ভূমিকম্পে ঢাকার কোন এলাকা নিরাপদ?

টাঙ্গাইলের মধুপুর ফল্টে ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকা শহরের ৪০ শতাংশ ভবন ধসে পড়তে পারে এবং দুই লাখের বেশি মানুষের মৃত্যুর শঙ্কা রয়েছে। গেলো সপ্তাহে কয়েক দফা ভূমিকম্প হওয়ার পর রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) নিজেই জানিয়েছে এমন তথ্য। প্রশ্ন উঠছে, ঢাকায় তাহলে কোন এলাকা নিরাপদ? কয়েক দফায় ভূমিকম্প এবং অধিবাংশের উৎপত্তিস্থল ঢাকার কাছে হওয়ায় উদ্বিগ্ন নগরবাসী। বিশেষ করে ঘনবসতিপূর্ণ এবং বিধিমালা অমান্য করে তৈরি বহুতল ভবনের ভিড়ে নিরাপদ জায়গা কোথাও আছে কি না, সেটা নিয়ে প্রশ্ন অনেকের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার ভূতাত্ত্বিক গঠন ও ফল্ট লাইনের অবস্থান দুর্যোগ মোকাবিলায় অনুকূলে থাকলেও ভবন নির্মাণে অনিয়ম, ভরাট জমির প্রসার এবং অত্যধিক জনসংখ্যা শহরটিকে এক জটিল সমীকরণের মুখে দাঁড় করিয়েছে। আরও পড়ুন:ভূমিকম্পে কম ঝুঁকিপূর্ণ ঢাকার উত্তরাঞ্চল, বেশি ঝুঁকিতে দক্ষিণ সবশেষ বৃহস্পতিবার (২৭ নভেম্বর) বিকেল ৪টা ১৫ মিনিট ৪৭ সেকেন্ডে ৩ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এটির উৎপত্তিস্থল নরসিংদীর ঘোড়াশাল। একইদিন দিনগত রাত ৩টা ৩০ মিনিট ৪৯ সেকেন্ডে সিলেটে ৩ দশমিক ৪ মাত্রায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়, যার উৎপত্তিস্থল ভারতের মণিপুর অঞ

ভূমিকম্পে ঢাকার কোন এলাকা নিরাপদ?

টাঙ্গাইলের মধুপুর ফল্টে ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকা শহরের ৪০ শতাংশ ভবন ধসে পড়তে পারে এবং দুই লাখের বেশি মানুষের মৃত্যুর শঙ্কা রয়েছে। গেলো সপ্তাহে কয়েক দফা ভূমিকম্প হওয়ার পর রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) নিজেই জানিয়েছে এমন তথ্য। প্রশ্ন উঠছে, ঢাকায় তাহলে কোন এলাকা নিরাপদ?

কয়েক দফায় ভূমিকম্প এবং অধিবাংশের উৎপত্তিস্থল ঢাকার কাছে হওয়ায় উদ্বিগ্ন নগরবাসী। বিশেষ করে ঘনবসতিপূর্ণ এবং বিধিমালা অমান্য করে তৈরি বহুতল ভবনের ভিড়ে নিরাপদ জায়গা কোথাও আছে কি না, সেটা নিয়ে প্রশ্ন অনেকের।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার ভূতাত্ত্বিক গঠন ও ফল্ট লাইনের অবস্থান দুর্যোগ মোকাবিলায় অনুকূলে থাকলেও ভবন নির্মাণে অনিয়ম, ভরাট জমির প্রসার এবং অত্যধিক জনসংখ্যা শহরটিকে এক জটিল সমীকরণের মুখে দাঁড় করিয়েছে।

আরও পড়ুন:
ভূমিকম্পে কম ঝুঁকিপূর্ণ ঢাকার উত্তরাঞ্চল, বেশি ঝুঁকিতে দক্ষিণ

সবশেষ বৃহস্পতিবার (২৭ নভেম্বর) বিকেল ৪টা ১৫ মিনিট ৪৭ সেকেন্ডে ৩ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এটির উৎপত্তিস্থল নরসিংদীর ঘোড়াশাল। একইদিন দিনগত রাত ৩টা ৩০ মিনিট ৪৯ সেকেন্ডে সিলেটে ৩ দশমিক ৪ মাত্রায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়, যার উৎপত্তিস্থল ভারতের মণিপুর অঞ্চল।

এর আগে শুক্রবার (২১ নভেম্বর) দেশে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প অনুভূত হয়। নরসিংদীর মাধবদীতে উৎপত্তি ওই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৭।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মুসতাক আহমেদ জাগো নিউজকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ঢাকা বর্তমানে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। এত ঘনবসতিপূর্ণ একটি এলাকায় ভূমিকম্প হলে অনেক বড় ধরনের ক্ষতি হবে। এছাড়া রাজধানীতে গড়ে ওঠা ভবনগুলোর কোয়ালিটি নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। ঢাকার উত্তরাঞ্চলের মাটি ভালো, সেখানে কম ঝুঁকি রয়েছে। তবে দক্ষিণাঞ্চলের মাটি ভরাট করে ভবন গড়ে তোলা হয়েছে, যা এই অঞ্চলকে তুলনামূলকভাবে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।

 

তবে কোন এলাকা কতটুকু নিরাপদ তা বুঝতে হলে দুটি দিকে নজর দিতে হবে বলছেন বিশেষজ্ঞরা। শহরের ভূতাত্ত্বিক গঠন ও অবকাঠামো।

ভূতত্ত্ববিদ সৈয়দ হুমায়ুন আখতার ভূতাত্ত্বিক বিষয়টি নিয়ে বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘ঢাকা ও এর আশেপাশের এলাকার ভূতাত্ত্বিক গঠন প্রায় একই। বেশিরভাগ অংশ, বিশেষ করে উত্তর দিকের মাটি মধুপুরের লাল মাটি। যেটি বেশ শক্ত। কিন্তু মোঘল আমল থেকে শুরু করে ব্রিটিশ পিরিয়ড, পাকিস্তান আমল এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে উত্তর দিকে এবং বুড়িগঙ্গা নদীকে কেন্দ্র করে শহর খুব দ্রুত সম্প্রসারিত হয়। তখন এই লাল মাটি অকুপাইড হয়ে যায়। এরপর শহর বাড়তে শুরু করে পূর্ব-পশ্চিমে। সেখানে নরম পলিমাটি এবং জলাশয় ছিল যা ভরাট করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘শুধু যদি ভূতাত্ত্বিক গঠন বিবেচনা করা হয়, তাহলে মধুপুরের লাল মাটির একই গড়নের যেসব এলাকা রয়েছে যেমন রমনা, মগবাজার, নিউমার্কেট, লালমাটিয়া, খিলগাঁও, মতিঝিল, ধানমন্ডি, লালবাগ, মিরপুর, গুলশান, তেজগাঁও ইত্যাদি এলাকা তুলনামূলকভাবে নিরাপদ। কিন্তু শুধু ভূতাত্ত্বিক গঠনের ওপর ঢাকার বাসিন্দাদের নিরাপত্তা নির্ভর করছে না।’

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘ঢাকার কোন এলাকা নিরাপদ, কোনটি নয়- এটা বলা মুশকিল। যতক্ষণ না ভবনগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে, ততক্ষণ বলা যাবে না কোনটা ঝুঁকিপূর্ণ বা ঝুঁকিমুক্ত।’

লাল মাটির এলাকায় ভবন, তাও কেন ঝুঁকিপূর্ণ?

শক্ত মাটির এলাকাও পুরোপুরি নিরাপদ নয়। এর প্রথম কারণ, সেইসব এলাকায় বহু পুরোনো ভবন রয়েছে যেগুলো সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি। পর্যবেক্ষণের অভাবে সেগুলোও এখন অনিরাপদ। আরও একটি কারণ হলো, সেসব এলাকায় এমন ভবন আছে যেগুলোর অনুমোদন ছিল হয়তো দুই বা তিন তলার জন্য, কিন্তু পরে সেগুলো বহুতলে রূপান্তরিত হয়েছে। ফাউন্ডেশন দুই তলার, কিন্তু দাঁড়িয়ে আছে সাত তলা। এগুলো অননুমোদিত এবং ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া নতুন যেসব ভবন তৈরি হচ্ছে তাতে করা হচ্ছে অনিয়ম, ব্যবহার করা হচ্ছে নিম্ন মানের কাঁচামাল। তাতে ভবনগুলো ভূমিকম্প সহনীয় হিসেবে তৈরিই হচ্ছে না।

ঢাকার ৯০ শতাংশ ভবন বিল্ডিং কোডের ব্যত্যয় ঘটিয়েছে বলে রাজউকের পরিসংখ্যানের কথা সম্প্রতি উল্লেখ করেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।

ভরাট করা জায়গায় ভবন মানে কি অনিরাপদ?

‘ঢাকার বিভিন্ন দিকে ডোবা ও জলাশয় ভরাট করে কিছু এলাকা গড়ে উঠেছে। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, আফতাবনগর এরকম প্রকল্প তৈরি হচ্ছে। মধুপুরের লাল মাটির মতো প্রাকৃতিকভাবে শক্ত মাটি নেই এখানে। তাই এ ধরনের এলকায় ভবন তৈরির আগে সেখানকার মাটি বহুতল ভবন ধরে রাখার মতো সক্ষমতায় প্রস্তুত করে নিতে হবে’, বলছেন আনসারী।

মেক্সিকোর সান হুয়ানিকো শহরের একটি উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘এই শহরটি চারদিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা। মাঝে গামলার মতো শহরটি ৪০-৫০ মিটার মাটি দিয়ে ভরাট করা এবং সেখানেই গড়ে উঠেছিল নগর। ১৯৮৫ সালে সেখানে আট দশমিক এক মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয় এবং ৭০ শতাংশ ভবন ধসে পড়ে মারা যায় ১৫ হাজারের কাছাকাছি মানুষ।’

গবেষণায় উঠে আসে, ‘সেখানকার মাটি ভরাট করার সময় মানা হয়নি গ্রাউন্ড ইম্প্রুভমেন্ট টেকনিক। আনসারী বলেন, এরকম জায়গায় যদি মাটিকে দুর্মুজ না করা হয় বা প্রস্তুত না করা হয়, যেটাকে গ্রাউন্ড ইম্প্রুভমেন্ট টেকনিক বলে, এটি যদি না করা হয় ভবন বেশি দুলে উঠবে এবং ভেঙে পড়বে। মানুষ এখন পাইল করেই বিল্ডিং তৈরি করে ফেলছে। কিন্তু তিনি বলেন, পাইলও দিতে হবে, মাটিকেও প্রস্তুত করতে হবে। এমনটা যদি না করা হয়, তখন দূরে উৎপন্ন ভূমিকম্প হলেও মাটির কম্পন আর ভবনের কম্পন মিলে ভবন ধরে পড়ার শঙ্কা থাকে। আর কাছে উৎপন্ন ভূমিকম্প হলে তো কথাই নেই।’

এসএনআর/এমএস

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow