‘রঙিন’ জীবনের করুণ সমাপ্তি

4 days ago 9

রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া যৌনপল্লিতে প্রায় দেড় হাজার যৌনকর্মী রয়েছেন। তাদের শিশুসন্তান রয়েছে ৬০০’র মতো। চরম বৈষম্য, অনাদর-অবহেলা ও নির্যাতনে বড় হয় এই শিশুরা। শিক্ষা থেকে বঞ্চিত অনেক শিশু জড়িয়ে পড়ে মাদকে, নয়তো মায়ের পেশায়। যৌনপল্লির শিশুদের সমস্যা ও দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে জাগো নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ইয়াসির আরাফাত রিপনের চার পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে শেষ পর্ব

প্রায় প্রতিটি মানুষেরই তরুণ বয়সে থাকে জৌলুস। থাকে শখ-আহ্লাদসহ বড় কিছু করার প্রবল ইচ্ছা। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আগের সেই জৌলুস হারাতে থাকে। একটা সময়ে হতাশায় গ্রাস করে, খেই হারিয়ে ফেলে মানুষ।
একই ধরনের চিত্র রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া যৌনপল্লির। একটা সময় এখানকার যে কর্মী খদ্দের টানতে সারিবদ্ধ লাইনে কিংবা নিজ ঘরের সামনে আকর্ষণীয়ভাবে নিজেকে মেলে ধরেছেন, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভয়াবহ চিত্র ফুটে ওঠে।

ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত মেলামেশায় সন্তান গর্ভধারণ করেন অনেকেই। মেলে না খদ্দের, অর্থ উপার্জন বন্ধ হওয়ায় কাজ নেন বিভিন্ন দোকান বা খাবার হোটেলে। দুই মুঠো ভাত জোগাতে কিংবা ওষুধ কিনতে ঋণ করতে বাধ্য হন অনেকে। ঋণ পরিশোধে নিজ সন্তানকে বিক্রির ঘটনাও রয়েছে পল্লিতে। দু-একটি সফলতার গল্প থাকলে প্রায় শতভাগ কর্মীকে শেষ বয়সে বেছে নিতে হয় ভিক্ষাবৃত্তি। সেখানেও রয়েছে নানাজনের কটূকথা। সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর পর্যাপ্ত তহবিল না থাকায় ‘রঙিন’ জীবনের শেষ পরিণত হয় খুবই মর্মান্তিক। সম্প্রতি জাগো নিউজের অনুসন্ধানে এসব চিত্র উঠে এসেছে।

‘আমাদের জীবনটাই এমন। একটা সময় রঙিন হয়তো, শেষ সময় ভিক্ষার ঝুলি। আমার সমবয়সী যারা ছিল তাদের সবার আমার মতো অবস্থা হয়েছে।’-ফিরোজা বেগম (ছদ্মনাম)

শেষ বয়সে ভিক্ষাবৃত্তি
দৌলতদিয়া ফেরিঘাট এলাকায় কথা হয় রাজিয়ার (ছদ্মনাম) সঙ্গে। বয়স তার পঞ্চাশ পেরিয়েছে। এক সময়ে দুই হাতে টাকা-পয়সা রোজগার করেছেন যৌনপল্লি থেকে। একটা সময় অসুস্থতার কারণে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে তার। খদ্দের না থাকায় জমানো টাকায় চলেছে খাবার-দাবার। একটা সময় মোটা তাজাকরণ ওষুধ খেয়ে নিজেকে আর্কষণীয় রেখেছেন, কিছুদিন খদ্দেরও পেয়েছেন। তবে তা স্থায়ী হয়নি। এখন তার মূল পেশা ভিক্ষাবৃত্তি।
রাজিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘একটা সময় পেছনের দিকে তাকাইনি, ভবিষ্যতের চিন্তাও করিনি। টাকা আয় করেছি, খেয়েছি। বাবুকে (প্রেমিক) চালিয়েছি সেই টাকায়। এখন টাকা নেই, কোনো বাবুও আমার নেই। খদ্দের না পাওয়ায় কোনো আয়ও নেই। কিন্তু পেট তো থেমে থাকেনি, তাকে খাবার দিতেই হবে। নিজেও বিড়ি-সিগারেট খাই, এসবের টাকা কই পাবো? তাই ইচ্ছা না থাকলেও বাধ্য হয়েছি ভিক্ষা করতে। এখন ঘাট এলাকায় ঘুরি, যা আয় হয় দিন চলে যায়। পরের দিনের জন্য আবার বেরিয়ে পড়ি।’

একই অবস্থা ফিরোজা বেগমের (ছদ্মনাম)। এক সময় দাপটের সঙ্গে চলেছেন পল্লিতে, খদ্দেরের অভাব হয়নি তার। শেষ বয়সে তিনিও ভিক্ষাকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন।

ফিরোজা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের জীবনটাই এমন। একটা সময় রঙিন হয়তো, শেষ সময় ভিক্ষার ঝুলি। আমার সমবয়সী যারা ছিল তাদের সবার আমার মতো অবস্থা হয়েছে।’

কেন এই অবস্থা? সঞ্চয়ের টাকা কী করলেন? জবাবে ফিরোজা বলেন, ‘আমার দুই মেয়েকে বড় করেছি। তারা কিছুটা (প্রাইমারি পর্যন্ত) লেখাপড়া করেছে। এরপর তারাও পেশায় ফিরেছে। তাদের টাকায় আমি চলেছি, ভর নিয়েছি। পরে তারা বাবু জোগাড় করেছে, টাকা আমাকে না দিয়ে সব টাকা দেয় বাবুকে। একটা মেয়েকে নিঃস্ব করে বাবুরা টাকা নিয়ে যান, ভালোবাসে স্বার্থের জন্য।’

‘ছোট থেকেই মেয়েদের পড়াশোনার পাশাপাশি নানা ধরনের কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা চেষ্টা করছি এটা করার। আমরা চাই না আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এ পেশায় থাকুক। কিন্তু অর্থের অভাবে এটা হয়ে উঠছে না।’- অসহায় মহিলা ও শিশু উন্নয়ন সংস্থার সভানেত্রী ফরিদা পারভীন

প্রয়োজন প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা
দৌলতদিয়া যৌনপল্লিতে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও নিরাপদ বাসস্থান নিয়ে কাজ করছে সামাজিক সংগঠন পায়াক্ট বংলাদেশ, কর্মজীবী কল্যাণ সংস্থা, গণস্বাস্থ্য, শাপলা, মুক্তি মহিলা সমিতি, অসহায় মহিলা ও শিশু উন্নয়ন সংস্থা, অসহায় নারী ঐক্য সংগঠন ও হাব বাংলাদেশ। তারা পল্লির নারী ও শিশুদের মাঝেমধ্যে আর্থিক ও ত্রাণ সহায়তা দিলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই কম। সরকারি ও বেসরকারি সহায়তা পেলেই নারীদের শেষ বয়সটা ভালো কাটানো সম্ভব বলে জানিয়েছেন সমাজকর্মীরা।

যৌনকর্মী, স্থানীয় বাড়ির মালিক ও এনজিও সূত্র বলছে, দৌলতদিয়া যৌনপল্লিতে বর্তমানে প্রায় দেড় হাজার যৌনকর্মী রয়েছেন। আর অবসরপ্রাপ্ত যৌনকর্মী প্রায় ২০০ জন। মায়ের হাত ধরে এ পেশায় রয়েছেন প্রায় ৩৫০ জন। পল্লিতে ১৮ বছর বয়সের নিচে বা শিশু যৌনকর্মী রয়েছে ২০ জনের মতো। পল্লি এলাকায় বাড়ি রয়েছে ২৮০টি, আর শিশু সন্তান রয়েছে ৬০০’র মতো।

স্থানীয় সাংবাদিক ও সমাজকর্মী শেখ রাজিব জাগো নিউজকে বলেন, ‘পল্লির মেয়েদের সব টাকা-পয়সা বাবুরা নিয়ে যাচ্ছেন, মেয়েদের নিঃস্ব করে দিচ্ছেন। টাকা-পয়সা, আয় কমে গেলে বাবুরা অন্য মেয়ে ধরেন অথবা শিশু মেয়েদের আবারও মায়ের পেশায় নামিয়ে দেন। এটা করেন টাকার লোভে। একটা সময় বাবুরা তাদের (মা-মেয়ে) ছেড়ে চলে যান। এটা নিয়ে যৌনকর্মীদের সচেতন করা হলেও তারা কারও কথা শোনেন না। বেসরকারি সংস্থাগুলো কাজ করছে, তবে ভালো ফলাফল আসছে না।’

পল্লিতে আর্থিক সুবিধা প্রদান ও সচেতনতামূলক কাজ করছে অসহায় মহিলা ও শিশু উন্নয়ন সংস্থা। এটি যৌনকর্মীদের নিজস্ব সংস্থা। এর সভানেত্রী ফরিদা পারভীন জাগো নিউজকে বলেন, ‘ছোট থেকেই মেয়েদের পড়াশোনার পাশাপাশি নানা ধরনের কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা চেষ্টা করছি এটা করার। আমরা চাই না আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এ পেশায় থাকুক। কিন্তু অর্থের অভাবে এটা হয়ে উঠছে না। কিছু সংস্থার মাধ্যমে সহযোগিতা পেলেও তা খুবই সামান্য। আবার সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করলে এখানকার নারীদের খাবার ও টাকার ব্যবস্থা করতে হবে। এটা না করলে কাজ ফেলে তারা আসতে চান না। তবে এসবের জন্য অর্থের প্রয়োজন, যেটা আমাদের নেই।’

‘একজন নারী এইচআইডি আক্রান্ত হলে অনেক মানুষ এতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। অন্তঃসত্ত্বা হলে অনাগত সন্তানও সমস্যায় পড়ে। এজন্য তার চিকিৎসা করতে হয়।’-জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী

এইডস হওয়া সত্ত্বেও যৌন পেশায়
যৌনপল্লির ৩৭ বছর বয়সী এক নারীর এইচআইভি পজিটিভ ধরা পড়েছে। এরপর বেসরকারি সংস্থা ‘পায়াক্ট বাংলাদেশ’র সহযোগিতায় রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই নারীর চিকিৎসার সব খরচ বহন করা হচ্ছিল। কিন্তু বার বার ঢাকায় গিয়ে ওই নারী আর চিকিৎসা করাতে চান না। এ নিয়ে সচেতন করা হলেও সামাজিক সংগঠনগুলোর কথা শুনছেন না তিনি। আড়ালে থেকে খদ্দেরের সঙ্গে মেলামেশা করছেন।
অসহায় মহিলা ও শিশু উন্নয়ন সংস্থার সভানেত্রী ফরিদা পারভীন বলেন, ‘আমরা তাকে বার বার বোঝাচ্ছি। তার কাছে যাচ্ছি, যতটুকু পারা যায় সহায়তা দিচ্ছি। কিন্তু আমাদের এখানেও কোনো সহায়তা সেভাবে পাচ্ছি না। পাশাপাশি পল্লির মেয়েদের ফ্রি স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হচ্ছে।’

‘পায়াক্ট বাংলাদেশ’র দৌলতদিয়া ঘাট শাখার ম্যানেজার মজিবুর রহমান জুয়েল জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা মেয়েটিকে অনেক বুঝিয়ে ঢাকায় বেশ কয়েকবার নিয়েছি। তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু তিনি এখন যোগাযোগ করছেন না, আমরা যোগাযোগ করলেও আসছেন না। এ অবস্থার মধ্যেও মেয়েটির যৌন পেশায় থাকাটা খুবই ভয়াবহ। আমরা চেষ্টা করছি তাকে নিরাপদে সরিয়ে চিকিৎসা করাতে। এটা ব্যয়বহুল হলেও এক্ষেত্রে সমাজ, সরকার ও বিভিন্ন সংস্থাকে এগিয়ে আসতে হবে।’

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘যৌনপল্লি যৌনবাহিত রোগের জন্য বিপজ্জনক। এজন্য কর্মীদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। কোনো দেশে এ পল্লি অনুমোদনের সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবাও দেওয়া হয়, যার আয়োজন করে রাষ্ট্র। একজন নারী এইচআইডি আক্রান্ত হলে অনেক মানুষ এতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। অন্তঃসত্ত্বা হলে অনাগত সন্তানও সমস্যায় পড়ে। এজন্য তার চিকিৎসা করতে হয়।’

‘নিজের টাকা অন্যের (বাবু) হাতে চলে গেলে কীভাবে একটা মেয়ে চলবে? তার কাস্টমার নেই, কোনো আয় নেই, সহায়তাও নেই। এ অবস্থায় সন্তানের মায়া ত্যাগ করে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন অনেকে।’-যৌনপল্লির এক কর্মী

ঋণের ফাঁদে পড়ে সন্তান বিক্রি
যৌনপল্লির সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, পল্লিতে বসবারত মেয়েদের প্রায় ৯০ শতাংশই কোনো না কোনো মাদকের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তারা আয় করলেও এর একটা অংশ মাদকের পেছনে চলে যাচ্ছে। বাকি টাকা নিয়ে নিচ্ছেন তাদের বাবুরা। ইচ্ছাকৃতভাবে হোক বা অনিচ্ছাকৃত হোক গর্ভে সন্তান চলে এলে উভয় সংকটে পড়েন মেয়েরা। গর্ভধারণের তিন মাস পর থেকেই খদ্দের আসা বন্ধ হয়ে যায়। তখন খাবার, ওষুধ ও ঘরভাড়ার খরচ মেটাতে চরম আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হতে হয় তাকে। এরপরই শুরু হয় ঋণ করে চলা। খাবারের হোটেল, মুদি ও ওষুধের দোকান এবং ঘরভাড়া বকেয়া থাকে। একপর্যায়ে অস্ত্রোপচার করে বা স্বাভাবিকভাবে সন্তান প্রসবের টাকাও থাকে না। এ অবস্থায় সন্তান বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন পল্লির নারীরা।

এখানেও রয়েছে সিন্ডিকেট। প্রসূতিকে ঋণের ফাঁদে ফেলতে সক্রিয় থাকেন দালালরা। পল্লিতে বিনা মূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলেও দালালরা তাদের বাইরে চিকিৎসা নিতে উৎসাহ দেন। বড় কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন পড়লে পাশেই ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে না নিয়ে নেওয়া হয় মাগুরার বেসরকারি হাসপাতালগুলোয়। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে পল্লির পাশে গড়ে ওঠা ওষুধের দোকানগুলো। এ নিয়ে ওষুধ দোকানিদের সঙ্গে কথা বলা হলেও বিষয়টি তারা অস্বীকার করেন।

এ বিষয়ে পল্লির এক কর্মী জাগো নিউজকে বলেন, ‘নিজের টাকা অন্যের (বাবু) হাতে চলে গেলে কীভাবে একটা মেয়ে চলবে? তার কাস্টমার নেই, কোনো আয় নেই, সহায়তাও নেই। এ অবস্থায় সন্তানের মায়া ত্যাগ করে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন অনেকে।’

দৌলতদিয়া যৌনপল্লিতে বিনা মূল্যে সেবা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা ‘সুখপাখি সেন্টার’র স্বাস্থ্যকর্মী নিলুফা ইয়াসমিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা পল্লির প্রতিটি মেয়েকে বিনা মূল্যে চিকিৎসা দেই। এখানে কোনো মেয়ে এলে তার রক্ত পরীক্ষা, রক্তচাপ নির্ণয়সহ প্রাথমিক পরীক্ষা করে ওষুধ দেই। তবে বাইরের মানুষেরা পল্লির মেয়েদের ভুল ধারণা দেন। বাইরে উচ্চমাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছে। এতে ছোটখাটো রোগ ভালো হচ্ছে। তবে এতে যে ভয়াবহ ক্ষতি হচ্ছে এটা তারা বুঝতে চায় না। মেয়েদের আয়ের একটা বড় অংশ অনেক সময় চিকিৎসার পেছনে চলে যাচ্ছে। অন্যদিকে দালালের খপ্পরে পড়ে অপচিকিৎসা পাচ্ছে তারা। সচেতন করেও কাজ হচ্ছে না এখানে।’

সাধারণ মানুষের মতোই তাদের দাফন-কাফনের ব্যবস্থা ও জানাজা করতে হবে। এর আগে চাপের মুখে জানাজা পড়ালেও এখন আর এমনটি নেই।- দৌলতদিয়া জামে মসজিদের পেশ ইমাম শহিদুল ইসলাম

জানাজা হয় দেরিতে, দায়সারা দাফন
দৌলতদিয়া যৌনপল্লির বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, পল্লির কেউ মারা গেলে তার জানাজা দেরিতে হয়। জানাজা পড়াতে স্থানীয় ইমাম নানা অজুহাতে দেরিতে আসছেন বা আসতে চান না। পরে প্রশাসন ও বেসরকারি নানা সংস্থার চাপে তারা আসতে বাধ্য হন। দাফন কাজে মূলত অংশ নেয় শিশু-কিশোররা। মরদেহ গোসল থেকে কবর খনন, সবই করতে হয় তাদের। আসেন না বাইরের কোনো মানুষ। এ থেকে তাদের পরিত্রাণ দেওয়ার দাবি জানান পল্লির বাসিন্দারা।
এ ব্যাপারে দৌলতদিয়া জামে মসজিদের পেশ ইমাম শহিদুল ইসলাম জানান, সাধারণ মানুষের মতোই তাদের দাফন-কাফনের ব্যবস্থা ও জানাজা করতে হবে। এর আগে চাপের মুখে জানাজা পড়ালেও এখন আর এমনটি নেই বলে তিনি জানান।

ইসলাম যা বলে
‘নিশ্চয় যারা এটা পছন্দ করে যে, মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ুক, তাদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।’ (সুরা নুর ১৯)
কোনো মুসলমান যদি ইসলাম ত্যাগ না করে, তাহলে ব্যভিচারসহ অন্যান্য বড় পাপে লিপ্ত হলেও সে কাফের হয়ে যায় না। যৌনবৃত্তিকে পেশা হিসেবে নেওয়া মহাপাপ হলেও এ কারণে যৌনকর্মীরা কাফের হয়ে যায় না। কোনো মুসলমান দুর্ভাগ্যক্রমে এ রকম পেশা গ্রহণ করলেও মৃত্যুর পর তার জানাজা পড়তে হবে এবং মুসলমানদের মতো দাফন করতে হবে।

এ বিষয়ে মেহেরপুর মসজিদের খতিব মাওলানা গাউসুল আজম জাগো নিউজকে বলেন, ‘অন্য মুসলমানদের মতো মুসলমান যৌনকর্মীদের জানাজার নামাজ পড়াও ফরজে কেফায়া। এটি মুসলমান সমাজের আবশ্যকীয় কর্তব্য। কয়েকজন জানাজা পড়লে সবার পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে, আবার কেউ না পড়লে সবাই গুনাহগার হবে।’

শত বাধার মধ্যেও আছে সফলতা
পল্লির বাসিন্দারা শত বাধা ও সমস্যার মধ্যে থাকলেও তাদের কিছু সফলতার গল্পও আছে। এরই মধ্যে পল্লির একটি সেফ হোমে বেড়ে ওঠা এক মেয়ে পড়ছেন ঢাকার নামকরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল বিভাগে। একজন ছেলে কোরআনের হাফেজ হয়ে এখন পড়ছে দাওরায়ে হাদিসে (স্নাতকোত্তর সমমান)। সেফ হোমে থেকে আড়াইশর বেশি ছেলে-মেয়ে লেখাপড়া করছে। প্রাথমিক পেরিয়ে তাদের অনেকে এখন মাধ্যমিকে পড়ছে। সেফ হোম থেকে পড়ালেখা করা ১০ জন মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করেছে বেসরকারি সংস্থা ‘পায়াক্ট বাংলাদেশ’। তারা এখন সমাজের মূলধারায় রয়েছে।

‘পায়াক্ট বাংলাদেশ’র দৌলতদিয়া ঘাট শাখার ম্যানেজার মজিবুর রহমান জুয়েল জাগো নিউজকে বলেন, ‘যৌনপল্লিতে অবস্থানরত শিশুদের রক্ষা করতে সেফ হোমের বিকল্প নেই। কারণ নিরাপদ আবাসন শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের সহায়ক। পল্লির শিশুদের নিরাপদ বাসস্থান ও গর্ভবতী মায়েদের নিরাপদে না রাখতে পারলে মায়ের পেশায় লিপ্ত হবে মেয়ে শিশুরা। একইভাবে মাদকাসক্তসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়বে ছেলে শিশুরা। বর্তমানে যৌনপল্লির চিত্র কিন্তু এটাই। পাশাপাশি বাবুদের নির্যাতন থেকে শিশুদের রক্ষা করতে হবে। এটা না হলে সমাজ আরও কলুষিত হবে।’

যৌনপল্লির বাসিন্দাদের নিয়ে সরকারের করণীয় ও কর্মসূচি জানতে চাইলে রাজবাড়ী জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক রুবাইয়াত মো. ফেরদৌস জাগো নিউজকে বলেন, ‘যৌনপল্লিতে আমরা এনজিওর মাধ্যমে কাজ করি। পায়াক্ট বাংলাদেশ নামের একটি এনজিও স্বাস্থ্য ইস্যু নিয়ে কাজ করছে। পল্লিতে এইচআইভি আক্রান্ত কেউ আছে কি না সে বিষয় নিয়েও কাজ করছে। আমরা বয়স্ক ভাতা ও শিশুদের সুরক্ষা নিয়ে সেখানে কাজ করছি। চেষ্টা করছি প্রতিটি ব্যক্তির কাছে যেন সরকারি সহায়তা পৌঁছে। তাছাড়া শিশুদের বিষয়টা প্রশাসনের নজরে আসছে। সেখানে তো কাউকে কোনো কাজে বাধ্য করার সুযোগ নেই।’

ইএআর/এমএমএআর/জেআইএম

Read Entire Article