দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সংঘর্ষসহ উত্তর থেকে উত্তর-পূর্বদিকে পরিবর্তিত হয়ে যায়। ওলিগোসিন যুগ থেকে (সাড়ে তিন কোটি বছর আগে) প্লেট সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে এবং বিশাল নদীমালার জলরাশিতে দক্ষিণে আদি বঙ্গীয় অববাহিকা ভরে উঠলে উত্থিত হিমালয়ের অবক্ষেপ নেমে আসতে শুরু করে। মায়োসিন পরবর্তী সময় থেকে (আড়াই কোটি বছর তৎপরবর্তী) অববাহিকায় দ্রুত অবনমনের সঙ্গে হিমালয় পবর্তমালার দ্রুত উত্থানের ফলে বিপুল অবক্ষেপের সুতপের পাশাপাশি বৃহদাকৃতির বদ্বীপ গড়ে ওঠে।

যেকোনো সময় বড় ভূমিকম্প
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রুবাইয়াত কবির জানান, ঢাকা এবং এর আশপাশে বিগত কয়েক দশকে সংঘটিত হওয়া ভূমিকম্পের মধ্যে শুক্রবারই সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সর্বোচ্চ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। এর আগে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে ৪ থেকে ৫ মাত্রার সামান্য বেশি ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। তবে এগুলোর উৎপত্তিস্থল ছিল দেশের বাইরে। ঐতিহাসিকভাবে এ অঞ্চলে একাধিক বড় ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে। যা প্রমাণ করে যে, এটি ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। যেকোনো সময় বাংলাদেশে আরও বড় ভূমিকম্প হতে পারে। তবে ঠিক কবে হবে সেটি তারা বলতে পারেন না।

ভূমিকম্প নিয়ে কয়েক দশক ধরে কাজ করেছেন ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার। তিনি বলেন, দুটি প্লেট, ইন্দো-বার্মা টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে আজকের ভূমিকম্পটি হয়েছে। কম্পনের তীব্রতা ছিল বেশ। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি অনুভূত হয়েছে তা দেশের পটভূমিতে সাম্প্রতিক সময়ে সর্বোচ্চ। শক্তি আটক অবস্থায় ছিল। এর উন্মোচন শুরু হয়েছে। এখন পরবর্তীকালে ফাঁকা দিয়ে আবার ভূমিকম্প হতে পারে।

অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে ঢাকায় ঝুঁকির মাত্রা সবসময় বেশি জানিয়ে হুমায়ুন আখতার বলেন, ঢাকার এত কাছে গত কয়েক দশকে বড় ভূমিকম্প হয়নি। কয়েক প্রজন্ম এরকম ভূমিকম্প দেখেনি।

ভাঙনের শঙ্কায় ঢাকার ৩৫ শতাংশ ভবন
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদি আহমেদ আনসারী বলেন, ভবনগুলো এখনই পরীক্ষা করা দরকার। বিশেষ করে ঢাকার ভবনগুলোর পরীক্ষা তাৎক্ষণিকভাবে দরকার। এখানে সরকারের কোনো অর্থ ব্যয় হবে না, রাজউককে দিয়ে সাধারণ মানুষকে জানান দেবে, সব ভবন পরীক্ষা করে সনদ দিয়ে দেবে যে ভবনগুলো বিল্ডিং কোড অনুযায়ী হয়েছে।

ভূমিকম্পে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ভবনে ফাটল ধরা প্রসঙ্গে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, এমন ক্ষয়ক্ষতি হবেই। ঢাকা শহরে প্রায় ২১ লাখের মতো ভবন রয়েছে। তার মধ্যে ১৫ লাখ একতলা-দোতলা। চার থেকে ছয়তলা ভবন প্রায় ছয় লাখের মতো। ১০ তলা, ২০ তলাও রয়েছে। ঢাকার ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে দু-তিন লাখ মানুষ হতাহত হবে। ঢাকা শহরের ৩৫ শতাংশ ভবন ভেঙে পড়ার শঙ্কা আছে।

ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ ঝুঁকিতে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদের ডিন ও ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. জিল্লুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ একটি ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল, কারণ প্লেট সীমানা। প্লেট সীমানা বরাবর এরকম ভূমিকম্প প্রতিদিনই প্রচুর হয়, যেগুলো ছোট ছোট। তবে মাঝেমধ্যে বড় ভূমিকম্পও হয়। বাংলাদেশে ভূমিকম্পের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব হতে পারে ভয়াবহ। অনেক মানুষ বাস্তুহারা হবে, তাদের জীবিকা ও সামাজিক স্থিতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই এখনই প্রস্তুতি ও সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ না নিলে ভবিষ্যতের ক্ষয়ক্ষতি রোধ করা সম্ভব হবে না।

ছোট-মাঝারি কম্পন বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত, বিপর্যয়ের মুখে পড়বে ঢাকা

তিনি বলেন, বাংলাদেশ ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে প্রধানত এর ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে। ভারতীয় ও ইউরেশিয়ান প্লেটের সংঘর্ষস্থলে অবস্থিত হওয়ায় দেশটি নিয়মিত ভূমিকম্পের হুমকির মুখে রয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ, রংপুর এবং দিনাজপুর অঞ্চলগুলো অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত।

নিজেকে উদ্ধারকারী বানাতে হবে
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন্স অ্যান্ড মেনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সবার আগে ভূমিকম্পে সচেতনতা জরুরি। ঢাকা শহরের বেশির ভাগ ভবন ঝুঁকিপূর্ণ। এজন্য ভবনগুলো ভূমিকম্প নিরোধক কিংবা মজবুত করা প্রয়োজন। তবে সবচেয়ে বেশি জরুরি জনগণের সচেতন হওয়া। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেকে উদ্ধারকারী হিসেবে তৈরি করা।

দেশের ইতিহাসে বড় ভূমিকম্প
দেশে সাম্প্রতিক সময়ে হালকা ও মাঝারি মাত্রার বেশ কয়েকটি ভূমিকম্প হলেও সেগুলোর কোনোটিই মাত্রার দিক দিয়ে শক্তিশালী বা প্রলয়ঙ্করী ছিল না। তবে গত আড়াইশ বছরে সেরকম কয়েকটি ভূমিকম্প ঘটেছে, সেগুলোর উৎপত্তিস্থল দেশের ভেতরে বা আশপাশের এলাকায় ছিল।

১৭৬২ সালে টেকনাফ থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত প্রায় ৪০০ কিলোমিটার বিস্তৃত ফল্ট লাইনে সাড়ে ৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়। এতে সেন্টমার্টিন দ্বীপ প্রায় তিন মিটার ওপরে উঠে আসে। আগে সেটি ছিল ডুবন্ত দ্বীপ। সেবার সীতাকুণ্ড পাহাড়ে নিচ থেকে কাদা-বালুর উদগীরণ ঘটে, বঙ্গোপসাগরে বিশাল আকারের ঢেউ তৈরি হয়ে বহু ঘরবাড়ি ভেসে যায়, প্রায় ২০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। সেই ভূমিকম্প ব্রহ্মপুত্র নদীর গতিপথ বদলে দেয়।

১৮৬৯ সালে সাড়ে ৭ মাত্রার এ ভূমিকম্প ‘কাচার আর্থকোয়াক’ নামে পরিচিতি পায়। এর উৎপত্তিস্থল ছিল সিলেটের খুব কাছে জৈন্তা পাহাড়ের উত্তরাংশে অবস্থিত শিলচড়ে। সেই ভূমিকম্পে শিলচড়, নওগাং ও ইম্ফল এলাকায় বহু স্থাপনা ধসে পড়ে। তবে প্রাণহানির সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি।

১৮৮৫ সালের ১৪ জুলাইয়ের ভূমিকম্পের মাত্রা ৭। উৎপত্তিস্থল মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ায়। ভারতের সিকিম, বিহার, মনিপুর ও মিয়ানমার পর্যন্ত এর কম্পন অনুভূত হয়। ঢাকা, বগুড়া, ময়মনসিংহ, শেরপুর এবং পাবনায় প্রাণহানি ঘটে।

১৮৯৭ সালে ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক’ নামে পরিচিত এ ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৭। উৎপত্তিস্থল ছিল মেঘালয়ের শিলং অঞ্চল। সেই ভূমিকম্পে দেড় হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। সিলেটেই প্রাণহানির সংখ্যা ছিল পাঁচ শতাধিক। সিলেটের বহু বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয় এবং ময়মনসিংহ ও দেশের উত্তরাঞ্চলেও ব্যাপক ক্ষতি হয়। সেবার বিভিন্ন এলাকায় ফাটল দেখা দেয় এবং সুরমা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর গতিপথে প্রভাব পড়ে।

১৯১৮ সালের ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৬ এবং উৎপত্তিস্থল ছিল শ্রীমঙ্গলের বালিছড়া। সেবার শ্রীমঙ্গল ও ভারতের ত্রিপুরা অঞ্চলে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়, তবে প্রাণহানির সংখ্যা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

১৯৯৭ সালে চট্টগ্রামে ৬ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্পে ২৩ জনের মৃত্যু হয়। তবে ক্ষয়ক্ষতি খুব বেশি হয়নি। দুই বছর পর ১৯৯৯ সালে মহেশখালীতে একটি ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ২। সেবার অন্তত ছয়জনের মৃত্যু হয়।

টিটি/একিউএফ/জিকেএস

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow