বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ৬০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করা হয়েছে। মঙ্গলবার (১৮ নভেম্বর) দিনব্যাপী আনন্দ শোভাযাত্রা, কেক কাটা, আলোচনা সভা ও স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করা হয়।
এদিন সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জিরো পয়েন্ট থেকে দিনব্যাপী কর্মসূচির উদ্বোধন করেন চবি উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শামিম উদ্দিন খান। এরপর জিরো পয়েন্ট থেকে আনন্দ শোভাযাত্রা শুরু হয়ে শহীদ মিনার, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ও জারুলতলা প্রদক্ষিণ শেষে প্রশাসনিক ভবনের সামনে এসে শেষ হয়। সকাল সাড়ে ১০টায় কেক কাটা হয় এবং বেলা ১১টায় শুরু হয় আলোচনা সভা ও স্মৃতিচারণ পর্ব। বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে চালু ছিল পরীক্ষা ও ক্লাস এবং হীরকজয়ন্তী উপলক্ষে রাখা হয়নি আলাদা কোনো আয়োজন।
আলোচনা সভায় শুরুতে কোরআন, গীতা, ত্রিপিটক ও বাইবেল থেকে পাঠ করা হয়। জুলাই মাসে শহীদ হওয়া শিক্ষার্থীদের স্মরণে ১ মিনিট নীরবতা পালন ও দোয়া করা হয়।
নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেনের সঞ্চালনায় চাকসু ভিপি ইব্রাহিম হোসেন রনি বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয় আজ এমন একপর্যায়ে এসেছে যেখানে শুরু হয়েছিল মাত্র ৪টি বিভাগ দিয়ে, এখন বিভাগ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৪। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে থাকা মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার কথা ছিল একটি পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু ৬০ বছর পার হলেও সেই লক্ষ্য পূরণ হয়নি।
তিনি আরও বলেন, আবাসিক হলগুলোতে মাত্র ৬৪০০ শিক্ষার্থীর থাকার ব্যবস্থা, অথচ হলের বাইরে প্রায় ২২ হাজার শিক্ষার্থী থাকতে বাধ্য হচ্ছেন যাদের অনেকেরই নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা নেই। আপনারা শিক্ষকরা কঠিন সময়েও পরিশ্রম করে বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে নিয়েছেন। আজ নীতিনির্ধারকের জায়গায় এসে যেন সেই বাস্তবতাকে বিবেচনায় রাখেন। গবেষণা খাতে ভর্তুকি বৃদ্ধি এখন সময়ের দাবি। আজকের এই অনুষ্ঠান আরও সম্প্রসারিত হতে পারত। আমাদের আকাঙ্ক্ষা হীরকজয়ন্তীর অনুষ্ঠান যেন দ্রুত আয়োজন করা হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব যথাযথভাবে উদযাপিত হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য এবং চাকসুর সাবেক ভিপি এস এম ফজলুল হক বলেন, ‘আজ বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। আমরা এমন একটি বিদ্যাপীঠ পেয়েছি যেখানে আনিসুর রহমান, আবু হেনা মোস্তফা, রশিদ চৌধুরী, অধ্যাপক ইউনূস, জামাল নজরুলের মতো মহান শিক্ষকরা ছিলেন। আমাদের সময়ে প্রশাসনের সাথে পরিবর্তনের জন্য অনেক কথা বলেছি, কিন্তু পারিনি—সময়ের সঙ্গে সমাজের বাস্তবতায় মিশে গিয়েছিলাম।কিন্তু ২০২৪ সালে যারা রক্ত দিয়েছেন, তাদের ত্যাগ আমাদের নতুন দিশা ও শক্তি দিয়েছে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. হোসেন শহীদ সরওয়ার্দী বলেন, দক্ষিণ–পূর্বের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ আজ ৬০ বছরে পদার্পণ করেছে। দেশের বৃহত্তম ক্যাম্পাস ও শাটল ট্রেন এটি শুধু যাতায়াতের মাধ্যম নয়, আমাদের আবেগের অংশ। প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে এই বিশ্ববিদ্যালয় জড়িত। জুলাইতে আমাদের দুজন শহিদ হয়েছেন যা স্মরণ করিয়ে দেয়, এই বিদ্যাপীঠের অগ্রগতি ও লড়াই পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত। ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর নানা সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক কিছু বাস্তবায়িত হয়নি, তবে ভবিষ্যতে সহযোগিতার মাধ্যমে আমরা অবশ্যই এসব সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠব।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) অধ্যাপক ড. শামীম উদ্দিন বলেন, যারা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার অবদান রেখেছেন তাদের আমরা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। আমি মনে করি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক অর্জন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে খেতনামা শিক্ষক গবেষণা, বিজ্ঞানী। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় আরও এগিয়ে যেতে পারত আমাদের এই বিশ্ববিদ্যালয় চলে সরকারের ফান্ড-এ। আমরা সব সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে অনেক কম বাজেট পেয়েছি অবহেলিত হয়ে আসছি। এটা না হলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি আরও ভিন্ন হতে পারত।
তিনি আরও বলেন, ৭১ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে স্বাধীন হওয়া দেশগুলোর সমপর্যায়ে এখনো যেতে পারেনি। আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা আমাদের এলামনায়রা এই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কোনো চিন্তাভাবনা করেনা। আমি তাদের বলবো তারা যেন এই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে চিন্তা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের যেন আবাসিক হল নির্মাণে সহযোগিতা করে। আমি বলতে চায় আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর আমরা বেশকিছু সংস্কারমূলক কাজ হাতে নিয়েছি যার ফল পাওয়া যাবে ৪/৫ বছর পর। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী সবাইকে বিশ্বমানের হতে হবে তবেই এই বিশ্ববিদ্যালয় উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হবে। আমরা মনে করি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতির আলোকবর্তীকা হিসেবে কাজ করবে।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) দেশের পঞ্চম সরকারি ও একটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়। আয়তনের দিক থেকে এটি দেশের সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলায় স্থাপিত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পূর্বে এই বিশ্ববিদ্যালয় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল। সেই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছিল।