মাথায় গুলি লাগার পরও যেভাবে বেঁচে ফিরেছিলেন মালালা

মাথার এক পাশ ভেদ করে গুলি, মুহূর্তেই নিথর পুরো শরীর— চিকিৎসকদের ভাষায় এটি ছিল প্রায় অসম্ভব পরিস্থিতি। তবুও বেঁচে গেছেন মালালা ইউসুফজাই। শুধু বেঁচেই যাননি, পরবর্তী সময়ে হয়ে উঠেছেন নারী শিক্ষার পক্ষে বৈশ্বিক আন্দোলনের অন্যতম পরিচিত মুখ। যেভাবে গুলিবিদ্ধ হন ২০১২ সালের ৯ অক্টোবর। আর দশটা দিনের মতোই বন্ধুদের সঙ্গে বাসে করে স্কুলে গিয়েছিলেন ১৫ বছর বয়সী মালালা। স্কুল থেকে ফেরার পথে পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের সোয়াত উপত্যকায় তার ওপর হামলা চালায় তালেবান। বাসে উঠে এক বন্দুকধারী খুব কাছ থেকে মালালার মাথায় গুলি করে। গুলিটি ঢুকে কানের পাশ দিয়ে মস্তিষ্কের কাছাকাছি অংশ ক্ষতিগ্রস্ত করে। অবস্থা এতটাই গুরুতর ছিল যে, প্রথম কয়েক ঘণ্টা তাঁকে বাঁচিয়ে রাখা নিয়েই সংশয় ছিল। হামলায় তার দুই বান্ধবী কাইনাত রিয়াজ এবং শাজিয়া রমজানও আহত হন। হামলার পর মালালাকে দ্রুত পেশাওয়ারের একটি সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রথম ৭২ ঘণ্টা: জীবন-মৃত্যুর লড়াই হাসপাতালে পৌঁছানোর পর মালালার অবস্থা ছিল অত্যন্ত সংকটাপন্ন। তৎক্ষণাৎ সেনা নিউরোসার্জন কর্নেল জুনায়েদ খান তাকে পরীক্ষা করে দেখেন, অবস্থা অস্থিতিশীল। চার ঘণ্টা পর ম

মাথায় গুলি লাগার পরও যেভাবে বেঁচে ফিরেছিলেন মালালা

মাথার এক পাশ ভেদ করে গুলি, মুহূর্তেই নিথর পুরো শরীর— চিকিৎসকদের ভাষায় এটি ছিল প্রায় অসম্ভব পরিস্থিতি। তবুও বেঁচে গেছেন মালালা ইউসুফজাই। শুধু বেঁচেই যাননি, পরবর্তী সময়ে হয়ে উঠেছেন নারী শিক্ষার পক্ষে বৈশ্বিক আন্দোলনের অন্যতম পরিচিত মুখ।

যেভাবে গুলিবিদ্ধ হন

২০১২ সালের ৯ অক্টোবর। আর দশটা দিনের মতোই বন্ধুদের সঙ্গে বাসে করে স্কুলে গিয়েছিলেন ১৫ বছর বয়সী মালালা। স্কুল থেকে ফেরার পথে পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের সোয়াত উপত্যকায় তার ওপর হামলা চালায় তালেবান। বাসে উঠে এক বন্দুকধারী খুব কাছ থেকে মালালার মাথায় গুলি করে। গুলিটি ঢুকে কানের পাশ দিয়ে মস্তিষ্কের কাছাকাছি অংশ ক্ষতিগ্রস্ত করে। অবস্থা এতটাই গুরুতর ছিল যে, প্রথম কয়েক ঘণ্টা তাঁকে বাঁচিয়ে রাখা নিয়েই সংশয় ছিল।

হামলায় তার দুই বান্ধবী কাইনাত রিয়াজ এবং শাজিয়া রমজানও আহত হন। হামলার পর মালালাকে দ্রুত পেশাওয়ারের একটি সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

প্রথম ৭২ ঘণ্টা: জীবন-মৃত্যুর লড়াই

হাসপাতালে পৌঁছানোর পর মালালার অবস্থা ছিল অত্যন্ত সংকটাপন্ন। তৎক্ষণাৎ সেনা নিউরোসার্জন কর্নেল জুনায়েদ খান তাকে পরীক্ষা করে দেখেন, অবস্থা অস্থিতিশীল। চার ঘণ্টা পর মস্তিষ্কে ফোলা বেড়ে যাওয়ায় তার অবস্থা আরও খারাপ হয়। এসময় জরুরি অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেন নিউরোসার্জন।

কিন্তু মালালার পরিবার প্রথমে রাজি হয়নি। জুনায়েদ খানের বয়স তুলনামূলক কম থাকায় তারা তার ওপর ভরসা করতে পারছিলেন না। পরিবর্তে কোনো বেসামরিক চিকিৎসককে দেখাতে বা দুবাইয়ে স্থানান্তর করতে চেয়েছিল মালালার পরিবার।

আরও পড়ুন>>
ইনকিলাব মঞ্চের ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ
ওসমান হাদির অবস্থা এখনো অত্যন্ত আশঙ্কাজনক: মেডিকেল বোর্ড
প্রয়োজনে চিকিৎসার জন্য হাদিকে বিদেশে নেওয়া হবে: প্রধান উপদেষ্টা

কিন্তু চিকিৎসক জুনায়েদ খান মালালার বাবাকে বোঝান, অস্ত্রোপচার না হলে সে মারা যেতে পারে অথবা কথা বলার ক্ষমতা হারাতে পারে বা ডান হাত-পা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হতে পারে।

শেষ পর্যন্ত মধ্যরাতের পর মালালার অস্ত্রোপচার শুরু হয়। অস্ত্রোপচার করে খুলির একটি অংশ সরানো হয়, মস্তিষ্ক থেকে রক্ত জমা সরানো হয় এবং তাকে ভেন্টিলেটরে রাখা হয়। এই অস্ত্রোপচার মস্তিষ্কের চাপ কমিয়ে প্রাথমিকভাবে তার জীবন বাঁচায়।

malala
মালালা ইউসুফজাই/ ছবি: মালালা ফান্ড

কিন্তু পরের দিন ইনফেকশন এবং অরগান ফেলিওর দেখা দেয়। মালালাকে তখন ‘মেডিক্যালি ইন্ডিউসড কোমা’য় রাখা হয় এবং তার বেঁচে ওঠা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

এমন সময় পাকিস্তানের তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল আশফাক পারভেজ কায়ানি ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগ নেন এবং তাকে বিদেশে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করেন।

ইংল্যান্ডের নিবিড় পরিচর্যা বিশেষজ্ঞ জাভিদ কায়ানি এবং ফিওনা রেনল্ডস সৌভাগ্যবশত ওই সময় পাকিস্তানেই ছিলেন। তারাও মালালার চিকিৎসায় যোগ দেন। তাদের মতে, নিউরোসার্জন জুনায়েদ খানের দৃঢ় ভূমিকা না থাকলে মালালাকে হয়তো আর বাঁচানো যেতো না।

পরে মালালাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে যুক্তরাজ্যের কুইন এলিজাবেথ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এই হাসপাতালটি যুদ্ধের ময়দানে আহত ব্রিটিশ সৈন্যদের চিকিৎসা ও ট্রমা কেয়ারের জন্য বিশ্বখ্যাত। এরপর সেখানেই শুরু হয় তার দীর্ঘ চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের অধ্যায়।

যেভাবে সেরে উঠলেন মালালা

চিকিৎসকদের মতে, মালালার বেঁচে যাওয়ার পেছনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল-

প্রথমত, গুলিটি মস্তিষ্কের সেই অংশে সরাসরি আঘাত করেনি, যা জীবনধারণের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
দ্বিতীয়ত, দ্রুত চিকিৎসা ও সঠিক সময়ে অস্ত্রোপচার তাঁর জীবন বাঁচাতে বড় ভূমিকা রাখে।
তৃতীয়ত, সংক্রমণ ঠেকাতে নিবিড় পরিচর্যা ও আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার কার্যকর প্রয়োগ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বার্মিংহামে পরীক্ষায় দেখা যায়, মালালার কোনো মেজর নিউরোলজিক্যাল ড্যামেজ হয়নি।

এখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের একটি দল মালালার আরোগ্যলাভে প্রধান ভূমিকা পালন করে। বেশ কয়েকটি ধাপে তার চিকিৎসা সম্পন্ন হয়:

  • মুখের পুনর্গঠনমূলক অস্ত্রোপচার: বুলেট তার মুখের হাড় ও স্নায়ুতে যে ক্ষতি করেছিল, তা সারিয়ে তুলতে প্লাস্টিক সার্জারি করা হয়।
  • ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট: গুলির আঘাতে তার কানের পর্দা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় শ্রবণশক্তি কমে গিয়েছিল, যা ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্টের মাধ্যমে ঠিক করা হয়।
  • টাইটেনিয়াম প্লেট স্থাপন: পেশোয়ারে খোলা মাথার খুলির অংশটির পরিবর্তে একটি কাস্টম-মেড (আলাদাভাবে তৈরি) টাইটানিয়াম প্লেট স্থাপন করে তার মাথা পুনর্গঠন করা হয়।

কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মালালা হাঁটতে, লিখতে, পড়তে এবং হাসতে শুরু করেন। প্রথমে ট্র্যাকিওটমির কারণে কথা বলতে পারেননি, কিন্তু কাগজে লিখে যোগাযোগ করেন। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয় এবং তিনি তার পরিবারের সঙ্গে অস্থায়ী বাসায় রিহ্যাবিলিটেশন চালিয়ে যান।

malala
মালালা ইউসুফজাই/ ছবি: মালালা ফান্ড

মানসিক শক্তি ও ফিরে আসা

শারীরিক চিকিৎসার পাশাপাশি মালালার প্রবল মানসিক শক্তি এবং বাঁচার অদম্য ইচ্ছাশক্তিও তাকে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। চিকিৎসকরা তার এই মানসিক দৃঢ়তার কথা বারবার উল্লেখ করেছেন।

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর, দীর্ঘ সময় ধরে ফিজিওথেরাপি এবং কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন।

চিকিৎসকদের মতে, যদিও আঘাতটি ছিল প্রাণঘাতী, সময়মতো সঠিক চিকিৎসা এবং মালালার শারীরিক প্রতিরোধ ক্ষমতার কারণেই তিনি মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসতে পেরেছেন।

গুলি খেয়েও অদম্য মালালা

এমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হওয়ার পরও মালালা থেমে যাননি। বরং তার কণ্ঠ আরও জোরালো হয়ে ওঠে। মেয়েদের শিক্ষার অধিকারের পক্ষে বিশ্বজুড়ে আন্দোলন শুরু করেন তিনি। পরবর্তী সময়ে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান মালালা ইউসুফজাই, যা তাকে করে ‍তোলে বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ নোবেলজয়ীদের একজন।

মালালা নিজে বলেছেন, তালেবানের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসার ঘটনা তাকে আরও শক্তিশালী করেছে।

তার এই ঘটনা বিশ্বজুড়ে চিকিৎসা বিজ্ঞান ও মানব জীবনের অদম্য ইচ্ছাশক্তির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে।

সূত্র: সিএনএন, এবিসি নিউজ, এনবিসি নিউজ, উইকিপিডিয়া
কেএএ/

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow