পর্তুগিজ আমলের রাস্তায় একদিন

উরুগুয়ের পর্তুগিজ আমলের রাস্তায় একদিন, কালে দে লোস সুস্পিরোস ও এল বুয়েন সাসপিরো। কোলোনিয়া দেল সাক্রামেন্তো উরুগুয়ের মানচিত্রে এক নীরব অথচ রহস্যময় শহর। আজকের আধুনিক জীবনকে পেছনে ফেলে যেন কয়েক শতাব্দীর পুরোনো সময়ের ভেতর পা দিয়ে ফেলতে হয় এখানে এলে। ঢালু রাস্তা, পাথর বাঁধানো পথ, পর্তুগিজ আমলের খাটো ছাদ, কাঠের দরজা, ছোট ছোট জানালা—সবই যেন এমন এক ইতিহাসের অবশিষ্ট, যার স্পর্শে মানুষ মুহূর্তেই অন্য এক যুগে হারিয়ে যায়। এই শহরের সবচেয়ে মায়াবী, সবচেয়ে জনপ্রিয়, সবচেয়ে ছবির মতো সুন্দর রাস্তা হলো কালে দে লোস সুস্পিরোস। আমার জন্য এটি কেবল একটি ঐতিহাসিক পথ ছিল না বরং এক গভীর অনুভবের অভিজ্ঞতা, যা বহুদিন মনে গেঁথে থাকবে। এই রাস্তায় পা রাখার আগেই শুনেছিলাম, এটি নাকি পর্তুগিজ আমলে তৈরি। এর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সামান্য ছোট ছোট ঘরগুলো চারশ থেকে পাঁচশ বছরের পুরোনো। তখনো বুঝিনি, সেই পুরোনোত্ব কতটা জীবন্ত হয়ে উঠবে আমার সামনে। রাস্তাটি যখন প্রথমবার দেখলাম, মনে হলো আমি যেন একটি ছবির ভেতরে দাঁড়িয়ে আছি। পুরো রাস্তা ঢালু, মাঝখানে পাথরের তৈরি একটি প্রাকৃতিক নালা চলে গেছে নিচে, যেখানে বৃষ্টির পানি সহজেই গড়িয়ে নদীর দিকে

পর্তুগিজ আমলের রাস্তায় একদিন

উরুগুয়ের পর্তুগিজ আমলের রাস্তায় একদিন, কালে দে লোস সুস্পিরোস ও এল বুয়েন সাসপিরো। কোলোনিয়া দেল সাক্রামেন্তো উরুগুয়ের মানচিত্রে এক নীরব অথচ রহস্যময় শহর। আজকের আধুনিক জীবনকে পেছনে ফেলে যেন কয়েক শতাব্দীর পুরোনো সময়ের ভেতর পা দিয়ে ফেলতে হয় এখানে এলে। ঢালু রাস্তা, পাথর বাঁধানো পথ, পর্তুগিজ আমলের খাটো ছাদ, কাঠের দরজা, ছোট ছোট জানালা—সবই যেন এমন এক ইতিহাসের অবশিষ্ট, যার স্পর্শে মানুষ মুহূর্তেই অন্য এক যুগে হারিয়ে যায়। এই শহরের সবচেয়ে মায়াবী, সবচেয়ে জনপ্রিয়, সবচেয়ে ছবির মতো সুন্দর রাস্তা হলো কালে দে লোস সুস্পিরোস। আমার জন্য এটি কেবল একটি ঐতিহাসিক পথ ছিল না বরং এক গভীর অনুভবের অভিজ্ঞতা, যা বহুদিন মনে গেঁথে থাকবে।

এই রাস্তায় পা রাখার আগেই শুনেছিলাম, এটি নাকি পর্তুগিজ আমলে তৈরি। এর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সামান্য ছোট ছোট ঘরগুলো চারশ থেকে পাঁচশ বছরের পুরোনো। তখনো বুঝিনি, সেই পুরোনোত্ব কতটা জীবন্ত হয়ে উঠবে আমার সামনে। রাস্তাটি যখন প্রথমবার দেখলাম, মনে হলো আমি যেন একটি ছবির ভেতরে দাঁড়িয়ে আছি। পুরো রাস্তা ঢালু, মাঝখানে পাথরের তৈরি একটি প্রাকৃতিক নালা চলে গেছে নিচে, যেখানে বৃষ্টির পানি সহজেই গড়িয়ে নদীর দিকে নেমে যেতো। রাস্তার দুপাশ নিচু, মাঝে উঁচু, কোথাও কোনো ফুটপাত নেই। এক আশ্চর্য নীরবতা ছড়িয়ে থাকে এই পথজুড়ে। পায়ের নিচে পাথরের শব্দ যেন অতীতের প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে।

কালের সাক্ষী হয়ে থাকা ঘরগুলোয় স্পষ্টই বোঝা যায় পর্তুগিজ স্থাপত্যের প্রভাব। খাটো দেওয়াল, মাটির টালি, পাথরের কাঠামো, সংকীর্ণ কাঠের দরজা সবকিছুই শতাব্দী পুরোনো স্নেহে গড়া। ইউনেস্কো ১৯৯৫ সালে কোলোনিয়া দেল সাক্রামেন্তোর এই ঐতিহাসিক জেলাকে বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করে। তবুও আশ্চর্যের বিষয়, অনেক রাস্তা যেমন নতুন করে সংস্কার করা হয়, কালে দে লোস সুস্পিরোস এখনো প্রায় তার মূল রূপেই রয়ে গেছে। এই অক্ষত অবিকৃত সৌন্দর্যই রাস্তার মায়া আরও বাড়িয়ে দেয়।

jagonews

অনেক কাহিনি প্রচলিত এই রাস্তার নামে। কেউ বলেন, একসময় এখানে নাবিকদের অবসর বিনোদনের জায়গা ছিল। সেসব নাবিকেরা নাকি এখানে এসে সুস্পিরোস অর্থাৎ নিঃশ্বাস ফেলতো। সেই নিঃশ্বাস থেকেই নাকি এসেছে নাম কালে দে লোস সুস্পিরোস। আবার কেউ বলেন, মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সময় বন্দিদের এই রাস্তা দিয়ে নদীর দিকে নিয়ে যাওয়া হতো; তাদের শেষ নিঃশ্বাসই নাকি আজকের রাস্তার নাম। আরেক কাহিনি আরও বেশি করুণ, কোনো এক তরুণী তার প্রেমিকের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল এই রাস্তায়, তখন তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তার শেষ নিঃশ্বাস নাকি রাস্তার নাম রেখে গেছে। কোনটা সত্য, তা কেউ জানে না। তবে এই রহস্যময়তার ছোঁয়ায় রাস্তার সৌন্দর্য আরও গভীর হয়ে ওঠে।

এই ঐতিহাসিক পরিবেশের মাঝেই দাঁড়িয়ে আছে এক অসাধারণ রেস্টুরেন্ট এল বুয়েন সাসপিরো। বহু আগে থেকেই শুনেছিলাম, কালে দে লোস সুস্পিরোসে গেলে এই রেস্টুরেন্টে ঢোকার সুযোগ পাওয়া অনেক সময় কঠিন হয়। সেদিন আমিও একই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলাম। অনেক রিকোয়েস্টের পর অবশেষে ভেতরে ঢুকতে পারলাম, এ যেন নিজেই এক অভিজ্ঞতা। রেস্টুরেন্টটার অবস্থান যে বাড়িতে, সেই বাড়ি পর্তুগিজ আমলের ১৭২০ সালেরও আগের। দেওয়ালজুড়ে বড় বড় অসমান পাথর, কাঠের বিম, নিচু ছাদ, আমি হাঁটতে হাঁটতে মাথা ঠেকানোর অবস্থায় পড়ে যাই। সেই সময়কার মানুষের উচ্চতা ছিল তুলনামূলক কম, এ কারণে ঘরগুলোও নিচু করে তৈরি করা হতো।

আরও পড়ুন
নীরব সৌন্দর্যের শহর স্ট্যানলি 
ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের বিস্ময়কর ভ্রমণ 

রেস্টুরেন্টের ভেতর ঢুকেই যেন এক অদ্ভুত অনুভূতিতে ভরে গেল মন। মনে হলো তিনশ বছর আগে এখানে কোনো পর্তুগিজ পরিবারের রান্নাঘর ছিল; হয়তো তারা অন্ধকারে লণ্ঠন জ্বেলে রাতের খাবার খেত; হয়তো বৃষ্টির রাতে এই পাথরের দেওয়ালের গায়ে ছাতা ঠেকিয়ে দাঁড়াতো। ঠিক সেভাবেই সবকিছু যেন এখনো জাগ্রত। এল বুয়েন সাসপিরোতে ঢুকে আমি প্রথম যে জিনিসটি দেখলাম, সেটি হলো ঐতিহ্যবাহী পণ্যসমূহ, আলফাখোর, হাতের তৈরি চিজ, স্থানীয় মধু, আঙুরের স্পিরিট, অলিভ অয়েল এবং বিভিন্ন জ্যাম। দেওয়ালের ওপর হস্তলিখিত পুরোনো নোট, কালো কাঠের তাক, প্রাচীন ধাতব লণ্ঠন সব মিলিয়ে পরিবেশটা স্পর্শ করলো ভিন্নভাবে। মনে হলো যেন তিনশ বছরের পুরোনো কোনো পর্তুগিজ ঘরে আমি অতিথি হয়ে এসেছি।

jagonews

রেস্টুরেন্টের টেবিলে রাখা ছিল ছোট একটি বোর্ড ‌‘কাসা পর্তুগিজ আনো ১৭২০’। এই একটা বোর্ডই যেন বলে দিচ্ছিল বাড়িটির জন্মের ইতিহাস। এত পুরোনো, এত অক্ষত, এত সতর্কভাবে সংরক্ষিত একটি ভবনের ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা সত্যি এক ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা। আমার কাছে সবচেয়ে অবাক লেগেছিল, ল্যাতিন আমেরিকার অনেক দেশ তাদের ঔপনিবেশিক স্থাপত্য দারুণভাবে সংরক্ষণ করে রাখে, যা সাধারণত ইউরোপে দেখা যায়। কিন্তু উরুগুয়েতে এসে এমন নিখুঁতভাবে সংরক্ষিত পর্তুগিজ ঘর দেখতে পাবো, এটা ভাবিনি।

এল বুয়েন সাসপিরোতে ঢুকে আমি শুধু কয়েকটি ভিডিও আর ছবি তুলতেই পারিনি, স্পর্শ করেছি সেই বিশাল পাথরগুলোকে; যেগুলো তিনশ বছরেরও বেশি সময় ধরে মানবজীবনের নীরব সাক্ষী হয়ে আছে। স্পর্শে মনে হলো সময় যেন আরও ধীরে বয়ে যাচ্ছে। যেন পাথরগুলো থেকে শোনা যায় পুরোনো দিনের শব্দ, কেউ দরজায় কড়া নাড়ছে, কেউ দরজা খুলছে, ঘরের ভেতর দিয়ে বাতাস বয়ে যাচ্ছে।

বাড়িটি কালে দে লোস সুস্পিরোস রাস্তার যে ঐতিহ্য বহন করে, তারই অংশ। প্লাসা মেয়র ঘুরে এই রাস্তায় নামলে চোখে পড়ে রাস্তার দুপাশে ঐতিহ্যবাহী দেওয়াল, যেখানে এখনো পর্তুগিজ ধাঁচের সিরামিক টাইলসে রাস্তার নাম লেখা। ছোট ছোট জানালার পাশে ঝোলানো থাকে লোহার পুরোনো ল্যাম্পপোস্ট, রাতে এগুলো জ্বলে উঠলে পুরো রাস্তার পরিবেশ হয়ে ওঠে যেন গল্পের বইয়ের মতো। আধুনিক বিদ্যুতের আলোও সেই রোমান্টিক সৌরভকে চাপা দিতে পারে না।

jagonews

এই রাস্তার নীরবতা, এর সাদামাটা সৌন্দর্য, এমনকি এর প্রতিটি পাথরও যেন ইতিহাসের গন্ধ ছড়ায়। রাস্তার শেষ মাথায় গিয়ে দেখা যায় রিয়ো দে লা প্লাতা নদীর নীলাভ জলে মিশে যাচ্ছে ঢালু পথটা। সন্ধ্যার আলো নদীর গায়ে পড়লে মনে হয় কেউ যেন সোনালি আবরণ বিছিয়ে দিয়েছে পানির ওপর। সেখানে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল, কয়েকশ বছর আগেও এই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে হয়তো কোনো পর্তুগিজ জাহাজের নাবিক নদীর দিকে তাকিয়েছিল। সেই দৃশ্য, সেই বাতাস আজও একই আছে, শুধু মানুষগুলো চেঞ্জ হয়েছে।

এসইউ

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow