দেশে ন্যানো ইউরিয়া সার উদ্ভাবন!

দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত রাসায়নিক সার হচ্ছে ইউরিয়া। কিন্তু ইউরিয়া সারের সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ ব্যবহার করা যায়। যার কারণে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়।  এ সমস্যার সমাধানে উৎপাদন বৃদ্ধি ও আর্থিক ক্ষতি কমানোর লক্ষ্যে ইউরিয়া সারের ব্যবহার দক্ষতা বৃদ্ধির জন্যে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষক প্রথমবারের মতো ন্যানো বায়োচার (কার্বন) সমৃদ্ধ ন্যানো ইউরিয়া সার উদ্ভাবনের দাবি করেছেন।  উদ্ভাবিত সারটি মূলত প্রচলিত ইউরিয়া সার থেকে ন্যানো আকারের হওয়ায় ইউরিয়া সারের অপচয় কমপক্ষে ২৫ শতাংশ কম হবে এবং পরিবেশবান্ধব কৃষি নিশ্চিত করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। বুধবার (১৭ ডিসেম্বর) ন্যানো বায়োচার সমৃদ্ধ ন্যানো ইউরিয়া সার উদ্ভাবনের কথা জানিয়েছেন গবেষক দলের প্রধান কৃষিতত্ত্ব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. আহমদ খায়রুল হাসান।  কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের (কেজিএফ) আর্থিক সহায়তায় গবেষণাটি পরিচালিত হচ্ছে ২০২৩ সাল থেকে। এ গবেষণায় অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ খোরশেদ আলম, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের (বিএইসি) সিএসও ড. শেখ ম

দেশে ন্যানো ইউরিয়া সার উদ্ভাবন!

দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত রাসায়নিক সার হচ্ছে ইউরিয়া। কিন্তু ইউরিয়া সারের সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ ব্যবহার করা যায়। যার কারণে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। 

এ সমস্যার সমাধানে উৎপাদন বৃদ্ধি ও আর্থিক ক্ষতি কমানোর লক্ষ্যে ইউরিয়া সারের ব্যবহার দক্ষতা বৃদ্ধির জন্যে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষক প্রথমবারের মতো ন্যানো বায়োচার (কার্বন) সমৃদ্ধ ন্যানো ইউরিয়া সার উদ্ভাবনের দাবি করেছেন। 

উদ্ভাবিত সারটি মূলত প্রচলিত ইউরিয়া সার থেকে ন্যানো আকারের হওয়ায় ইউরিয়া সারের অপচয় কমপক্ষে ২৫ শতাংশ কম হবে এবং পরিবেশবান্ধব কৃষি নিশ্চিত করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।

বুধবার (১৭ ডিসেম্বর) ন্যানো বায়োচার সমৃদ্ধ ন্যানো ইউরিয়া সার উদ্ভাবনের কথা জানিয়েছেন গবেষক দলের প্রধান কৃষিতত্ত্ব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. আহমদ খায়রুল হাসান। 

কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের (কেজিএফ) আর্থিক সহায়তায় গবেষণাটি পরিচালিত হচ্ছে ২০২৩ সাল থেকে। এ গবেষণায় অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ খোরশেদ আলম, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের (বিএইসি) সিএসও ড. শেখ মনজুরা হক, বাকৃবির মৃত্তিকা বিভাগের অধ্যাপক ড. তাহসিনা শারমিন হক, পিএইচডি ফেলো মো. আমজাদ হোসেন এবং বুয়েটের শিক্ষার্থী মো. রোকনুজ্জামান রিপন। 

অধ্যাপক ড. খায়রুল জানান, আমরা দুটি পদ্ধতি ব্যবহার করে ন্যানো ইউরিয়া তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের তৈরিকৃত ন্যানো ইউরিয়া ২০-৫০ ন্যানো মিটারের। পাশাপাশি ন্যানো ইউরিয়াকে ন্যানো কার্বন কোটেড করা হয়েছে, যা ইউরিয়ার নাইট্রোজেন মুক্ত করার প্রক্রিয়াকে ধীরগতির করেছে। ধান উৎপাদনের ক্ষেত্রে এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিতভাবে নাইট্রোজেন মুক্ত করা সম্ভব হবে। এর মাধ্যমে নাইট্রোজেনের অপচয় কম হবে এবং কৃষকরা কম ইউরিয়া সার ব্যবহার করার মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে। পাশাপাশি ন্যানো ইউরিয়া ব্যবহারের ফলে ফসল উৎপাদন বেড়ে যাবে।

তিনি বলেন, আমাদের মাঠপর্যায়ে পরীক্ষা এখনো বাকি তবে আশা করা যায় আগামী বোরো মৌসুমের পরেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এর মাঠ পর্যায়ের পরীক্ষা করা সম্ভব হবে। আমাদের লিটারেচার রিভিউ অনুসারে এই ন্যানো ইউরিয়া ব্যবহারের ফলে ২৫ শতাংশ কম ইউরিয়া লাগবে। বায়োচার কোডের ন্যানো ইউরিয়া পরিবেশবান্ধব। এর ফলে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ কমে যায়। আশা করি, এর মাধ্যমে কৃষক এবং দেশ উপকৃত হবে। পাশাপাশি সরকার ইউরিয়া খাতে যে ভর্তুকি দেয় তার পরিমাণ কমে আসবে। 

গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলের বিষয়ে তিনি বলেন, হাইড্রক্সিঅ্যাপাটাইট-ইউরিয়া, ইউরিয়া-ন্যানো বায়োচার এবং হাইড্রক্সিঅ্যাপাটাইট-ইউরিয়া-ন্যানো বায়োচার এ তিনটি ন্যানো হাইব্রিড ম্যাটেরিয়ালস সফলভাবে ল্যাবরেটরিতে উৎপাদন সম্পন্ন হয়েছে। এফটিআইআর বিশ্লেষণে শক্তিশালী রাসায়নিক বন্ধন ও ফাংশনালাইজেশন নিশ্চিত করা হয়েছে। টিইএম বিশ্লেষণে কণার আকার ৩০-৩২ ন্যানোমিটারের মধ্যে পাওয়া গেছে, যা গাছের কোষে সহজে প্রবেশ করতে পারবে। 

তিনি আরও বলেন, প্রচলিত ইউরিয়া সার ব্যবহারের কার্যকারিতা মাত্র ৩০-৪০ শতাংশ, যেখানে অ্যামোনিয়া গ্যাস, লিচিং, রানঅফ এবং ডিনাইট্রিফিকেশনের মাধ্যমে মোট ৫৫-১০০ শতাংশ পর্যন্ত অপচয় ঘটে। এ বিশাল অপচয়ের ফলে নাইট্রাস অক্সাইড নির্গমনের মাধ্যমে মারাত্মক পরিবেশ দূষণ ঘটে (যা কার্বন-ডাই-অক্সাইডের চেয়ে ৩০০ গুণ শক্তিশালী গ্রিন হাউস গ্যাস) এবং বৈশ্বিকভাবে ২৬-৪০ বিলিয়ন ডলারের বার্ষিক অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। এ সমস্যার সমাধানে সবচেয়ে বড় সাফল্য হিসেবে প্রায় অপচয়হীন ন্যানো সার তৈরির পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে, যা একবার প্রয়োগের সুবিধার কারণে শ্রম খরচও কমাবে।

ন্যানো-কার্বন ইউরিয়া সার ব্যবহারের সুবিধার বিষয়ে তিনি বলেন, নাইট্রোজেন ব্যবহারের দক্ষতা ৭৫-৮৫ শতাংশ বৃদ্ধি করে। যা গাছের চাহিদা অনুযায়ী নাইট্রোজেন রিলিজ নিশ্চিত করে এবং ন্যানো সারের ব্যবহারে আর্থিক ফলন নিশ্চিত হয়। অ্যামোনিয়া অপচয় ৮০-৯০ শতাংশ কম হয়, নাইট্রেট লিচিং ৬৫-৭৫ শতাংশ কম এবং নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড নির্গমন ৪০-৫০ শতাংশ কম করে। যার ফলে মাটির গুণাগুণ বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি ধানের ফলন ১০-২৫ শতাংশ বৃদ্ধি করে এবং প্রোটিনের উপাদান ৮-১২ শতাংশ বৃদ্ধি করে ফসলের গুণগত মান উন্নয়ন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ন্যানো ইউরিয়া ব্যবহারের ফলে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ ইউরিয়া সারের ব্যবহার কমবে, ফলে বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব হবে।

পিএইচডি ফেলো মো. আমজাদ হোসেন বলেন, ভারত থেকে অনেকেই তরল ন্যানো ইউরিয়া নিয়ে এস ল্যাবে দিচ্ছে। কিন্তু আমরাই প্রথম ন্যানো বায়োচার সমৃদ্ধ ন্যানো ইউরিয়া নিয়ে সংশ্লেষণ করেছি। মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষণ সফল হলে দেশের জন্যে এটি একটি মাইলফলক হবে।

কেজিএফের ক্লাইমেট অ্যান্ড ন্যাচারাল রিসোর্সের সিনিয়র স্পেশালিস্ট ড. মো. মনোয়ার করিম খান বলেন, আমরা যে ইউরিয়াটি বর্তমানে উন্নত করছি, সেটি ব্যবহার করলে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত ইউরিয়া কম প্রয়োগ করেও ফলন কমবে না। এর ফলে শুধু উৎপাদন খরচ কমবে না বরং জমির স্বাস্থ্য উন্নত হবে এবং পরিবেশ দূষণ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে। দীর্ঘমেয়াদে এটি কৃষক ও রাষ্ট্র উভয়ের জন্যই বড় অঙ্কের অর্থ সাশ্রয় করবে। এ উদ্ভাবিত সারটি সাধারণ ন্যানো ইউরিয়া নয় বরং এটি বায়োচার কোটেড বা কার্বন কোটেড ন্যানো ইউরিয়া। এর বিশেষত্ব হলো বায়োচার কোটিংয়ের কারণে ইউরিয়া ধীরে ধীরে মুক্ত হয়। ফলে গাছ প্রয়োজন অনুযায়ী দীর্ঘ সময় ধরে নাইট্রোজেন গ্রহণ করতে পারে।

বায়োচার সমৃদ্ধ ন্যানো ইউরিয়ার প্রধানত দুটি বড় সুবিধা রয়েছে। প্রথমত, ইউরিয়ার ব্যবহার ও খরচ সাশ্রয়। প্রচলিত ইউরিয়া ব্যবহারের ক্ষেত্রে গাছ সর্বোচ্চ মাত্র ৪০ শতাংশ নাইট্রোজেন গ্রহণ করতে পারে। বাকি প্রায় ৬০ শতাংশ নাইট্রোজেন নষ্ট হয়ে যায়, যা ভোলাটিলাইজেশন প্রক্রিয়ায় বায়ুতে উড়ে যায় অথবা লিচিংয়ের মাধ্যমে মাটি ও পানিতে প্রবেশ করে খাল-বিল, নদী ও নর্দমায় পৌঁছে যায়। বায়োচার কোটিং থাকার কারণে এ অপচয় অনেকাংশে কমে আসে।

দ্বিতীয়ত, পরিবেশ সুরক্ষা ও জমির স্বাস্থ্য উন্নয়ন। অতিরিক্ত ইউরিয়া ব্যবহারে মাটির জৈবগুণ নষ্ট হয় এবং পানি ও বায়ুদূষণ বাড়ে। কিন্তু কোটেড ন্যানো ইউরিয়ায় নাইট্রোজেন ক্ষয় কম হওয়ায় মাটিতে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে না। ফলে মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকে, ভূগর্ভস্থ পানিদূষণের ঝুঁকি কমে এবং পরিবেশের ওপর চাপ হ্রাস পায়।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow