রক্তপলাশের ভোর

১৯৭১ সাল। অগ্রহায়ণের হাড়কাঁপানো শীত। কুয়াশার চাদরে মুড়ে আছে উত্তরের জনপদ। রাত গভীর। কৃষ্ণপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম পলাশডাঙ্গার শিমুলতলী বাঁকের কাছে নিঃশ্বাস বন্ধ করে শুয়ে আছে একদল মুক্তিযোদ্ধা। তাদের শরীরে কাদা মাখা, পরনে লুঙ্গি আর মলিন শার্ট কিন্তু চোখে আগ্নেয়গিরির লাভা। দলের নেতৃত্বে আছেন বাসেত। এককালের তুখোড় ফুটবলার বাসেত এখন দুর্দান্ত গেরিলা। তার পাশে শুয়ে থাকা কিশোর যোদ্ধা রতন ফিসফিস করে বলল, ‌‘ভাই, ওরা কি আজই যাবে?’বাসেত আকাশের দিকে তাকাল। অমাবস্যার অন্ধকার। নিচু গলায় বলল, ‘ইনফরমার খবর দিয়েছে, আজ রাতেই ওরা পালানোর চেষ্টা করবে। সদর থেকে ওদের ক্যাম্প গুটিয়ে ফেলার অর্ডার এসেছে। কিন্তু আমাদের কসম, এই নরপশুদের একটাও জ্যান্ত ফিরতে দেব না।’বাসেতের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল গত আষাঢ় মাসের সেই ভয়াবহ স্মৃতি। কৃষ্ণপুর সদরের বড়বাড়ি মাদ্রাসায় ক্যাম্প বসিয়েছিল হানাদাররা। সেখান থেকে ওরা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল পুরো তল্লাটে। সেই দুঃস্বপ্নের কথা মনে পড়লে আজও বাসেতের রক্ত হিম হয়ে আসে। সদরের অদূরে কাজলা নদীর ওপর পুরোনো লোহার ব্রিজ- পাথরঘাটা ব্রিজ। যুদ্ধের আগে এই ব্রিজে বি

রক্তপলাশের ভোর

১৯৭১ সাল। অগ্রহায়ণের হাড়কাঁপানো শীত। কুয়াশার চাদরে মুড়ে আছে উত্তরের জনপদ। রাত গভীর। কৃষ্ণপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম পলাশডাঙ্গার শিমুলতলী বাঁকের কাছে নিঃশ্বাস বন্ধ করে শুয়ে আছে একদল মুক্তিযোদ্ধা। তাদের শরীরে কাদা মাখা, পরনে লুঙ্গি আর মলিন শার্ট কিন্তু চোখে আগ্নেয়গিরির লাভা।

দলের নেতৃত্বে আছেন বাসেত। এককালের তুখোড় ফুটবলার বাসেত এখন দুর্দান্ত গেরিলা। তার পাশে শুয়ে থাকা কিশোর যোদ্ধা রতন ফিসফিস করে বলল, ‌‘ভাই, ওরা কি আজই যাবে?’
বাসেত আকাশের দিকে তাকাল। অমাবস্যার অন্ধকার। নিচু গলায় বলল, ‘ইনফরমার খবর দিয়েছে, আজ রাতেই ওরা পালানোর চেষ্টা করবে। সদর থেকে ওদের ক্যাম্প গুটিয়ে ফেলার অর্ডার এসেছে। কিন্তু আমাদের কসম, এই নরপশুদের একটাও জ্যান্ত ফিরতে দেব না।’
বাসেতের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল গত আষাঢ় মাসের সেই ভয়াবহ স্মৃতি। কৃষ্ণপুর সদরের বড়বাড়ি মাদ্রাসায় ক্যাম্প বসিয়েছিল হানাদাররা। সেখান থেকে ওরা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল পুরো তল্লাটে।

সেই দুঃস্বপ্নের কথা মনে পড়লে আজও বাসেতের রক্ত হিম হয়ে আসে। সদরের অদূরে কাজলা নদীর ওপর পুরোনো লোহার ব্রিজ- পাথরঘাটা ব্রিজ। যুদ্ধের আগে এই ব্রিজে বিকেলে হাওয়া খেতে যেত মানুষ। যুদ্ধের সময় এই ব্রিজ হয়ে উঠেছিল মরণকূপ।

বাসেতের মনে পড়ে সেই অভিশপ্ত দুপুরের কথা। রাজাকার আর আলবদরদের সহায়তায় গ্রাম থেকে ট্রাকভর্তি করে নিরীহ মানুষদের ধরে আনা হয়েছিল পাথরঘাটা ব্রিজে। লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার। তারপর একে একে লাশগুলো ফেলে দেওয়া হয়েছিল কাজলা নদীর ঘোলা জলে। বাসেত সেদিন ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে দেখেছিল সেই দৃশ্য। নদীর পানি মুহূর্তেই লাল হয়ে গিয়েছিল। সেদিন ওরা তেরো জন তাজা প্রাণকে হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিল। সেই তেরো জনের একজন ছিল বাসেতের ছোট ভাই, স্কুলছাত্র দিপু। দিপুর অপরাধ ছিল, সে জয় বাংলা স্লোগান দিয়েছিল।

সেই থেকে কাজলা নদীর স্রোতে আর কেউ মাছ ধরে না। ওটা এখন রক্তের নদী। পাথরঘাটা ব্রিজের সেই আর্তনাদ বাসেতকে প্রতি রাতে জাগিয়ে রাখে। আজ সেই প্রতিশোধ নেওয়ার রাত।

রাত তিনটা বেজে পনেরো। দূরে ভারী ইঞ্জিনের শব্দ। বাসেত সংকেত দিলো। সবাই নড়েচড়ে বসল। রাস্তার দুপাশে জঙ্গলের ভেতর ওৎ পেতে আছে তারা। বাসেতের হাতে চাইনিজ এলএমজি। বাকিদের হাতে থ্রি-নট-থ্রি আর গ্রেনেড। কনভয়টা এগিয়ে আসছে। সামনে একটা জিপ, পেছনে দুটো বড় ট্রাক। হেডলাইট নেভানো কিন্তু ইঞ্জিনের গর্জন আর চাকার শব্দে বোঝা যাচ্ছে ওরা বেপরোয়া। ওরা পালাচ্ছে। পেছনে ফেলে যাচ্ছে ধংসস্তূপ আর লাশের পাহাড়।

জিপটা শিমুলতলী বাঁক ঘুরতেই বাসেত চিৎকার করে উঠল, ‘ফায়ার!’
মুহূর্তের মধ্যে নিস্তব্ধ রাত বিদীর্ণ করে গর্জে উঠল এলএমজি। প্রথম আঘাতেই জিপের চালক লুটিয়ে পড়ল। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে জিপটা রাস্তার পাশের খাদে উল্টে গেল। পেছনের ট্রাকগুলো ব্রেক কষে থামতেই চারপাশ থেকে বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে শুরু করল মুক্তিযোদ্ধারা।

হানাদার বাহিনী এমন অতর্কিত আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। তারা ট্রাক থেকে লাফিয়ে নেমে পজিশন নেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু অন্ধকারে তারা তখন অন্ধ, আর মুক্তিযোদ্ধারা এই মাটির প্রতিটি ধূলিকণা চেনে।

আরও পড়ুন
ফারজানা অনন্যার গল্প: নরকের গান 
অলোক আচার্যের দুটি অনুগল্প 

শুরু হলো সম্মুখযুদ্ধ। কৃষ্ণপুরের লাল মাটি আজ আবার রক্ত চাইছে, তবে তা শহীদের নয়, শত্রুর। রতন গ্রেনেড ছুড়ে মারল মাঝখানের ট্রাকে। বিকট শব্দে আগুন জ্বলে উঠল। আগুনের আলোয় দেখা গেল হানাদারদের পলায়নপর ছায়া।

‘ধর! একটাও যেন না পালায়!’ বাসেতের কণ্ঠে বাঘের গর্জন।
প্রায় ঘণ্টাখানেক চলল গুলি বিনিময়। একসময় সব শান্ত হয়ে গেল। ট্রাকের আগুন তখনো জ্বলছে। হানাদারদের যারা বেঁচে ছিল, তারা অন্ধকারের সুযোগে পেছনের বিলের দিকে পালিয়ে গেছে। অধিকাংশই লুটিয়ে পড়েছে কৃষ্ণপুরের মাটিতে।

ভোরের আজান ভেসে আসছে দূরের মসজিদ থেকে। পুব আকাশ ফর্সা হয়ে আসছে। বাসেত টিলা থেকে রাস্তায় নেমে এলো। তার শরীর ধুলো আর বারুদে মাখামাখি। সে পাথরঘাটা ব্রিজের দিকে মুখ করে দাঁড়াল। এখান থেকে ব্রিজটা দেখা যায় না কিন্তু বাসেত অনুভব করতে পারছে।

৮ ডিসেম্বর। কৃষ্ণপুর মুক্ত। গ্রামের মানুষ ভয়ে ভয়ে বের হতে শুরু করেছে। যখন তারা দেখল রাস্তায় পড়ে আছে হানাদারদের লাশ। তাদের ছেলেরা বিজয়ের হাসি হাসছে; তখন আনন্দের বাঁধ ভাঙল। বাসেত দেখল, এক বৃদ্ধা মা দৌড়ে এসে রতনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন।

বাসেত আকাশের দিকে তাকাল। কুয়াশা কেটে রোদ উঠছে। কাজলা নদীর ওপর এখন হয়তো ভোরের আলো পড়েছে। সেই আলোয় আর রক্তের দাগ নেই, আছে মুক্তির ঝিলিক।

পাথরঘাটা ব্রিজের ওপর দিয়ে আজ আর মৃত্যুর ট্রাক যাবে না। আজ থেকে এই পথ, এই নদী, এই মাটি সব স্বাধীন। বাসেত বিড়বিড় করে বলল, ‘দিপু, দেখ ভাই, আমরা ওদের শেষ করেছি। তোর রক্ত বৃথা যায়নি। কৃষ্ণপুর আজ মুক্ত।’

বাতাসে তখন শীতের তীব্রতা থাকলেও সবার বুকে উষ্ণ প্রশান্তি। পতপত করে উড়তে থাকা লাল-সবুজ পতাকার দিকে তাকিয়ে বাসেত বুঝল, এই ভোরের জন্যই তারা জীবন বাজি রেখেছিল।

এসইউ

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow