তদন্তে উঠে এলো দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তাহীনতার চিত্র

ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সে গত ১৮ অক্টোবর ঘটে যাওয়া ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত অনুসন্ধান কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে বিমানবন্দরে দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তাহীনতা, তদারকির ঘাটতি এবং নিয়ম উপেক্ষার করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে। অনুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, যেখান থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত সেই আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সের কুরিয়ার শেডে ৪৮টি ছোট খাঁচা ছিল, যেখানে বিভিন্ন কুরিয়ার এজেন্সি এলোমেলোভাবে পণ্য মজুত করত। সেখানে অত্যন্ত দাহ্য ও বিপজ্জনক উপকরণ—কাপড়, রাসায়নিক, চাপযুক্ত পারফিউম ও বডি স্প্রে, ইলেকট্রনিক্স, ব্যাটারি, ওষুধ—কোনো সতর্কতা ছাড়াই রাখা ছিল। ওই স্থানে ফায়ার অ্যালার্ম বা স্মোক ডিটেক্টর,ওয়াটার স্প্রিংকলার,ওফায়ার হাইড্রেন্ট ছিল না। প্রতিবেদনে বলা হয়, এ ধরনের নিরাপত্তাহীন ও বিপজ্জনক পরিবেশ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মতো প্রতিষ্ঠানে অগ্রহণযোগ্য এবং এটি নিয়মিত তদারকির ব্যর্থতার সুস্পষ্ট প্রমাণ। মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) বিকেলে রাজধানীর বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম তদন্ত কমিটির বর

তদন্তে উঠে এলো দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তাহীনতার চিত্র

ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সে গত ১৮ অক্টোবর ঘটে যাওয়া ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত অনুসন্ধান কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে বিমানবন্দরে দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তাহীনতা, তদারকির ঘাটতি এবং নিয়ম উপেক্ষার করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে।

অনুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, যেখান থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত সেই আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সের কুরিয়ার শেডে ৪৮টি ছোট খাঁচা ছিল, যেখানে বিভিন্ন কুরিয়ার এজেন্সি এলোমেলোভাবে পণ্য মজুত করত। সেখানে অত্যন্ত দাহ্য ও বিপজ্জনক উপকরণ—কাপড়, রাসায়নিক, চাপযুক্ত পারফিউম ও বডি স্প্রে, ইলেকট্রনিক্স, ব্যাটারি, ওষুধ—কোনো সতর্কতা ছাড়াই রাখা ছিল।

ওই স্থানে ফায়ার অ্যালার্ম বা স্মোক ডিটেক্টর,ওয়াটার স্প্রিংকলার,ওফায়ার হাইড্রেন্ট ছিল না।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এ ধরনের নিরাপত্তাহীন ও বিপজ্জনক পরিবেশ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মতো প্রতিষ্ঠানে অগ্রহণযোগ্য এবং এটি নিয়মিত তদারকির ব্যর্থতার সুস্পষ্ট প্রমাণ।

মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) বিকেলে রাজধানীর বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম তদন্ত কমিটির বরাত দিয়ে এ তথ্য জানান।

তিনি জানান, শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো কমপ্লেক্সে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি আজ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন পেশ করেন।

ফায়ার সার্ভিসের ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ: ১৫০০ ডিগ্রি তাপ, রাসায়নিক, পানি সংকট
অনুসন্ধান কমিটি জানায়, আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসকে কয়েকটি মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে—১৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রায় পূর্ণমাত্রায় বিকশিত অগ্নিকাণ্ড, অ্যাপ্রোনে স্তূপ করা কার্গো ও কুরিয়ার পণ্য, যা ফায়ার টেন্ডারের চলাচলে বড় বাধা তৈরি করে, ফায়ার হাইড্রেন্টের অনুপস্থিতি, অজ্ঞাত রাসায়নিকের উপস্থিতি, যা আগুন নিয়ন্ত্রণে ঝুঁকি বাড়ায়, অপর্যাপ্ত পানি উৎস ও ফোমের স্বল্পতা ও ধ্বংসাবশেষ পড়া।

প্রতিবেদন বলা হয়, এত বড় অবকাঠামোয় এ ধরনের মৌলিক অগ্নিনির্বাপণ সুবিধার অনুপস্থিতি ফায়ার সার্ভিসকে কার্যত বিপর্যস্ত অবস্থায় ফেলে দেয়।

আরও পড়ুন
কার্গো ভিলেজের আগুন নাশকতা নয়, ছড়ায় কুরিয়ারের পণ্যের স্তূপ থেকে
হাজার কোটি টাকার ‘গরমিলে’ খুলছে না শাহজালালের নতুন কার্গো ভিলেজ

আগুনের উৎস: একই সার্কিট লাইনে তিন কুরিয়ার কেজ, সেখানে শর্ট সার্কিটই দায়ী
তুর্কি বিশেষজ্ঞ দল, বুয়েট, ফায়ার সার্ভিস ও সিআইডি ফরেনসিক ইউনিটের যৌথ বিশ্লেষণে নিশ্চিত হয়েছে—কুরিয়ার শেডের বর্ধিত অংশের উত্তর-পশ্চিম কোণে ডিএইচএল, আর এস এবং এসআরকের পাশাপাশি থাকা কেজগুলোর যে কোনো একটিতে আর্কিংয়ের পর স্বল্পমাত্রার শর্ট সার্কিট থেকেই আগুনের সূত্রপাত।

এত বড় অগ্নিকাণ্ডের জন্য এ ধরনের প্রাথমিক ত্রুটিই যথেষ্ট ছিল, কারণ গোটা এলাকায় দাহ্য ও বিস্ফোরণ-ঝুঁকিপূর্ণ পণ্য ছড়িয়ে ছিল।

বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড উপেক্ষা, তদারকির অভাব ও ব্যবস্থাপনার বিপর্যয়
প্রতিবেদনে আমদানি কার্গো ব্যবস্থাপনার পুঞ্জীভূত দুর্বলতা উঠে এসেছে। তন্মধ্যে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড ( বিএনবিসি) উপেক্ষা, কার্গো অ্যাপ্রোনে প্রতিদিন প্রায় ৪০০ টন পণ্য এলোমেলোভাবে ফেলে রাখা হয়, ফলে কুরিয়ার শেডে প্রবেশাধিকার বাধাগ্রস্ত হয়।

আমদানি কার্গো ব্যবস্থাপনার কোনো কার্যকর সিস্টেম বা তদারকি নেই
প্রতিবেদনে বলা হয়, দাহ্য ও বিপজ্জনক পণ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কোনো উদ্যোগ নেই, সিএএবি’র স্থাপনায় স্থায়ী ফায়ার স্টেশন পর্যন্ত নেই। অনুসন্ধান কমিটির মতে, এসব অনিয়ম বহু বছর ধরে চলে এসেছে এবং কোনো সংস্থা সময়মতো ব্যবস্থা নেয়নি।

প্রশাসনিক ব্যর্থতা: ১২ বছরে ৭টি অগ্নিকাণ্ড, তারপরও কোনো বাস্তব পদক্ষেপ নেই
প্রতিবেদন অনুযায়ী—২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৭টি বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এফএসসিডিও সিএএবি এর মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক সইয়ের জন্য ৯ বছর ধরে যোগাযোগ চললেও সমঝোতা স্মারক এখনো চূড়ান্ত হয়নি। বিএনএসিডাব্লিউসি ২০২১ সালে বিপজ্জনক পণ্যের গুদাম সরানোর সুপারিশ করলেও এখনো তা বাস্তবায়ন হয়নি।

কার্গো এলাকায় বছরের পর বছর ধরে নিলামযোগ্য পণ্য জমে আছে
মোট পণ্যের প্রায় ৭৫ শতাংশ ছিল নিলামযোগ্য ছিল। প্রতিবেদনে এটিকে ভয়াবহ প্রশাসনিক ব্যর্থতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

জবাবদিহিতা: দায় এড়াতে পারে না কেউই

অনুসন্ধান কমিটি স্পষ্টভাবে চার পক্ষকে দায়ী করেছে—
১. সিএএবি: তদারকি, নিরাপত্তা ও নিয়ম বাস্তবায়নে সম্পূর্ণ ব্যর্থ।
২. বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স (লিজগ্রহীতা হিসেবে):নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ, তদারকিও অপর্যাপ্ত।
৩. কুরিয়ার কোম্পানিজ: সিএএবি থেকে নিরাপত্তা আদায়ে ব্যর্থ হয়েছে, নিজেরাও ব্যবস্থা নেয়নি।
৪. ঢাকা কাস্টমস হাউস: নিলামযোগ্য পণ্য সময়মতো নিষ্পত্তিতে ব্যর্থ হয়ে বিপজ্জনক পণ্য বছরের পর বছর জমিয়ে রেখেছে। অনুসন্ধান কমিটির ভাষায়, ‘দায় এড়ানোর সুযোগ কারো নেই।’

সুপারিশ: নিরাপত্তা নিশ্চিত না করলে ভবিষ্যতে আরও বড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা
কমিটি জরুরি ভিত্তিতে কয়েকটি পদক্ষেপের সুপারিশ করেছে—বিমানবন্দরের রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার জন্য সিএএবি’র অধীনে দক্ষ অপারেটর নিয়োগ, আইসিএও ও বিএনবিসি মানদণ্ড কঠোরভাবে বাস্তবায়ন, বিমান বাংলাদেশকে শুধু যাত্রী ও মাল পরিবহনে সীমাবদ্ধ রাখা—গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং দক্ষ অপারেটরের হাতে, এইচএসআইএ–তে অবিলম্বে আধুনিক ফায়ার স্টেশন স্থাপন।

বিপজ্জনক দ্রব্য ও রাসায়নিক গুদাম আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী স্থানান্তর
নিলামযোগ্য পণ্যের জন্য আলাদা কাস্টমস গুদাম, সব প্রতিষ্ঠানের কমপক্ষে ১৮ শতাংশ কর্মীকে অগ্নিনির্বাপণ, উদ্ধার এবং প্রাথমিক চিকিৎসায় প্রশিক্ষণ।

কমিটি সতর্ক করে বলেছে এ সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন না হলে ভবিষ্যতে আরও বড় মানবিক ও আর্থিক বিপর্যয় ঘটতে পারে।

এমইউ/এমআইএইচএস/এমএস

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow