অনলাইন জুয়া সময়ের নীরব ঘাতক
মুহিবুল হাসান রাফি তরুণ ও যুব সমাজে নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণের আসক্তির পাশাপাশি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে সময়ের নীরব ঘাতক অনলাইন জুয়া। শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এর দাপট অনেকটা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। এর প্রতিরোধ, প্রতিকার কিংবা তরুণ ও যুব সমাজে জনসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখার সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে আদৌ কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এটি এমন এক নেশায় পরিণত করে, যা বাসাবাড়ি, বাস-ট্রেন, ফুটপাত থেকে রিকশা গ্যারেজ, কর্মক্ষেত্র, ব্যবসা-বাণিজ্য পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছে। প্রায় কমবেশি সবশ্রেণির মানুষ এতে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছে। মোবাইলে অ্যাপ নামিয়ে কিংবা চোখের সামনে ভেসে আসা জুয়ার লোভনীয় অফারে প্রলুব্ধ হয়ে অনেকে তৎক্ষণাৎ জড়িয়ে পড়ছেন নিমিষেই। শিক্ষিতের চেয়ে কম লেখাপড়া জানা লোকেরা এতে আসক্ত হচ্ছেন বেশি। অনলাইনে বিভিন্ন জুয়ার প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট লীগ, ফুটবল লীগ নিয়েও জুয়া চলছে। অনেকে ক্রিকেটের বলে বলে চার-ছক্কা হওয়া নিয়ে ছোট থেকে বড় অঙ্কের জুয়া খেলছেন। ফুটবলে গোল হওয়া বা কোন দল জিতবে; তা নিয়েও জুয়া খেলা হচ্ছে। অনলাইনে নানা ধরনের নিত্যনতুন জুয়ার অ্যাপ প্রতিনিয়
মুহিবুল হাসান রাফি
তরুণ ও যুব সমাজে নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণের আসক্তির পাশাপাশি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে সময়ের নীরব ঘাতক অনলাইন জুয়া। শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এর দাপট অনেকটা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। এর প্রতিরোধ, প্রতিকার কিংবা তরুণ ও যুব সমাজে জনসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখার সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে আদৌ কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এটি এমন এক নেশায় পরিণত করে, যা বাসাবাড়ি, বাস-ট্রেন, ফুটপাত থেকে রিকশা গ্যারেজ, কর্মক্ষেত্র, ব্যবসা-বাণিজ্য পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছে। প্রায় কমবেশি সবশ্রেণির মানুষ এতে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছে।
মোবাইলে অ্যাপ নামিয়ে কিংবা চোখের সামনে ভেসে আসা জুয়ার লোভনীয় অফারে প্রলুব্ধ হয়ে অনেকে তৎক্ষণাৎ জড়িয়ে পড়ছেন নিমিষেই। শিক্ষিতের চেয়ে কম লেখাপড়া জানা লোকেরা এতে আসক্ত হচ্ছেন বেশি। অনলাইনে বিভিন্ন জুয়ার প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট লীগ, ফুটবল লীগ নিয়েও জুয়া চলছে। অনেকে ক্রিকেটের বলে বলে চার-ছক্কা হওয়া নিয়ে ছোট থেকে বড় অঙ্কের জুয়া খেলছেন। ফুটবলে গোল হওয়া বা কোন দল জিতবে; তা নিয়েও জুয়া খেলা হচ্ছে। অনলাইনে নানা ধরনের নিত্যনতুন জুয়ার অ্যাপ প্রতিনিয়তই খোলা হচ্ছে এবং এতে তরুণ সমাজ লোভনীয় অফারে আকৃষ্ট হয়ে পড়ছেন।
শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে তরুণ সমাজ অনলাইন জুয়ায় মগ্ন হচ্ছেন, তার প্রতিবেদন উঠে আসে পত্রিকায়। অনলাইন জুয়ার অ্যাপ ব্যবহার করে প্রতিদিন হাজার হাজার টাকা জুয়ায় নষ্ট করছেন। অনেকে আবার বড় অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করছেন। জুয়ার প্রতারণার ফাঁদে পড়ে তারা যেমন নিঃস্ব হচ্ছেন; ঠিক তেমনই তাদের পরিবারকে পথে নামাচ্ছেন। জুয়ায় হেরে হতাশ হয়ে মাদকাসক্ত ও বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন। দুটোই মানুষের মৃত্যুর পথ তৈরি করে। পত্রপত্রিকার খবরে প্রায়ই এই দুই নেশার কারণে খুন, ছিনতাই, চুরি-ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ার সংবাদ প্রকাশিত হয়। সংসারে অশান্তি সৃষ্টিসহ সংসার ভেঙে যাওয়ার খবরও দেখা যায়।
অনলাইন জুয়া নতুন কিছু নয়। তবে তা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ না থাকায় এর বিস্তৃতি মহামারি আকার ধারণ করেছে। এক সংঘবদ্ধ চক্র প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন অ্যাপ তৈরি করে লোভনীয় অফার দিয়ে তরুণদের জুয়ায় আকৃষ্ট করছে। হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল অঙ্কের অর্থ। এসব জুয়ায় তাদের সমীকরণে সবাই হেরে যায়। প্রতারক চক্র চালাকি করে দুয়েকজন, যারা তাদেরই লোক, তাদের জিতিয়ে দেখিয়ে অন্যদের প্রলুব্ধ করে, কাছে টেনে নেয় তরুণদের। হেরে যাওয়ার পর জেতার জেদ হয়, এই জেদ থেকে তৈরি হয় নেশা। ফলে নিঃস্ব হয়ে যায়, হতাশায় নিমজ্জিত হয়। অনলাইন জুয়াকে প্রমোট করার জন্য শোবিজ এবং ক্রিকেটের বেশ কয়েকজন তারকাকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হতে দেখা যায়। তাদের মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে বিজ্ঞাপন তৈরি করে অনলাইনে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এসব তারকার কথায় ভক্ত ও সাধারণ মানুষ প্রলুব্ধ হয়ে জুয়ায় জড়িয়ে পড়ছেন। তাদের করা বিজ্ঞাপন বিভিন্ন অশ্লীল সাইটেও ব্যাপক হারে প্রচার করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন
সময়ের পরিবর্তনে অবসর কাটানোর ধরন
যে হাটে সংসারের গল্প বিক্রি হয় রঙিন পসরা সাজিয়ে
উল্লেখ করা প্রয়োজন, দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি শোচনীয়। উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও আয় কমে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের জীবনযাপন দুর্বিসহ হয়ে পড়েছে। তাদের হাতে টাকা নেই। অসংখ্য মানুষ বেকার হয়ে গেছে। অতিদারিদ্র্যসীমা ক্রমেই বাড়ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পকারখানার উৎপাদনে স্থবিরতা বিরাজ করছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বলতে গেলে নেই। শেয়ার বাজার যতটুকু ছিল, তা-ও এখন নেই। শেয়ার বাজার চাঙা করতে কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হয়েছে। এখানে শত শত তরুণ যুক্ত ছিল। পুঁজি হারিয়ে তারা নিঃস্ব ও হতাশ হয়ে পড়েছেন। বিকল্প হিসেবে তাদের অনেকে অনলাইন জুয়ায় জড়িয়ে পড়েছেন। সেখানেও প্রতারণার ফাঁদে পড়ছেন। ব্যাংক খাতও ধুঁকছে। অনেক ব্যাংক দুর্বল হয়ে পড়ায় মানুষের আস্থা কমে গেছে। নিরাপদ মনে করছেন না। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সরকারের কাছে মানুষের যে প্রত্যাশা ছিল, তা পূরণ করতে পারছে না।
যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কর্মসংস্থানের পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকায় অর্থ উপার্জনের জন্য অবহেলিত বেকার তরুণ সমাজ অনলাইন জুয়ায় নিজেকে জড়িয়ে নিচ্ছেন। মানুষের থেকে চড়া সুদে টাকা ধার করে হলেও এসব জুয়ায় মেতে উঠছেন। এমনকি অনেকে সংসার চালানোর জন্য স্ত্রীর গহনা বিক্রি করে জুয়া খেলে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ছেন। অনেকে খেলছেন স্বর্ণালংকার ও জায়গা-জমি বন্ধক রেখে।এমনকি অনেক সময় নিজের প্রেমিকা কিংবা স্ত্রীকে পর্যন্ত বন্ধক রাখেন সামান্য কিছু টাকার জন্য। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জরুবি ভিত্তিতে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। পদক্ষেপ নেওয়ার কথা থাকলেও তা সীমাবদ্ধ কাগজে-কলমে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি যথাযথ পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে জুয়ার এই ভয়াবহ ছোবল থেকে সমাজকে রক্ষা করা যাবে না। জুয়ার সংঘবদ্ধ চক্রকে শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া অসম্ভব কিছু নয়। এরপরেও কয়েকজনকে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হলে ওপরমহল থেকে তাদের জামিনে নিয়ে একই কাজ করতে বাধ্য করা হয় কিংবা একই কাজে লিপ্ত হয়ে পড়েন। জুয়া প্রতিরোধ করতে অত্যন্ত কঠোর আইন করা দরকার, যা জামিনযোগ্য নয়। তাতে কিছুটা কিছু হলেও বিস্তৃতি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।
আইনের পাশাপাশি জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম করা এবং গ্রামে গ্রামে উঠান বৈঠক করা দরকার। পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেলসহ অনলাইন মাধ্যমে জুয়ার ক্ষতিকর দিক তুলে ধরা এবং তা থেকে বাঁচার উপায় নিয়ে প্রচার-প্রচারণা চালানো এবং অবসর সময়ে মনকে বিকশিত করার জন্য ক্রীড়াঙ্গণ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গণের দিকে আহ্বান জানাতে ক্রীড়া ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে যুগোপযোগী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। বেকারত্ব দূরীকরণে সরকারকে কর্মসংস্থান খাত তৈরি করে তরুণদের জন্য কর্মমুখী পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। তাহলে নীরব ঘাতক থেকে সর্বস্তরের জনগণকে একটুখানি হলেও বের করে আনা সম্ভব হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজ।
এসইউ
What's Your Reaction?