বাংলাদেশ রেলওয়ে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়; শাসনে গড়া স্বপ্নের ঠিকানা

কিছু ডাক জীবনের দিক বদলে দেয়। সকালের ঘণ্টাধ্বনি, শিক্ষকের কঠোর কণ্ঠ, খাতার ওপর লাল কালি—সব মিলিয়ে যে শাসনের শিক্ষা, তা আজীবন বয়ে বেড়ায় একজন মানুষ। বাংলাদেশ রেলওয়ে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ঠিক তেমনই এক প্রতিষ্ঠান—যেখানে শাসনের ভেতর দিয়েই শেখানো হয়েছে স্বপ্ন দেখতে, মানুষ হতে। শতবর্ষের সকালে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে পা রেখেই বোঝা যায়, দিনটি অন্যরকম। পুরনো ভবনের দেয়ালে লেগে থাকা শত বছরের গল্প যেন নতুন করে কথা বলে। পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে দিনের সূচনা হয়। সকাল ১১টায় জাতীয় সংগীতের সাথে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় শতবর্ষ উদযাপন। পরে শান্তির প্রতীক পায়রা উড়িয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন অতিথিরা। লোকপ্রদর্শনীতে চোখে পড়ে সাদাকালো ছবি, পুরনো রেজাল্ট শিট, হারিয়ে যাওয়া খাতার পৃষ্ঠা। বন্ধুদের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই অনেকের মনে পড়ে যায় অতীতের স্মৃতির পাতাগুলো। কেউ ফিসফিস করে বলেন, “এই বেঞ্চেই বসতাম,” কেউ আবার মুঠোফোনের ক্যামেরায় বন্দি করেন নিজের কৈশোর। দুপুর গড়াতেই বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ রূপ নেয় আবেগঘন মিলনমেলায়। বহু বছর পর প্রিয় শিক্ষকদের সামনে দাঁড়িয়ে অ

বাংলাদেশ রেলওয়ে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়; শাসনে গড়া স্বপ্নের ঠিকানা

কিছু ডাক জীবনের দিক বদলে দেয়। সকালের ঘণ্টাধ্বনি, শিক্ষকের কঠোর কণ্ঠ, খাতার ওপর লাল কালি—সব মিলিয়ে যে শাসনের শিক্ষা, তা আজীবন বয়ে বেড়ায় একজন মানুষ। বাংলাদেশ রেলওয়ে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ঠিক তেমনই এক প্রতিষ্ঠান—যেখানে শাসনের ভেতর দিয়েই শেখানো হয়েছে স্বপ্ন দেখতে, মানুষ হতে।

শতবর্ষের সকালে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে পা রেখেই বোঝা যায়, দিনটি অন্যরকম। পুরনো ভবনের দেয়ালে লেগে থাকা শত বছরের গল্প যেন নতুন করে কথা বলে। পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে দিনের সূচনা হয়। সকাল ১১টায় জাতীয় সংগীতের সাথে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় শতবর্ষ উদযাপন। পরে শান্তির প্রতীক পায়রা উড়িয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন অতিথিরা।

লোকপ্রদর্শনীতে চোখে পড়ে সাদাকালো ছবি, পুরনো রেজাল্ট শিট, হারিয়ে যাওয়া খাতার পৃষ্ঠা। বন্ধুদের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই অনেকের মনে পড়ে যায় অতীতের স্মৃতির পাতাগুলো। কেউ ফিসফিস করে বলেন, “এই বেঞ্চেই বসতাম,” কেউ আবার মুঠোফোনের ক্যামেরায় বন্দি করেন নিজের কৈশোর।

দুপুর গড়াতেই বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ রূপ নেয় আবেগঘন মিলনমেলায়। বহু বছর পর প্রিয় শিক্ষকদের সামনে দাঁড়িয়ে অনেক প্রাক্তন শিক্ষার্থীর গলা কেঁপে ওঠে। চোখে জল নিয়ে কেউ বলেন, “স্যার, তখন আপনার শাসনে কষ্ট পেতাম, আজ বুঝি—সেটাই আমাকে মানুষ করেছে।” শিক্ষকদের মুখে তখন নীরব হাসি, চোখে গোপন গর্ব।

সেই শাসন—যা কখনো কঠোর, কখনো নিঃশব্দ—আজ অসংখ্য জীবনের ভিত শক্ত করেছে। প্রশাসন, চিকিৎসা, শিক্ষা, ব্যবসা, সাংবাদিকতা—সমাজের নানা স্তরে প্রতিষ্ঠিত প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা এক কণ্ঠে স্বীকার করেন, এই বিদ্যালয় তাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখিয়েছে।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম। শতবর্ষ উদযাপন কমিটির সভাপতি শেখ মো. আইয়ুবুর রহমানের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন জেলা প্রশাসক শারমিন আক্তার জাহান, প্রাক্তন ছাত্র এস এম শাহাজাদা খাদেম এবং বিদ্যালয়ের বর্তমান প্রধান শিক্ষক মো. আবুল কাশেম। এছাড়া সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে প্রধান অতিথি রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম জেলা প্রশাসককে সঙ্গে নিয়ে বিদ্যালয় মাঠে একটি বৃক্ষরোপণ করেন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি শতবর্ষ উদযাপন করায় আয়োজক কমিটি ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, “একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শতবর্ষ পূর্তি গৌরবের বিষয়। এই স্কুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে অসংখ্য ছাত্রছাত্রী আজ যোগ্য নাগরিক হিসেবে পরিবার, সমাজ ও দেশের সেবায় অবদান রাখছে।” তাঁর বাবা শিক্ষক ছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, “শিক্ষকদের সম্মান সবার উপরে।” তিনি শিক্ষকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

তিনি আরও বলেন, শতবর্ষ উদযাপনের মাধ্যমে দীর্ঘদিন পর পুরনো বন্ধুরা একে অপরের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেয়েছেন, যা অত্যন্ত আনন্দের ও স্মরণীয়।

অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রাক্তন ছাত্র লে. কর্নেল শামস ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নাজমূল হাসান রাফি। আলোচনা সভা শেষে শুরু হয় স্মৃতিচারণ পর্ব। দেশ-বিদেশ থেকে আগত প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা স্কুল জীবনের স্মৃতি ভাগাভাগি করেন। আবেগে জড়িয়ে ধরেন একে অপরকে, তোলেন ছবি—চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে আনন্দ ও উচ্ছ্বাস।

সবশেষে অনুষ্ঠিত হয় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। স্থানীয় ও আমন্ত্রিত শিল্পীদের পরিবেশনায় গান, নৃত্য ও আবৃত্তিতে মুখরিত হয়ে ওঠে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ।

উল্লেখ্য, ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ রেলওয়ে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় শতবর্ষ পেরিয়ে আজও শিক্ষা, শৃঙ্খলা ও মানবিক মূল্যবোধে আলোকিত মানুষ গড়ে চলেছে।

শতবর্ষের এই উদযাপন তাই শুধু উৎসব নয়—এটি ছিল কৃতজ্ঞতা জানানোর দিন, সেই ঋণ স্বীকারের দিন—যে ঋণ শোধ হয় না, কেবল প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বহন করা যায়।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow