ভূমিকম্প দেখিয়ে দেয়-মানুষ দুর্বল, আর লোভ আরও দুর্বলতর

আবুল কালাম আজাদ, যুক্তরাষ্ট্র একবার ভাবুন-একটি ভয়াবহ ভূমিকম্প। সেকেন্ডের ভেতর গোটা শহর দুলে উঠলো, আকাশছোঁয়া ভবনগুলো কাগজের ঘরের মতো ভেঙে পড়লো, রাস্তা উধাও হয়ে গেলো, আলো নিভে গেলো, শব্দ থেমে গেলো, আর চারদিকে শুধু ধ্বংসস্তূপ, ধুলো আর কান্না। অত শক্তিশালী কংক্রিট, স্টিল, মানব-গর্বের প্রতীক অট্টালিকা—সবই মুহূর্তে মাটির সমান হয়ে গেলো। এ দৃশ্য বাস্তবে পৃথিবীর বহু দেশে ঘটেছে, আবার আজ বা আগামীকালও ঘটতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই ধ্বংসের মাঝে মানুষের অহংকার কোথায় দাঁড়ায়? আর যে অবৈধ সম্পদ অর্জনের জন্য কেউ জীবনভর অন্যায় করেছে, অধিকার হরণ করেছে, ঘুষ খেয়েছে—সেই সম্পদের মূল্য তখন কতটা? প্রকৃতির একটি ঝাঁকুনিই মানুষকে দেখিয়ে দেয় তার প্রকৃত অবস্থান। মানুষের অহংকার এমন এক ভঙ্গুর দেয়াল, যা মানবশক্তি দিয়ে উঁচু করা সম্ভব হলেও প্রকৃতির সামনে টিকিয়ে রাখা যায় না। আমরা অট্টালিকা গড়ি, রাজপ্রাসাদ বানাই, সম্পদের পাহাড় সাজাই—ভাবি, এগুলো আমাদের অমরত্বের চিহ্ন হয়ে থাকবে। কিন্তু ইতিহাস বলে, সব প্রাসাদই ধ্বংস হয়, সব সাম্রাজ্যই ভেঙে পড়ে, সব অহংকারই মাটির মাঝে মিশে যায়। ভয়াবহ ভূমিকম্পের কথা চিন্তা করুন। যখন মানুষ জীবন ব

ভূমিকম্প দেখিয়ে দেয়-মানুষ দুর্বল, আর লোভ আরও দুর্বলতর

আবুল কালাম আজাদ, যুক্তরাষ্ট্র

একবার ভাবুন-একটি ভয়াবহ ভূমিকম্প। সেকেন্ডের ভেতর গোটা শহর দুলে উঠলো, আকাশছোঁয়া ভবনগুলো কাগজের ঘরের মতো ভেঙে পড়লো, রাস্তা উধাও হয়ে গেলো, আলো নিভে গেলো, শব্দ থেমে গেলো, আর চারদিকে শুধু ধ্বংসস্তূপ, ধুলো আর কান্না। অত শক্তিশালী কংক্রিট, স্টিল, মানব-গর্বের প্রতীক অট্টালিকা—সবই মুহূর্তে মাটির সমান হয়ে গেলো।

এ দৃশ্য বাস্তবে পৃথিবীর বহু দেশে ঘটেছে, আবার আজ বা আগামীকালও ঘটতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই ধ্বংসের মাঝে মানুষের অহংকার কোথায় দাঁড়ায়? আর যে অবৈধ সম্পদ অর্জনের জন্য কেউ জীবনভর অন্যায় করেছে, অধিকার হরণ করেছে, ঘুষ খেয়েছে—সেই সম্পদের মূল্য তখন কতটা?

প্রকৃতির একটি ঝাঁকুনিই মানুষকে দেখিয়ে দেয় তার প্রকৃত অবস্থান। মানুষের অহংকার এমন এক ভঙ্গুর দেয়াল, যা মানবশক্তি দিয়ে উঁচু করা সম্ভব হলেও প্রকৃতির সামনে টিকিয়ে রাখা যায় না। আমরা অট্টালিকা গড়ি, রাজপ্রাসাদ বানাই, সম্পদের পাহাড় সাজাই—ভাবি, এগুলো আমাদের অমরত্বের চিহ্ন হয়ে থাকবে। কিন্তু ইতিহাস বলে, সব প্রাসাদই ধ্বংস হয়, সব সাম্রাজ্যই ভেঙে পড়ে, সব অহংকারই মাটির মাঝে মিশে যায়।

ভয়াবহ ভূমিকম্পের কথা চিন্তা করুন। যখন মানুষ জীবন বাঁচাতে ছুটছে, তখন তার ব্যাংকে থাকা কোটি কোটি টাকা কোনো কাজে আসে না। সিন্দুকে রাখা সোনাদানা কারো জীবন ফেরাতে পারে না। বিদেশে পাঠানো দুর্নীতির টাকা আপনাকে উদ্ধার করতে ছুটে আসে না। তখন প্রয়োজন শুধু একটি নিরাপদ জায়গা, একটি গ্লাস পানি, আর মানুষের সাহায্য। অথচ মানুষের কত লোভ, কত অহংকার—অন্যায় করে, দুর্নীতি করে, মানুষের অধিকার খেয়ে, দুঃখ দিয়ে সম্পদ জমা করে যায়, যেন এগুলো দিয়ে অনন্তকাল বেঁচে থাকবে। কিন্তু প্রকৃতি এক সেকেন্ডেই সেই বিভ্রম ভেঙে দেয়।

কুরআনের আয়াতগুলো ঠিক এই বাস্তবতাই স্মরণ করিয়ে দেয়: ‘যখন পৃথিবী তার চূড়ান্ত কম্পনে প্রকম্পিত হবে।’ এই এক বাক্যই যথেষ্ট মানুষকে জাগিয়ে দেওয়ার জন্য। পৃথিবী কাঁপবে, এমনভাবে কাঁপবে যে মানুষের ভাষায় তা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। যে মাটি হাজার বছরে একবারও নড়ে না, সেই মাটিই এমনভাবে কাঁপবে যে মানুষ দাঁড়াতে পারবে না। এটিই হবে সেই দিন—যেদিন মানবসভ্যতার সব অহংকার মাটিতে মিশে যাবে।

আয়াতে বলা হয়েছে— ‘যখন ভূগর্ভ তার বোঝাসমূহ বের করে দেবে।’ আজ মানুষ তার কোটি টাকা লুকাতে ভূগর্ভে ভল্ট বানায়, সিন্দুক বানায়, টানেল বানায়। আবার পৃথিবীও মানুষের পাপের বোঝা বহন করে—অন্যায়, জুলুম, খুন, ধর্ষণ, দুর্নীতি, প্রতারণা—যেন পৃথিবী সবই দেখে কিন্তু নীরব থাকে। কিন্তু কিয়ামতের দিনে পৃথিবী আর নীরব থাকবে না। সে তার সব বৃত্তান্ত প্রকাশ করবে। পৃথিবীর প্রতিটি ধূলিকণাও সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়াবে মানুষের কাজের ওপর।

আজ মানুষ মনে করে, দুর্নীতি করলে কেউ দেখে না। ক্ষমতার দাপটে অন্যায় করলে কেউ টের পায় না। ঘুষ খেয়ে ভবন বানালে বা অসহায় মানুষের হক মেরে বড় গাড়ি কিনলে যেন কিছুই হবে না। কিন্তু কুরআন বলছে— ‘সেদিন পৃথিবী তার সকল বৃত্তান্ত বর্ণনা করবে।’

মানুষ যা করেছে—লুকিয়ে, গোপনে, রাতে, দিনে—সবই পৃথিবী বলে দেবে। সে দিন কোনো অস্বীকার থাকবে না, কোনো অজুহাত থাকবে না।

তবে এই আয়াতগুলো শুধুই পরকালীন বিচার নিয়ে নয়; এগুলো মানুষকে দুনিয়ার জীবনেও সতর্ক করে। প্রকৃতির কোনো বড় বিপর্যয় যেন এই আয়াতগুলোর বাস্তব ঝলক দেখিয়ে দেয়। ভূমিকম্প কিয়ামত নয়, কিন্তু কিয়ামতের আগমনী বার্তা। ভূমিকম্প মানুষকে মনে করিয়ে দেয়—মানুষ দুর্বল, তার নির্মাণ দুর্বল, তার শক্তি আল্লাহর ক্ষমতার সামনে কিছুই নয়।

একটি ভূমিকম্পের পর যা ঘটে, তা অত্যন্ত কষ্টের:
হাসপাতাল ভেঙে পড়ে, স্কুল ধসে যায়, মানুষ পরিবার হারায়, পানির লাইনের ভাঙনে রোগ ছড়ায়, খাবারের সংকট দেখা দেয়, স্বজনের মরদেহ খুঁজে পাওয়া যায় না, শহর অচল হয়ে যায়। তখন রাষ্ট্র, সরকার, ধনী-গরিব—সবাই সমান। তখন ধনী মানুষটিও ভিক্ষুকের মতো সামান্য পানির জন্য হাত পাততে বাধ্য হয়।

এই বাস্তবতা মানুষকে বলে দেয়—
যে অহংকার তুমি বুক ফুলিয়ে প্রদর্শন করেছিলে,
যার জন্য মানুষকে অবজ্ঞা করেছিলে,
যার জন্য অন্যায় করেছিলে,
সেই অহংকারের কি মূল্য রইল?

অবৈধ সম্পদের প্রশ্নটি এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ অবৈধ উপায়ে সম্পদ জমায় কেন? কারণ সে মনে করে এই সম্পদ তাকে নিরাপত্তা দেবে, সুখ দেবে, মর্যাদা দেবে। অথচ সংকটমুহূর্তে এই সম্পদ তার কোনো কাজে আসে না। মানুষ তখন শুধু বাঁচতে চায়। একজন ধনী দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি সে সময়ও একই লাইনে দাঁড়ায়, যেখানে দরিদ্র মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে। তখন পরিচয় বদলে যায়—সবাই ‘মানুষ’, আর সম্পদের অহংকার হয়ে যায় এক তুচ্ছ ব্যঙ্গ।

প্রকৃতির সামনে সব মানুষ সমান। প্রকৃতি কোনো দুর্নীতিবাজকে বিশেষ ছাড় দেয় না, কোনো ক্ষমতাবানকে আলাদা করে রক্ষা করে না। বরং অনেক সময় সেই ক্ষমতার প্রতীক ভবনগুলোই আগে ভেঙে পড়ে—কারণ সেগুলো নির্মাণে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি, দুর্বলতা এবং অনিয়ম থাকে। তাই ভূমিকম্প শুধু ধ্বংস নয়—এ একটি বিচার প্রক্রিয়া, একটি সতর্ক সংকেত, একটি দৃষ্টান্ত যা

মানুষকে বলে দেয়—‘তুমি যা পাপ করেছো, সে সবের হিসাব একদিন এই পৃথিবীই তোমার সামনে তুলে ধরবে।’

এই ভাবনা মানুষকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। এ যেন মানুষের আত্মার দোরগোড়ায় ধাক্কা দিয়ে বলে—
জীবন একটি অস্থায়ী সফর।
অহংকারের জায়গা নেই।
সম্পদের লোভের জায়গা নেই।
মানুষ হয়ে মানুষের ক্ষতি করার জায়গা নেই।
কারণ একদিন এই পৃথিবীতেই হিসাব শুরু হবে, তারপর পরকালে আরও বড় হিসাব।

আজকের বিশ্বে মানুষ দুর্নীতি, লোভ, ক্ষমতা, অহংকারের নেশায় অন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একটি ভূমিকম্প, একটি সাইক্লোন, একটি মহামারি—মুহূর্তেই দেখিয়ে দেয় মানুষ অসম্ভব দুর্বল, নির্ভরশীল এবং ক্ষণস্থায়ী। মানুষ যতক্ষণ না বুঝতে শিখবে যে নৈতিকতা ছাড়া সম্পদ অর্থহীন, ততক্ষণ সমাজে শান্তি আসবে না।

ধ্বংসস্তূপের ভেতর একজন বেঁচে থাকা মানুষ যখন তার সন্তানকে খুঁজে বেড়ায়, তখন তার মনে পড়ে না বিলাসবহুল গাড়ি, ব্যাংকের টাকা বা জমির দলিলের কথা। তখন শুধু একটি জিনিস মনে পড়ে—মানুষের ভালোবাসার মূল্য।

মানুষ যদি বুঝে—
অহংকার তাকে বড় করে না,
সম্পদ তাকে শ্রেষ্ঠ করে না,
বরং সৎকর্ম, ন্যায়পরায়ণতা, মানবিকতা—এসবই আসল সম্পদ,
তাহলে এই পৃথিবী আরও সুন্দর, শান্তিপূর্ণ হয়ে উঠবে।

প্রকৃতি মানুষকে বারবার পরীক্ষা নেয়, বারবার দেখিয়ে দেয়—
মানুষ ক্ষুদ্র,
মানুষ অক্ষম,
মানুষ ভঙ্গুর।

তাই লোভে পাপ, পাপে বিপর্যয়—এ সত্যকে স্বীকার করাই মানুষের মুক্তির পথ। জীবন ক্ষণস্থায়ী, আর সেই ক্ষণস্থায়ী জীবনে অন্যায়ের মাধ্যমে সম্পদ সংগ্রহ করে কি লাভ? এক মুহূর্তের কম্পনেই তো সব শেষ হয়ে যেতে পারে।

শেষ পর্যন্ত মানুষকে এই সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়—
ধ্বসে পড়া ভবনই বলে দেয়,
কোনো সম্পদই স্থায়ী নয়,
কোনো অহংকারই চিরদিনের নয়,
যা টিকে থাকে, তা হলো সৎকর্ম, মানবিকতা ও আল্লাহর ভয়।

সেদিন পৃথিবী কথা বলবে,
সেদিন মানুষের মুখ বন্ধ হয়ে যাবে,
সেদিন হিসাব হবে নিখুঁত।
আজকের মানুষ নিজেকে যদি জাগাতে পারে, তবে এই সতর্কবার্তা তার জীবনের জন্যই কল্যাণকর হবে।

আবুল কালাম আজাদ
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ও কলামিষ্ট
[email protected]

এমআরএম/এমএস

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow