অড়হর থেকে হবে রুটি, রোজেল থেকে চা

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মাঠ পর্যায়ের কৃষি নিয়ে কাজ করেন এমন গবেষকের সন্ধান করলে সবার আগে যার নাম আসবে তিনি ফসল উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ছোলায়মান আলী ফকির। শিমুল আলু, চুকুর, ফ্রেঞ্চ বিনসহ নানাবিধ উদ্ভিদ নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং মাঠ পর্যায়ে সেগুলোকে ব্যবহার উপযোগীও করে তুলেছেন তিনি।

শিমুল আলু (কাসাভা), চুকুর (রোজেল), অড়হরসহ বিভিন্ন উদ্ভিদ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের গবেষণা করেছেন ড. ছোলায়মান। এসব উদ্ভিদ থেকে তিনি উন্নতমানের খাদ্যসামগ্রী উৎপাদন করেছেন। চিপস, চপ, কেক, পাকোড়া, পুডিংসহ নানাবিধ মুখরোচক খাদ্য এসব উদ্ভিদ থেকে উন্নয়ন করেছেন তিনি। মূলত মাঠকৃষির উন্নয়নের লক্ষ্যেই গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

তেমনই একটি সম্ভাবনাময় গুণসম্পন্ন উদ্ভিদ রোজেল। আঞ্চলিক ভাষায় যেটি চুকাই বা চুকুর নামে পরিচিত। রোজেল পৃথিবীব্যাপী পুষ্টিগুণ, স্বাদ ও ঘ্রাণের জন্য বিখ্যাত হলেও বাংলাদেশে এর তেমন চাহিদা নেই বললেই চলে। অপরিচিত ও অপ্রচলিত এরকম একটি উদ্ভিদের ফুলের বৃতি প্রক্রিয়াজাত করে জ্যাম, জেলি, পুডিং, চাটনী, আচার, চকলেট, চা ও জুসসহ বিভিন্ন মুখোরোচক খাদ্য ও পানীয় উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছেন ড. ছোলায়মান। এটিই ছিল চুকুরের পেছনে তার দীর্ঘ সময় ধরে চালানো গবেষণার সুফল।

অধ্যাপক ছোলায়মান জাগো নিউজকে বলেন, মূলত রোজেলের বৃতিই প্রধান কার্যকরী উপাদান। রোজেল ফুলের মাংসল বৃতি সরাসরি খাদ্য হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। বৃতির উজ্জ্বল লাল রঙ জৈব খাবার রঙ হিসেবেও ব্যবহার করা সম্ভব। বৃতি থেকে জ্যাম, জেলি, চা, আচার, চাটনী, জুসসহ বিভিন্ন পানীয় প্রস্তুত করা সম্ভব। রোজেলের বীজ যখন পরিপক্ব হয় তখন তা আমিষ ও চর্বিতে পরিপূর্ণ থাকে, বিধায় এটা প্রক্রিয়াজাত করে গবাদি পশুর খাবার হিসেবেও ব্যবহার করা যায়।

অন্যদিকে রোজেলের পাতাও ওষুধিগুণে পরিপূর্ণ। তাছাড়াও বৃতির উজ্জ্বল রঙই প্রমাণ করে দেয় এটি পুষ্টিগুণে ভরপুর। রোজেলের বৃতিতে থাকে অ্যান্থোসায়ানিন, ক্যারোটিনয়েডসহ গুরুত্বপূর্ণ এন্টিঅক্সিডেন্টসমূহ। এই বৃতি থেকে উৎপাদিত খাদ্যদ্রব্য ও পানীয় পান করলে ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস পাওয়াসহ নানান রোগ থেকে মুক্তি মিলবে।

তিনি আরও বলেন, একটি রোজেল গাছ থেকে আধা কেজি থেকে দেড় কেজি পরিপক্ক কাঁচা ফল পাওয়া যায়। চার থেকে পাঁচটি গাছই যথেষ্ট একটি পরিবারের চা, জ্যাম, জুস, আচার ইত্যাদির চাহিদা মেটাতে।

অন্যদিকে কাসাভা বা শিমুল আলু থেকেও গবেষণা করে সেগুলো প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে রুটি, তেলের পিঠা, হালুয়া, পাকোড়া, চিপস, চপ, কেকসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য উন্নয়ন করেছেন অধ্যাপক ছোলায়মান।

কাসাভা হলো গাছের শিকড়জাত এক ধরনের আলু। অনেকের কাছে এটা শিমুল আলু বা কাঠ আলু হিসেবেও পরিচিত। কাসাভা শর্করা জাতীয় খাবারের অন্যতম উৎস। এই কাসাভা সহজে এবং কম খরচেই চাষাবাদ করা সম্ভব। কম উর্বর আবাদি জমিতেও এর চাষাবাদ করা যায়। যার ফলস্বরূপ চাল ও আলুর ওপর নির্ভরশীলতাও অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।

কাসাভা সিদ্ধ করে, পুড়িয়ে এমনকি গোলআলুর মতো তরকারির সঙ্গে রান্না করে খাওয়া যায়। কাসাভার আটা গমের আটার সঙ্গে মিশিয়ে রুটি, পরোটা, কেক তৈরিতে ব্যবহার করা যায়। চপ, পাকোড়া, ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের মতো কাসাভার চিপসও তৈরি করে প্রদর্শনী করেছেন অধ্যাপক ছোলায়মান। এছাড়াও গো-খাদ্য হিসেবে কাসাভার ব্যবহার সম্ভব।

গবেষক আরও জানান, খাদ্যের চেয়ে শিল্পে কাসাভার ব্যবহার বেশি। বিশেষ করে বস্ত্র ও ওষুধ শিল্পের জন্য কাসাভা গুরুত্বপূর্ণ। গ্লুকোজের অন্যতম উৎস এই কাসাভা। কাসাভার স্টার্চকে এক ধরনের জীবাণুর মাধ্যমে গ্লুকোজে রূপান্তর করা হয়। কাসাভাতে গ্লুটেইন নামক প্রোটিন রয়েছে, যা আঠালো হয়ে থাকে।

অপরদিকে অড়হর নিয়েও গবেষণা করেছেন অধ্যাপক ছোলায়মান। অড়হর ডাল দেশে তেমন একটা প্রচলিত না হলেও অড়হর গাছের বীজ প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে কাবাবসহ মুখরোচক সাতটি খাদ্য তৈরি করা সম্ভব বলে তার গবেষণালব্ধ জ্ঞানের ভিত্তিতে দাবি করেন তিনি।
তিনি বলেন, শুকনো বীজের অড়হর দিয়ে রুটি, পুরি, শিঙাড়া এবং সেদ্ধ কাঁচা বীজের পেস্ট দিয়ে হালুয়া, কাবাব তৈরি করা সম্ভব। এছাড়াও বীজ ভাজা ও কাঁচা বীজের সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে অড়হর।

অড়হর ডালের পেস্ট আটার সঙ্গে মিশিয়ে রুটিও করেছেন অধ্যাপক ছোলায়মান। এটি ভাতের বিকল্প হিসেবে চালের ওপর চাপ কমাবে বলেও জানান এই গবেষক। ভাতের চেয়ে কার্বোহাইড্রেট অনেকাংশে কম থাকায় এটা মানুষের ওজন নিয়ন্ত্রণে অধিক কার্যকর। স্বল্প খরচে ডালের চাহিদা পূরণে অড়হর গাছ ভূমিকা রাখবে। তরকারিতে মটরশুঁটির বিকল্প হিসেবেও ব্যবহার করা যাবে এই অড়হর ডাল। এছাড়াও অড়হর বীজ নানান ধরনের রোগবালাই থেকে মুক্তি দিতে সক্ষম।

অধ্যাপক ছোলায়মান আলী ফকিরের প্রায় ১০০টিরও অধিক গবেষণা প্রবন্ধ রয়েছে। বর্তমানে তিনি রঙিন চাল নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।

তিনি বলেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সাহায্য পেলে হয়তো এসব অপ্রচলিত উদ্ভিদগুলোর নানাবিধ ব্যবহার দেশের মানুষের সামনে উপস্থাপন করতে পারবো এবং কৃষকদের এসব চাষে উৎসাহিত করতে পারবো।

এফএ/জিকেএস