বিজয়ের ইতিহাসে মানুষের শক্তি, প্রকৌশলীর ভূমিকা ও জাতীয়তাবাদী চেতনা

বাংলাদেশের বিজয় দিবস কেবল একটি ঐতিহাসিক তারিখ নয়; এটি একটি জাতির আত্মপরিচয় নির্মাণের চূড়ান্ত মুহূর্ত। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি অর্জন করেছিল তার বহু কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। এই বিজয় কোনো একক গোষ্ঠী বা শ্রেণির নয়—এটি ছিল আপামর জনগণের সম্মিলিত প্রতিরোধ, আত্মত্যাগ ও অদম্য জাতীয়তাবাদী চেতনার ফল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয়, এই যুদ্ধ কেবল সামরিক সংঘর্ষ ছিল না; এটি ছিল রাজনৈতিক সচেতনতা, সাংগঠনিক দক্ষতা, বুদ্ধিবৃত্তিক প্রস্তুতি এবং সাধারণ মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণের এক অনন্য উদাহরণ। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, প্রকৌশলী—সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষ এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন নিজ নিজ অবস্থান থেকে। মুক্তিযুদ্ধে প্রকৌশলীদের ভূমিকা ছিল বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ, যদিও তা অনেক সময় আলোচনার আড়ালে থেকে গেছে। প্রকৌশলীরা সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে যেমন অংশ নিয়েছেন, তেমনি মুক্তিবাহিনীর লজিস্টিক সাপোর্ট, অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ, অস্থায়ী সেতু নির্মাণ, যোগাযোগ ব্যবস্থা সচল রাখা, ক্যাম্প স্থাপন, বিদ্যুৎ ও পানির ব্যবস্থা নিশ্চিত

বিজয়ের ইতিহাসে মানুষের শক্তি, প্রকৌশলীর ভূমিকা ও জাতীয়তাবাদী চেতনা

বাংলাদেশের বিজয় দিবস কেবল একটি ঐতিহাসিক তারিখ নয়; এটি একটি জাতির আত্মপরিচয় নির্মাণের চূড়ান্ত মুহূর্ত। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি অর্জন করেছিল তার বহু কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। এই বিজয় কোনো একক গোষ্ঠী বা শ্রেণির নয়—এটি ছিল আপামর জনগণের সম্মিলিত প্রতিরোধ, আত্মত্যাগ ও অদম্য জাতীয়তাবাদী চেতনার ফল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয়, এই যুদ্ধ কেবল সামরিক সংঘর্ষ ছিল না; এটি ছিল রাজনৈতিক সচেতনতা, সাংগঠনিক দক্ষতা, বুদ্ধিবৃত্তিক প্রস্তুতি এবং সাধারণ মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণের এক অনন্য উদাহরণ। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, প্রকৌশলী—সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষ এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন নিজ নিজ অবস্থান থেকে।

মুক্তিযুদ্ধে প্রকৌশলীদের ভূমিকা ছিল বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ, যদিও তা অনেক সময় আলোচনার আড়ালে থেকে গেছে। প্রকৌশলীরা সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে যেমন অংশ নিয়েছেন, তেমনি মুক্তিবাহিনীর লজিস্টিক সাপোর্ট, অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ, অস্থায়ী সেতু নির্মাণ, যোগাযোগ ব্যবস্থা সচল রাখা, ক্যাম্প স্থাপন, বিদ্যুৎ ও পানির ব্যবস্থা নিশ্চিত করাসহ নানামুখী দায়িত্ব পালন করেছেন। যুদ্ধকালীন বাস্তবতায় প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও সমস্যার দ্রুত সমাধানের সক্ষমতা মুক্তিযুদ্ধকে কার্যকর ও গতিশীল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।

একইসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ মানুষদের ভূমিকা ছিল সংগ্রামের চালিকাশক্তি। ভাষা আন্দোলন থেকে যে জাতীয়তাবাদী চেতনার জন্ম, তা ১৯৭১ সালে এসে পরিণত হয়েছিল স্বাধীনতার অনিবার্য দাবিতে। এই চেতনা মানুষকে ভয় জয় করতে শিখিয়েছে, শোষণ ও দমননীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস দিয়েছে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক বৈষম্য, অর্থনৈতিক শোষণ ও সাংস্কৃতিক দমন নীতির বিরুদ্ধে এই জাতীয়তাবাদী চেতনাই বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক ছিল আপামর জনগণের অংশগ্রহণ। গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষ আশ্রয় দিয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের, খাবার জুগিয়েছে, খবর পৌঁছে দিয়েছে, ঝুঁকি নিয়ে সহযোগিতা করেছে। অসংখ্য নারী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন—কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দিয়ে, কেউ তথ্য দিয়ে, কেউ নির্যাতনের শিকার হয়ে। এই গণভিত্তিক যুদ্ধই মুক্তিযুদ্ধকে একটি সত্যিকারের জনগণের যুদ্ধে পরিণত করেছিল।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। একজন পেশাদার সেনা কর্মকর্তা হিসেবে তিনি মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেন এবং চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন, যা মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের মধ্যে সাহস ও দিকনির্দেশনা জুগিয়েছিল। পরবর্তীতে সেক্টর কমান্ডার হিসেবে তিনি সম্মুখসমরে নেতৃত্ব দেন এবং মুক্তিবাহিনীকে সংগঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাঁর নেতৃত্ব মুক্তিযুদ্ধের সামরিক কাঠামোকে আরও কার্যকর ও গতিশীল করেছিল।

তবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কোনো একক ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এই বিজয় এসেছে অসংখ্য শহীদ মুক্তিযোদ্ধার রক্তের বিনিময়ে, নির্যাতিত নারীর কান্না, উদ্বাস্তু মানুষের ত্যাগ এবং অগণিত মানুষের নীরব অবদানের মধ্য দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি সাফল্যের পেছনে ছিল সম্মিলিত প্রচেষ্টা, পারস্পরিক আস্থা ও জাতির জন্য আত্মনিবেদনের মানসিকতা।

বিজয়ের ৫ দশক পর আজ আমাদের সামনে প্রশ্ন—আমরা কি সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যথাযথভাবে ধারণ করতে পেরেছি? মুক্তিযুদ্ধ যে মানবিক, গণতান্ত্রিক ও ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছিল, তা বাস্তবায়নের সংগ্রাম এখনও চলমান। গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, আইনের শাসন, সামাজিক ন্যায়বিচার—এসব ক্ষেত্রেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলন অপরিহার্য।

একজন প্রকৌশলী হিসেবে আমি বিশ্বাস করি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কেবল স্মৃতিচারণে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। উন্নয়নকে হতে হবে মানুষকেন্দ্রিক, জ্ঞানভিত্তিক ও নৈতিকতায় সমৃদ্ধ। অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি মানবিক মূল্যবোধ ও জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রকৌশলীসহ সব পেশাজীবীর দায়িত্ব হলো রাষ্ট্র নির্মাণে পেশাগত দক্ষতার সঙ্গে নৈতিক দায়বদ্ধতাকে যুক্ত করা—যেমনটি মুক্তিযুদ্ধ আমাদের শিখিয়েছে।

বিজয় দিবস তাই শুধু উদ্‌যাপনের নয়; এটি আত্মসমালোচনা ও নতুন অঙ্গীকারের দিন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সব শ্রেণি-পেশার মানুষ, জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ নেতৃত্ব, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানসহ সকল মুক্তিযোদ্ধার অবদান স্মরণ করেই আমাদের সামনে এগোতে হবে।

বাংলাদেশের বিজয় তখনই অর্থবহ হবে, যখন এই দেশ হবে শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক ও মানবিক। সেই লক্ষ্যেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, সেই লক্ষ্যেই আত্মত্যাগ করেছিলেন লাখো মানুষ। বিজয় দিবসে এই সত্য স্মরণ করাই আমাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।

লিখেছেন- প্রকৌশলী শাহরিন ইসলাম তুহিন, আহ্বায়ক, এসোসিয়েশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ (এ্যাব)

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow