শতাব্দী প্রাচীন বাবা আদম মসজিদের ইতিহাস
মওলবি আশরাফ বাংলায় রাজা বল্লাল সেনের শাসন প্রাচীন বাংলা ছিল ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অনগ্রসর। বাংলায় যারা বসতি স্থাপন করেছিল তাদের বড় অংশই ছিল নিচুজাতের হিন্দু ও বৌদ্ধ, এ কারণে এই অঞ্চল প্রাচীন ভারতের প্রতাপশালী শাসকদের নজরের বাইরেই ছিল সবসময়। কিন্তু এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটায় সেন রাজবংশ। দক্ষিণ ভারতের চালুক্যদের সঙ্গে তারা পালদের পতনকালে বাংলায় আসে। দ্বাদশ শতকের শুরুতে তারা পশ্চিম বাংলায় এক ক্ষুদ্র রাজ্য গঠন করে। সেন বংশের তৃতীয় রাজা বিজয়সেন (মৃত্যু ১১৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) বাংলার বৃহত্তম অংশ তার শাসনে আনতে সক্ষম হন। তিনি পশ্চিম বাংলায় বিজয়পুরে রাজধানী স্থাপন করেন, এবং পূর্ব বাংলার (বর্তমান ঢাকার কাছে) বিক্রমপুরে দ্বিতীয় রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। বিজয়সেন ও তার পুত্র বল্লাল সেন (শাসনকাল ১১৫৮–১১৭৯ খ্রিষ্টাব্দ) বৌদ্ধধর্মকে নির্মম ও নৃশংসভাবে দমন করেন এবং তার পরিবর্তে প্রতিষ্ঠা করেন এক ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব—যেখানে জোর দেওয়া হয় জাত-পাত বিভাজন (বর্ণপ্রথা বা caste) ও কৌলিন্যবাদের ওপর। (Muhammad Mohar Ali, History of the Muslims of Bengal, Vol. IA, Islamic Foundation Bangladesh, p. 8.) সাধারণ ম
মওলবি আশরাফ
বাংলায় রাজা বল্লাল সেনের শাসন
প্রাচীন বাংলা ছিল ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অনগ্রসর। বাংলায় যারা বসতি স্থাপন করেছিল তাদের বড় অংশই ছিল নিচুজাতের হিন্দু ও বৌদ্ধ, এ কারণে এই অঞ্চল প্রাচীন ভারতের প্রতাপশালী শাসকদের নজরের বাইরেই ছিল সবসময়। কিন্তু এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটায় সেন রাজবংশ। দক্ষিণ ভারতের চালুক্যদের সঙ্গে তারা পালদের পতনকালে বাংলায় আসে। দ্বাদশ শতকের শুরুতে তারা পশ্চিম বাংলায় এক ক্ষুদ্র রাজ্য গঠন করে। সেন বংশের তৃতীয় রাজা বিজয়সেন (মৃত্যু ১১৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) বাংলার বৃহত্তম অংশ তার শাসনে আনতে সক্ষম হন। তিনি পশ্চিম বাংলায় বিজয়পুরে রাজধানী স্থাপন করেন, এবং পূর্ব বাংলার (বর্তমান ঢাকার কাছে) বিক্রমপুরে দ্বিতীয় রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। বিজয়সেন ও তার পুত্র বল্লাল সেন (শাসনকাল ১১৫৮–১১৭৯ খ্রিষ্টাব্দ) বৌদ্ধধর্মকে নির্মম ও নৃশংসভাবে দমন করেন এবং তার পরিবর্তে প্রতিষ্ঠা করেন এক ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব—যেখানে জোর দেওয়া হয় জাত-পাত বিভাজন (বর্ণপ্রথা বা caste) ও কৌলিন্যবাদের ওপর। (Muhammad Mohar Ali, History of the Muslims of Bengal, Vol. IA, Islamic Foundation Bangladesh, p. 8.)
সাধারণ মানুষ তখন হিন্দু রাজাদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে চাচ্ছিল। ঠিক সেই সময় আরব, পারস্য, মধ্য এশিয়া থেকে একদল সুফি বাংলায় আসতে শুরু করেন। তাদের লক্ষ্য ছিল মানুষকে জুলুম থেকে মুক্ত করে আল্লাহর একত্ব, সাম্য ও ইনসাফের বার্তা দেওয়া। তারা গ্রামবাংলায় খানকা ও মসজিদ গড়ে তোলেন। সেখানে তারা সেবামূলক বিভিন্ন কাজ করতেন। নিপীড়িত মানুষ তখন তাদের মাঝে নিজের মানবিক মর্যাদা খুঁজে পায় এবং ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। এভাবে রাজা বল্লাল সেনের রাজ্যেও কয়েকজন ইসলামের আশ্রয়ে চলে এসেছিল। কট্টর হিন্দু বল্লাল সেন তখন কোরবানি, আজান ও সব ধরনের ইসলামি আচার-আচরণ বন্ধ করতে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।
বাবা আদম শহীদের আগমন
লোকবয়ানে জানা যায়, বাবা আদম শহীদের জন্ম ১০৯৯ খ্রিষ্টাব্দে, হেজাজের মক্কা নগরীতে। শৈশব থেকেই তিনি ইলমচর্চা, তাজকিয়া ও আধ্যাত্মিক সাধনায় ঝুঁকে পড়েন। পরে বাগদাদে গিয়ে বড়পীর আবদুল কাদের জিলানির (রহ.) হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন বলেও বর্ণনা পাওয়া যায়। একদিন তিনি কাবাঘর প্রাঙ্গণে ছিলেন, এমন সময় বাংলা থেকে পালিয়ে আসা একজন লোকের কাছ থেকে খুবই বেদনাদায়ক কাহিনি শোনেন। সেই লোক জানান, তিনি বাংলা অঞ্চলের রামপাল এলাকার কাছাকাছি কানা-চং গ্রামের একজন বাসিন্দা। নিজের ছেলের আকিকার অনুষ্ঠানে গরু জবাই করার ‘অপরাধে’ তাকে নির্যাতন করা হয়েছে। এক পর্যায়ে পালিয়ে তিনি মক্কায় চলে এসেছেন। একইসাথে তিনি সেখানকার নির্যাতিত অন্যান্য মুসলমানের কথাও বলেন। বাবা আদম শহীদ তখন সাধারণ মানুষকে অত্যাচারী রাজা থেকে উদ্ধার করতে ছয় থেকে সাত হাজার অনুসারী নিয়ে বাংলায় আসেন।
বাবা আদম মসজিদ ছবি: উইকিপিডিয়া
বাবা আদম শহীদ ও বল্লাল সেনের যুদ্ধ
রাজা বল্লাল সেন মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের বহিষ্কারে সংকল্পবদ্ধ হন এবং তার সেনাবাহিনী নিয়ে অগ্রসর হন। সেনাবাহিনী মুসলমানদের সম্পূর্ণ ধ্বংস করতে ব্যর্থ হওয়ায় রাজা নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন। এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বাবা আদম শহীদ শাহাদাত বরণ করেন। কিন্তু অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস যে, বিজয়ী হয়েও স্বয়ং রাজা এবং তার পরিবারবর্গ অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ বিসর্জন দেন।
এর পেছনের কাহিনি হলো—রাজা তার পরিবারকে জানিয়ে রেখেছিলেন, যদি তার সঙ্গে থাকা পোষা কবুতর যুদ্ধের ময়দান থেকে ফিরে আসে, এর মানে তিনি পরাজিত হয়েছেন। তখন তার পরিবার যেন নিজেদের সম্মান বাঁচাতে আত্মহুতি দেয়। ওদিকে রাজা যুদ্ধে জয়লাভের পর একটি পুকুরে হাত-পা ধোয়ার জন্য নেমেছিলেন। এমন সময় কবুতরটি ছাড়া পেয়ে উড়ে রাজপ্রাসাদে চলে যায়। রাজার স্ত্রী ও পরিবার মনে করে যুদ্ধে তাদের পরাজয় হয়েছে, তারা জ্বলন্ত চিতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। রাজা ফিরে এসে এই অবস্থা দেখে নিজেও সেই চিতায় ঝাঁপ দেন।
এই কাহিনির পুরোটাই লোকমুখে প্রচলিত বয়ান। অবশ্য আনন্দ ভট্টের ‘বল্লালচরিত’ নামক গ্রন্থে বল্লাল সেনের সঙ্গে বাবা আদমের যুদ্ধের কাহিনি পাওয়া যায়। এ গ্রন্থে বল্লালের শত্রুর নামকরণ করা হয়েছে ‘বায়াদুম্ব’, যা স্পষ্টতই বাবা আদমের অপভ্রংশ। বাবা আদম এবং তার অনুসারীদের ‘ম্লেচ্ছ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে (এ সময়ে মুসলমানদের বুঝাতে হিন্দু লেখকগণ প্রায়শ ম্লেচ্ছ শব্দটি ব্যবহার করতেন)। বলা হয় যে, বাবা আদম পাঁচ হাজার সৈন্যের এক বাহিনী নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। রাজা এবং তার পরিবারের ভাগ্য কিংবদন্তিতে উল্লিখিত রূপেই বর্ণিত হয়েছে।
মসজিদ নির্মাণের ইতিহাস
বাবা আদম শহীদের শাহাদাতের বহু পরে, হিজরি ৮৮৮ (১৪৮৩ খ্রিষ্টাব্দে) সুলতান জালালউদ্দিন ফতেহ শাহের আমলে তার স্মৃতিবাহী এই মসজিদ নির্মিত হয়। নির্মাতা ছিলেন মালিক কাফুর নামের এক উচ্চপদস্থ কর্মচারী। মসজিদটি বর্তমানে মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার মিরকাদিম পৌরসভার দরগাবাড়ি/কাজী কসবা এলাকায় অবস্থিত।
বাবা আদম মসজিদের পুরু দেয়াল ছবি: উইকিপিডিয়া
মসজিদের স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য
ছোট পরিসরের হলেও বাবা আদম শহীদ মসজিদ বাংলার সুলতানি স্থাপত্যের এক অনন্য উদাহরণ। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৪৩ ফুট, প্রস্থ ৩৬ ফুট, আর দেয়ালের পুরুত্ব প্রায় ৪ ফুট—যা তাকে দেয় দুর্গের মতো গাম্ভীর্য ও স্থায়িত্ব। ছাদে রয়েছে সমান আকৃতির ৬টি গম্বুজ। সামনের দিক খিলানযুক্ত, মূল প্রবেশপথের দুই পাশে দু’টি জানালা। প্রবেশমুখের ওপরে ফারসি অক্ষরে খোদাইকৃত কালো পাথরের শিলালিপি এখনও সেই সময়ের রাজনৈতিক-ধর্মীয় স্মৃতি বহন করছে। মাঝখানে রয়েছে বিশাল কালো পাথরের দুইটি স্তম্ভ। মসজিদে এখনও নিয়মিত জামাত হয়, সামনে বাড়তি কাতারের জন্য কংক্রিটের প্রাঙ্গণ যোগ হয়েছে।
মসজিদকে বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় ছোট্ট এক দুর্গ—মোটা দেয়াল, নিচু গম্বুজ, প্রাচীন দিনের সাদামাটা কিন্তু ভাবগম্ভীর নকশা। দেয়ালগুলো তৈরি হয়েছে লাল পোড়ামাটির ইট ও সুরকি দিয়ে; পুরু দেয়াল দিনের গরমে তাপ শুষে নিয়ে ভেতরটা রাখে শীতল, আবার শীতে সেই দেয়াল জমে থাকা তাপ সহজে বের হতে না দিয়ে ভেতরের পরিবেশকে রাখে তুলনামূলক উষ্ণ। দুপাশে জানালা না রেখে শুধু সামনের দরজা–জানালা রাখার ফলে ভেতরে আলো কম ঢোকে, শব্দও কম প্রবেশ করে।
আরও পড়ুন:
তিউনিশিয়ার প্রাচীন মসজিদ জামে উকবা ইবনে নাফে
গাজার ধ্বংসপ্রাপ্ত ওমরি মসজিদের ইতিহাস
যেভাবে বাবা আদম শহীদ মসজিদে যাবেন
ঢাকা থেকে বাবা আদম শহীদ মসজিদে যেতে চাইলে গুলিস্তান বা যে কোনো বাসস্ট্যান্ড থেকে মুন্সীগঞ্জগামী বাসে উঠতে হবে। মুন্সীগঞ্জ মুক্তারপুর ব্রিজের গোড়ায় নেমে সেখান থেকে অটো রিকশায় সিপাহীপাড়া, তারপর সেখান থেকে বাবা আদম শহীদ মসজিদ। দরগাবাড়ি বললেই স্থানীয় মানুষজন চিনিয়ে দেবে।
ওএফএফ/এএসএম
What's Your Reaction?