ভূমিকম্পে কম ঝুঁকিপূর্ণ ঢাকার উত্তরাঞ্চল, বেশি ঝুঁকিতে দক্ষিণ
বিগত কয়েকদিন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় একাধিক ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। সবশেষ বৃহস্পতিবার (২৭ নভেম্বর) বিকেল ৪টা ১৫ মিনিট ৪৭ সেকেন্ডে ৩ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এটির উৎপত্তিস্থল নরসিংদীর ঘোড়াশাল। একইদিন দিনগত রাত ৩টা ৩০ মিনিট ৪৯ সেকেন্ডে সিলেটে ৩ দশমিক ৪ মাত্রায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়, যার উৎপত্তিস্থল ভারতের মণিপুর অঞ্চল। এর আগে শুক্রবার (২১ নভেম্বর) দেশে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প অনুভূত হয়। নরসিংদীর মাধবদীতে উৎপত্তি ওই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৭। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এসব ভূমিকম্পের বিষয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মুসতাক আহমেদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের শাবিপ্রবির প্রতিবেদক এসএইচ জাহিদ। জাগো নিউজ: কয়েক দশকের মধ্যে দেশে সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন? এর কারণ কী হতে পারে? অধ্যাপক মুসতাক: হঠাৎ বড় ধরনের ভূমিকম্পের কোনো ব্যাখ্যা নেই। পূর্বের ভূমিকম্পের ধারাবাহিকতা থেকে বোঝা যায়, এক থেকে দেড়শ বছর পরপর বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়ে থাকে। ১৭৬২
বিগত কয়েকদিন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় একাধিক ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। সবশেষ বৃহস্পতিবার (২৭ নভেম্বর) বিকেল ৪টা ১৫ মিনিট ৪৭ সেকেন্ডে ৩ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এটির উৎপত্তিস্থল নরসিংদীর ঘোড়াশাল। একইদিন দিনগত রাত ৩টা ৩০ মিনিট ৪৯ সেকেন্ডে সিলেটে ৩ দশমিক ৪ মাত্রায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়, যার উৎপত্তিস্থল ভারতের মণিপুর অঞ্চল।
এর আগে শুক্রবার (২১ নভেম্বর) দেশে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প অনুভূত হয়। নরসিংদীর মাধবদীতে উৎপত্তি ওই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৭।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এসব ভূমিকম্পের বিষয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মুসতাক আহমেদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের শাবিপ্রবির প্রতিবেদক এসএইচ জাহিদ।
জাগো নিউজ: কয়েক দশকের মধ্যে দেশে সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন? এর কারণ কী হতে পারে?
অধ্যাপক মুসতাক: হঠাৎ বড় ধরনের ভূমিকম্পের কোনো ব্যাখ্যা নেই। পূর্বের ভূমিকম্পের ধারাবাহিকতা থেকে বোঝা যায়, এক থেকে দেড়শ বছর পরপর বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়ে থাকে। ১৭৬২, ১৮৯৭ ও ১৯১৮ সালে আমরা বড় ভূমিকম্প দেখতে পেয়েছি। তারই ধারাবাহিকতায় বড় ভূমিকম্পের এটা একটি পূর্বাভাস হতে পারে।
জাগো নিউজ: সম্প্রতি চারটি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলই নরসিংদী ও ঢাকায়। বিষয়টি আমাদের দেশের জন্য কী বার্তা দিচ্ছে?
অধ্যাপক মুসতাক: সম্প্রতি বড় ভূমিকম্পটি মধুপুর ফল্টে হয়েছে বলে ধারণা করা হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, কক্সবাজার, নোয়াখালী থেকে নরসিংদী হয়ে সিলেটের দিকে বিস্তৃত যে ফল্টটি রয়েছে সেটি সক্রিয় হয়েছে। দুটি ফল্ট কাছাকাছি, বিষয়টি নিয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন। মধুপুর ফল্ট নিয়ে সবশেষ ১৯৮৭ সালে যমুনা সেতু হওয়ার সময় একটি গবেষণা হয়েছিল। অধ্যাপক বোল্টের করা ওই প্রতিবেদনে মধুপুর ফল্ট নিয়ে বলা হয়, এটি থেকে বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে।
ঢাকা বর্তমানে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। এত ঘনবসতিপূর্ণ একটি এলাকায় ভূমিকম্প হলে অনেক বড় ধরনের ক্ষতি হবে। এছাড়া রাজধানীতে গড়ে ওঠা ভবনগুলোর কোয়ালিটি নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। ঢাকার উত্তরাঞ্চলের মাটি ভালো, সেখানে কম ঝুঁকি রয়েছে। তবে দক্ষিণাঞ্চলের মাটি ভরাট করে ভবন গড়ে তোলা হয়েছে, যা এই অঞ্চলকে তুলনামূলকভাবে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।
জাগো নিউজ: ভূমিকম্পের মাত্রা ৫ দশমিক ৭ বেশি হলে কী ধরনের ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
অধ্যাপক মুসতাক: এটার একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা রয়েছে। ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে নরসিংদীতে। তাই সেখানে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেশি। এটিতে সিলেটের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। কারণ সিলেট উৎপত্তিস্থল থেকে দূরে। সুতরাং, মাত্রার সঙ্গে সঙ্গে কোন জায়গায় এটি হয়েছে, সেখানকার মাটি কেমন, ভবনগুলোর মান কেমন—সেগুলোও গুরুত্বপূর্ণ। ভূমিকম্পের মাত্রা রিখটার স্কেলে ১ বাড়লে ঝাঁকুনি বাড়ে ১০ গুণ আর এনার্জি রিলিজ হয় ৩১ গুণ বেশি। তাই ৬ মাত্রায় ভূমিকম্প হলে সেটির ভয়াবহতা অনেক বেশি থাকবে।
জাগো নিউজ: অনেকে বলছেন, আফটারশক (পরাঘাত) ইতিবাচক। বিষয়টির যৌক্তিকতা কী?
অধ্যাপক মুসতাক: পূর্বে ছোট ছোট ভূমিকম্প হলে সেটিকে আমরা ইতিবাচক হিসেবে ধরতে পারি। কারণ এতে বড় ভূমিকম্পের শক্তি কিছুটা কমতে পারে। আফটারশক (পরাঘাত) বড়-ছোট হতে পারে, এজন্য আমাদের আরও সতর্ক থাকা উচিত। তবে বড় ভূমিকম্পের পর আফটারশক সাধারণত ছোট হয়ে থাকে।
জাগো নিউজ: সিলেট অঞ্চল ভূমিকম্পের কতটুকু ঝুঁকিতে রয়েছে? এই অঞ্চলের অবকাঠামো কতটুকু ভূমিকম্প-সহনীয়?
অধ্যাপক মুসতাক: সিলেটের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ডাউকি ফল্ট। এটি সিলেটের সীমান্ত ঘেঁষে মেঘালয়ে অবস্থান করছে। এছাড়া সিলেট ফল্ট, শাওজিবাজার ফল্ট ও কপিলি ফল্ট সিলেটে বা এর কাছাকাছি জায়গায় অবস্থিত। সেগুলো থেকে ভূমিকম্প হতে পারে।
সিলেটের বা আমাদের দেশের ছোট ভবনগুলো ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে করা হয় না, এটি মালিক কোনো রাজমিস্ত্রির দ্বারা করিয়ে নেন। মালিকরা ভাবেন ছোট ভবনগুলো কম ঝুঁকিপূর্ণ, এটি একটি ভুল ধারণা। বড় বিল্ডিংয়ের ক্ষেত্রে অনেক সময় ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে করালেও মালিকরা বোঝেন না কাদের কাছে যাওয়া উচিত। ফলে ভবনের ডিজাইন করার জন্য স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারের কাছে না গিয়ে যে কোনো ইঞ্জিনিয়ারের কাছে যান। সিলেটে এই বিষয়টি বেশি হচ্ছে। যার ফলে আমি মনে করি ডিজাইনের বিষয়টি ভালোভাবে হচ্ছে না। সিলেট শহরে ভবন তোলার অনুমতি দেওয়া হয় সিটি করপোরেশন থেকে। তাদের উচিত স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারদের কাছ থেকে সার্টিফিকেট আনার পর ভবন তোলার অনুমতি দেওয়া। সিটি করপোরেশন চাইলে বিষয়টি সহজেই করতে পারবে। বিল্ডিং চেকের পাশাপাশি কনস্ট্রাকশনের সময় মনিটরিং করা জরুরি। পুরোনো বিল্ডিংগুলোও চেক করানো দরকার।
জাগো নিউজ: শাবিপ্রবির ভবনগুলো কতটুকু ভূমিকম্প-সহনীয়? নতুন ভবনগুলোর নির্মাণের সময় কোন বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে?
অধ্যাপক মুসতাক: শাবিপ্রবির পুরোনো ভবনগুলোর মধ্যে শিক্ষাভবন-এ ও ইউসি ভবন বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। এগুলো নিয়ে আমি রিপোর্টও দিয়েছি। প্রশাসনের উচিত এগুলোর সংস্কার করা। নতুন ভবনগুলোর কাজ সঠিকভাবে নিয়ম মেনে করা হচ্ছে কি-না বিষয়টি মাল্টিপল ওয়েতে দেখা উচিত। এটা হতে পারে সংশ্লিষ্ট ইঞ্জিনিয়ারের দ্বারা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বেশি বেশি মনিটরিং করে।
জাগো নিউজ: ভবিষ্যতে সিলেট বা বাংলাদেশে ভূমিকম্পের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে কি-না?
অধ্যাপক মুসতাক: গত কয়েক বছরের ভূমিকম্প সেটাই ইঙ্গিত করছে। আমাদের দেশে ফল্টের সংখ্যা অনেক বেশি। তিনটি প্লেট বাউন্ডারি আমাদের কাছাকাছি। এগুলো হলো ইউরেশিয়ান, ইন্ডিয়ান ও বার্মা প্লেট; যাদের সংযোগস্থল আমাদের খুব কাছাকাছি এবং যেগুলোর ফাটল সক্রিয় রয়েছে। সেখান থেকে ভূমিকম্প বৃদ্ধি পেতে পারে।
জাগো নিউজ: ভূমিকম্প থেকে বাঁচতে বা ক্ষয়ক্ষতি রোধে আমাদের করণীয় কী কী হতে পারে?
অধ্যাপক মুসতাক: মানুষের সচেতন হতে হবে। বর্তমান ভবনগুলোর অবস্থা নিয়ে একটি সমীক্ষা করতে হবে ও ক্ষতিকর ভবনগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোনটি ভাঙতে হবে, কোনটি সংস্কার প্রয়োজন আর কোনটি ক্ষতিকর নয় এগুলো আলাদা করা। একটি অরাজনৈতিক প্রেসার গ্রুপ থাকা উচিত, যারা সচেতনতামূলক কাজ করবেন। এছাড়া বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে তোলা, যারা দুর্যোগপূর্ণ সময়ে কাজ করতে পারবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে এটি হতে পারে। সরকারের উচিত তাদেরকে ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে দুর্যোগের সময়োপযোগী সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। এছাড়া আইনের প্রয়োগও জরুরি।
জাগো নিউজ: আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
অধ্যাপক মুসতাক: জাগো নিউজকেও ধন্যবাদ।
এসএইচ জাহিদ/এসআর/জিকেএস
What's Your Reaction?