দূষণে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পথশিশুরা

3 months ago 55
বিজয় সরণি ব্রিজে গাড়ি থামতেই ছুটে আসে মেয়েটি। হাত বাড়িয়ে বলে, ‘দশটা টাকা দ্যান! ভাত খাব।’ পরনের কাপড় মলিন হলেও দৃষ্টি একদম ঝকঝকে। নাম জানতে চাইলে বলল, শর্মিলা। বয়স নয় বা দশ হবে। স্কুলে যাও? বলল, সরকারি প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। মাঝে মাঝে যাই। প্রতিদিন যাও না কেন? একটু লজ্জা পেয়ে বলল, খাওন পামু কই? তখনই সিগনাল ছাড়তেই দশ টাকা নিয়ে সে গাড়ির ফাঁকে কোথায় জানি মিলিয়ে গেল। শ্যামলী আইল্যান্ডের ওপর বাচ্চা কোলে নিয়ে বসে আছেন ফরিদা। পাশে দাঁড়িয়ে আরেকটি শিশু। নিচে তার মা। একটু এগিয়ে ফুটওভার ব্রিজে গেলে সেখানে দেখা গেল এক নবজাতককে নিয়ে মা বসে ভিক্ষা করছেন। সকাল, দুপুর, রাত প্রায় সব সময়ই তাদের দেখতে পাওয়া যায়। প্রচণ্ড এই গরম হার মানে তাদের কাছে। রাজধানীর ব্যস্ত এলাকাগুলোতে এমন পথশিশুদের দেখা মেলে হরহামেশাই। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধূলা-দূষণ, গাড়ির কালো ধোঁয়ায় শিশুদের শারীরিক ক্ষতির ঝুঁকি মারাত্মক। তারা তাৎক্ষণিক কোনো সমস্যায় না পড়লেও ধীরে ধীরে নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়ের বক্ষব্যাধি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শামীম আহমেদ বলেন, পথশিশুরা প্রতিনিয়ত বায়ুদূষণপ্রবণ পরিবেশে থাকে। ওরা থাকে সাধারণত ট্রাফিক সিগনালের আশপাশে। ফলে ওরা থাকে সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। আর শিশুদের ফুসফুস অত্যন্ত নাজুক। ফলে তাদের ক্ষতি হয় বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, রাস্তার চেয়ে ট্রাফিক সিগনালে পরিবেশদূষণ তুলনামূলকভাবে বেশি। কারণ গাড়ি ওখানে অনেকটা সময় দাঁড়ায়। এ ছাড়াও পথশিশুরা অনেক সময় কাগজ ও খালি বোতল সংগ্রহ করে। এর জন্য তারা রাস্তার পাশে জমানো ময়লা ঘাঁটে। ওই ময়লায় থাকে নানারকম জীবাণু, যার সংস্পর্শে এসে শিশুরা বিভিন্ন ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত হয়। ডা. শামীম আহমেদ বলেন, দূষণ সেøা পয়জনের মতো কাজ করে। ফলে ওরা বা ওদের অভিভাবকরা এর ক্ষতিকর দিকটা বুঝতে পারে না। আর রোগ হলেও ওরা সঠিক চিকিৎসাও পায় না। শুষ্ক মৌসুমে ধুলোবালির কারণে বায়ুদূষণের মাত্রা বাড়ে। নির্মাণকাজে ব্যবহৃত সামগ্রী যত্রতত্র ছড়িয়ে রাখার কারণেও পরিবেশদূষণ হয়। পথশিশুরা এসব জায়গায় তুলনামূলক বেশি যাতায়াত করে। এতে তারা খুব সহজেই দূষণে আক্রান্ত হয়। পরিবেশবিষয়ক সংগঠন ‘বেলা’র প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘পরিবেশ বিষয়ে আসলে কোথাও কোনো সুসংবাদ নেই। বাতাস, মাটি, পানি বা শব্দদূষণ সব জায়গাতেই কেমন যেন উন্নয়নের আগ্রাসী থাবায় পরিবেশ বেশ একটা অসহায়ত্ব বরণ করে নিয়েছে। বর্তমানে বায়ুদূষণ, শব্দদূষণের পাশাপাশি যোগ হয়েছে দাবদাহ। পথশিশুরা অবশ্যই এই দূষণের নিকৃষ্ট শিকার। তার কারণ তারা থাকেই এই দূষণের মধ্যে, পথে পথে।’ দূষণজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি ঠেকাতে উন্নয়ন ঢেলে সাজানোর পরামর্শ দেন সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, আমাদের উন্নয়ন এমন হতে হবে যেন আমাদের সমাজে শুধু শিশু থাকবে। তাদের শ্রেণিকরণ থাকবে না। পথশিশু বলে আলাদা কোনো শিশু থাকবে না। সমস্যা সমাধানে উন্নয়নটাকে পরিবেশবান্ধব করতে হবে। উন্নয়নকে সাম্যভিত্তিক, সামাজিক ন্যায়বিচারভিত্তিক করতে হবে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, সারাবিশে^ ১৫ বছরের নিচে প্রায় এক কোটি শিশু বিভিন্ন পরিবেশদূষণজনিত রোগে আক্রান্ত। ইউনিসেফ পরিচালিত এক জরিপে জানা যায়, বাংলাদেশের মোট শিশুর প্রায় ৪৫ শতাংশ দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে। এদের সংখ্যা হবে প্রায় তিন কোটির বেশি। এসব শিশুর মধ্যে আবার ৪১ শতাংশের কোনো আশ্রয় নেই। ৬৪ শতাংশ স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃসেবা থেকে বঞ্চিত। ৫৭ শতাংশ দৈহিক বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায় না। ১৬ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা এবং তিন ভাগ শিশু সুপেয় পানীয় জল থেকে বঞ্চিত। আর এসব না পাওয়ার সঙ্গে যখন যোগ হয় পরিবেশদূষণ, তখন হতদরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের পথশিশুরা মারাত্মকভাবে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আক্রান্ত হয়।
Read Entire Article