অটুট থাকুক পবিত্র বন্ধন

3 hours ago 4

প্রতিদিন বিবাহ বিচ্ছেদের সংবাদ পাওয়া যায়। একটি সুখি-সমৃদ্ধ ও শান্তিময় পারিবারিক জীবনের প্রাথমিক শর্ত হলো বিবাহ। বিয়ে হচ্ছে একটি পবিত্র বন্ধন। এটা কারো অজানা নেই, একজন পুরুষ এবং একজন নারীর একত্রে জীবন যাপনে শরিয়ত মোতাবেক যে বন্ধন স্থাপিত হয়, তারই নাম বিবাহ।

বিয়ে-বন্ধন কেব লমাত্র গতানুগতিক বা কোন সামাজিক প্রথা নয়, এটা মানব জীবনের ইহকাল ও পরকালের মানবীয় পবিত্রতা রক্ষার জন্য আল্লাহপাকের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নেয়ামত। সুতরাং এটা যে কেবল মাত্র পার্থিব জীবনের গুরুত্বই বহন করে এমন নয়, বরং পারলৌকিক জীবনের জন্যও অনেক গুরুত্ব বহন করে। বিয়ের এই পবিত্র বন্ধনকে ছিন্ন করে সমাজে বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা অহরহ ঘটছে। যদিও তালাকের বিষয়ে ইসলামের শিক্ষা রয়েছে কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে তালাক কোনো পছন্দনীয় কাজ নয়। বরং ইসলামে সবচেয়ে ঘৃণ্য ও নিকৃষ্ট হালাল কাজ হিসেবে তালাককে উল্লেখ করা হয়েছে।

বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে নারীকে করা হয়েছে পুরুষের জীবন সঙ্গিনী ও অর্ধাঙ্গিনী। কারণ, পুরুষ নিজ জীবনে আপন ভবনে স্বয়ং সম্পূর্ণ নয় বলেই একজন সহযোগিনীর একান্ত মুখাপেক্ষী। নারীর অবর্তমানে পুরুষের হৃদয় শূন্য কোঠা সমতুল্য। একজন সুস্থসবল, সতীসাধ্বী, ধর্মপরায়ণা নারীকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করার মাধ্যমেই কেবল তার এ শূন্য কোঠা পূর্ণ হতে পারে। সৃষ্টির আদিকাল থেকেই নারী-পুরুষ একে অপরের পরিপূরক ও পরিপোষক।

পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘আর তার নিদর্শনাবলির মাঝে এ-ও হলো একটি নিদর্শন যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদেরই মাঝ থেকে জোড়া সৃষ্টি করেছেন যেন তোমরা প্রশান্তি লাভের জন্য তাদের কাছে যাও এবং তিনি তোমাদের মাঝে প্রেম-প্রীতি ও দয়ামায়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে সেইসব লোকের জন্য নিদর্শনাবলি রয়েছে, যারা চিন্তাভাবনা করে’ (সুরা রুম, আয়াত: ২১)।
নারী পুরুষের হৃদয়ে প্রশান্তি লাভের নির্ভরযোগ্য এক আশ্রয়স্থল হচ্ছে বিবাহবন্ধন। কেবল মাত্র বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমেই কোন পুরুষ এ পবিত্র আশ্রয়স্থলে প্রবেশ করতে পারে। তাই বিবাহকে বলা হয় শান্তির প্রতীক।

বিবাহের এই অসাধারণ গুরুত্বের প্রতি লক্ষ্য করেই মানব সৃষ্টির আদিতে বৈবাহিক যোগসূত্রের গোড়াপত্তন হয়। কারণ, এই সহ জীবন যাপনের পূর্বশর্ত হচ্ছে বিবাহ বন্ধন। সকল দিক বিবেচনা করেই পবিত্র কুরআনে মানব সম্প্রদায়কে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

এছাড়া মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘যুগল প্রেমিক আর প্রেমিকার জন্য তুমি বিবাহের চেয়ে উত্তম কিছুই খুঁজে পাবে না’ (ইবনে মাজা)। অথচ আজ সামান্য বিষয়কে কেন্দ্র করে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে যে পবিত্র বন্ধন রচিত হয়েছে তা থেকে দূরে সরে যায়। ইসলামে তালাকের ব্যবস্থা রাখলেও তালাক প্রদানে উৎসাহিত করা হয়নি।

বর্তমান বিচ্ছেদের প্রবণতা এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে মনে হয় এটা কোন বিষয়ই না। আমরা এটাও লক্ষ্য করিনা এর মাধ্যমে যে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নৈতিকতা ও আদর্শকে ধ্বংস করে দিচ্ছি।

স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদের কারণে শুধু স্বামী-স্ত্রী নয় বরং ছেলেমেয়েসহ আত্মীয়-স্বজনও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে অনিশ্চিত করে দেয় অনেক ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ। তারা সবসময় এক ধরনের মানসিক চাপের মধ্যে থাকে।

ন্যায়সংগত কারণে তালাক ইসলামে বৈধ। তবে এটি সবচেয়ে নিকৃষ্ট বৈধ কাজ। নারীরাও বৈধ উপায়ে এ তালাক নেওয়ার অধিকার রাখে। হজরত মুআররিফ (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে হালাল বিষয়ের মধ্যে তালাকের চেয়ে অধিকতর ঘৃণিত আর কিছু নেই’ (আবু দাউদ)।

হাদিসে আরো এসেছে ‘যে নারী স্বামীর কাছে বিনা কারণে তালাক প্রার্থনা করে, তার জন্য জান্নাতের সুঘ্রাণ পর্যন্ত হারাম’ (ইবনে মাজা)।তালাকের ভয়াবহতা সম্পর্কে হজরত আলি (রা.)এর বর্ণনায় এসেছে, মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা বিয়ে কর কিন্তু তালাক দিয়ো না। কেননা তালাক দিলে তার দরুন আল্লাহর আরশ কেঁপে ওঠে।’ (তাফসিরে কুরতুবি)। তবে একান্তই বিবাহবিচ্ছেদ কখনো অনিবার্য হয়ে উঠলে ইসলাম তার বিধান দিয়েছে।

এক সাথে চলতে গিয়ে কিছু ভুল বুঝাবুঝি স্বামী-স্ত্রীর মাঝে হতেই পারে। এজন্য কখনো স্বামীকে ছাড় দিয়ে চলতে হয় আবার কখনো স্ত্রীকে। বিশেষ করে স্ত্রীদের ক্ষেত্রে কিছুটা বেশি ছাড় দিতেই মহানবি (সা.) উৎসাহিত করেছেন।

মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘নারীদেরকে পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে।’ তুমি যদি একবারে এটিকে সোজা করতে যাও, তবে ভেঙ্গে ফেলবে। অর্থাৎ তাদের স্বভাবে কিছুটা বক্রতা রাখা হয়েছে। কিন্তু এটিই নারীদের সৌন্দর্য। তাদেরকে যদি একবারেই সোজা অর্থাৎ সংশোধন করার চেষ্টা করা হয় আর সেজন্য অশোভন ও কঠোর পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়, তবে সেটি কখনো সংশোধিত হবে না আর এভাবে সেই হাড় ভেঙ্গে যেতে পারে, অর্থাৎ নারীরা বিগড়ে যেতে পারে। প্রেম-ভালোবাসা, সহনশীলতা ও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের মাধ্যমে ধীরে ধীরে তাদের সংশোধন করতে হবে।

ইসলাম এমন একটি শান্তির ধর্ম, যা নারী-পুরুষ প্রত্যেকের অধিকার খুব সুন্দর ভাবে সংরক্ষণ করে এবং একটি সুন্দর সমাজ গঠনে নারী-পুরুষ উভয়ের অবদান রাখার কথা ঘোষণা করে।

ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে নারীর মর্যাদা কীরূপ ছিল। তাদের অধিকার বলতে কিছু ছিল না। কিন্তু মানবতার মুক্তির দূত, নবিকূল শিরোমণি হজরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.)-এর আবির্ভাবে নারীরা তাদের যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদা লাভ করে। তার (সা.) প্রতি অবতীর্ণ পূর্ণাঙ্গ ঐশী গ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহতায়ালা শিক্ষা দিলেন, ‘তারা তোমাদের জন্য একপ্রকারের পোশাক এবং তোমরাও তাদের জন্য এক প্রকারের পোশাক’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৭)। এখন দেখুন, পোশাকের কাজ কি? পোশাকের কাজ হচ্ছে নগ্নতাকে ঢেকে দেওয়া। তাই আল্লাহতায়ালা বলেছেন, তোমরা স্বামী-স্ত্রী অবশ্যই একে অপরের দোষ-ত্রæটি ঢেকে রাখবে। কেননা, পোশাক সৌন্দর্য বৃদ্ধির কারণও হয়ে থাকে। এখানে নারী-পুরুষকে একে অপরের সহযোগী আখ্যায়িত করা হয়েছে।

অন্যত্র আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের স্ত্রীগণ তোমাদের জন্য ক্ষেত্র স্বরূপ’ (সুরা আল বাকারা, আয়াত: ২২৩)। একজন ভাল কৃষক যেভাবে সর্বদা নিজের মূল্যবান জমিনের হেফাযত করে, পরিশ্রমের মাধ্যমে জমিনের পরিচর্যা করে, জমিকে ক্ষতিকর পোকা-মাকড়ের হাত থেকে রক্ষা করে, তেমনিভাবে ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে, পুরুষরা যেন জেনে রাখে যে, নারীরা তাদের অমূল্য সম্পদ। সঠিকভাবে তাদের হিফাযত করা, তাদের ভালোমন্দের দিকে দৃষ্টি রাখা এবং তাদের সাথে উত্তম দাম্পত্য-জীবন যাপন করতে যেন কোনো ত্রুটি না করে।

আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘পুরুষগণ স্ত্রীলোকদের ওপর অভিভাবক, কেননা আল্লাহ তাদের কতককে কতকের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং এই কারণেও যে, তারা নিজেদের ধনসম্পদ থেকে স্ত্রীলোকদের জন্য খরচ করে’ (সুরা নিসা, আয়াত: ৩৪)।

আর হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, হজরত হাকিম ইবনে মুয়াবিয়া (রা.) তাঁর পিতা মুয়াবিয়া (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, হে আল্লাহর রাসূল! স্বামীর ওপর স্ত্রীর কি কি অধিকার রয়েছে? তিনি (সা.) বললেন, তার অধিকার হল যখন তুমি খাবে তখন তাকেও খাওয়াবে, তুমি যে মানের কাপড় পরবে, তাকেও সে মানের কাপড় পরাবে। তার মুখে আঘাত করবে না। অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করবে না’ (আবু দাউদ)।

আমরা যদি আজ মহানবির (সা.) এই শিক্ষার ওপর আমল করি তাহলে প্রতিনিয়ত যে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে তা হয়ত খুব কমই দেখা দিত।

তাই আসুন, আমরা এমন কিছু না করি যার ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদেরকে ধিক্কার দিবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা চিন্তা করে তাদের জন্য জান্নাত-সদৃশ্য পৃথিবী গড়ার আমাদের চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা ও নিয়ম-নীতি অনুযায়ী চলার তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক: প্রাবন্ধিক, ইসলামী চিন্তাবিদ।
[email protected]

এইচআর/এমএস

Read Entire Article