অযত্নে ভুগছে গাজীপুর সাফারি পার্ক, ধুঁকছে প্রাণী

3 days ago 3

জীববৈচিত্র সমৃদ্ধ গাজীপুর সাফারি পার্ক ক্রমেই তার জৌলুস হারাচ্ছে। এক সময় যেখানে সাধারণ মানুষের ব্যাপক সমাগম হতো, এখন সেখানে দর্শনার্থী হাতেগোনা। এর জন্য অব্যবস্থাপনা, প্রাণীদের প্রতি অবহেলা আর সঠিক তদারকির অভাবকে দায়ী করেছে সাধারণ মানুষ।

ঢাকা ও আশপাশের এলাকা থেকে সারাদিন পরিবার নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর একটি আদর্শ জায়গা এই সাফারি পার্ক। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অভাবে বহু স্থাপনা নষ্ট ও বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী মারা যাওয়াসহ রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ছে। এতে দিন দিন কমছে দর্শনার্থী। বর্তমানে পার্কে বেহাল অবস্থা দেখা দিয়েছে।

জানা গেছে, গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের ইন্দ্রপুরে ৪ হাজার ৯০৯ একর ভূমির মধ্যে ৩ হাজার ৮১৯ একর জায়গাজুড়ে গড়ে ওঠা সাফারি পার্কটি ছোট ছোট টিলা ও শালবন সমৃদ্ধ। থাইল্যান্ডের সাফারি ওয়ার্ল্ডের অনুকরণে তৈরি সাফারি পার্কটি ২০১৩ সালে চালু করা হয়। এই সাফারি পার্কের অন্যতম আকর্ষণ কোর সাফারি। পুরো পার্কটি স্কয়ার, কোর সাফারি পার্ক, বায়োডাইভার্সিটি পার্ক, সাফারি কিংডম, এক্সটেনসিভ এশিয়ান সাফারি পার্ক নামক ৫টি অংশে বিভক্ত।

‘সুন্দর একটা পরিবেশ উপভোগ করার জন্য মানুষ এখানে আসে। কিন্তু এখানে প্রত্যেকটা প্রাণী দেখে মনে হচ্ছে অগোছালো অবস্থায় রয়েছে। ভেতরে একটি মাত্র বাঘ দেখলাম তাও রোগা হয়ে রয়েছে। অনেক খাঁচা আছে পাখি নেই।’

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় পার্কটিতে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। এর মূল ফটক, মুর‌্যাল, প্রাণী জাদুঘর, পাখিশালা, পার্ক অফিসসহ বিভিন্ন খাবারের দোকানে ভাঙচুর চালানো হয়। লুটপাট করা হয় খাবারের দোকানের মালামাল, বৈদ্যুতিক মোটর, ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা, চেয়ার, টেবিলসহ নানা সরঞ্জাম। ভাঙা হয় রেস্ট হাউসের জানালার কাঁচ ও পর্যবেক্ষণে ব্যবহৃত দুটি জিপ গাড়ি। এর ৩ মাস ৯ দিন পর দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয় গাজীপুর সাফারি পার্ক।

আরও পড়ুন-

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পার্কে যেমন প্রাণী মৃত্যু ঘটছে তেমনই দেওয়া হচ্ছে রাজস্ব ফাঁকি। অব্যবস্থাপনা ও অবহেলার কারণে একের পর এক প্রাণীর মৃত্যু, ভেতরে নোংরা, ঘাস বড়সহ গজার গাছে লতা পেঁচিয়ে অন্ধকার হয়ে গেছে। চলতি বছরের গত ১৬ জানুয়ারি পার্কের দেওয়াল টপকে পালিয়ে যায় একটি নীলগাই। এর আগে ২০২১ সালেও একটি নীলগাই পালিয়ে গিয়েছিল। ২০২১ সালের ২৭ ডিসেম্বর পার্কে একটি সিংহ ও একটি ওয়াইল্ডবিস্ট মারা যায়। ২০২২ সালের জানুয়ারি- ফেব্রুয়ারিতে ১১টি জেব্রা, একটি বাঘ ও একটি সিংহের মৃত্যু হয়।

২০২৩ সালের ২০ অক্টোবর মারা যায় একটি জিরাফ। ২০২১ সালে পার্কে তিনটি ক্যাঙ্গারু মারা যাওয়ার পর থেকে ক্যাঙ্গারুশূন্য হয়ে যায় কোর সাফারি। এছাড়া লেকগুলো একসময় ব্ল্যাক ও হোয়াইট সোয়ানে পরিপূর্ণ থাকলেও বর্তমানে একটিও নেই।

‘পার্কের মধ্যে অনেক কিছু পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে, হরিণের বেষ্টনীতে খাবার নেই, ঘোড়াটা শুকিয়ে গেছে। বোঝাই যাচ্ছে দায়িত্বে থাকারা পশু-প্রাণীগুলোর স্বাস্থ্যের বিষয়ে অবহেলা করছেন।’

সরেজমিনে দেখা গেছে, পার্কে শতাধিক প্রজাতির প্রাণী থাকার কথা থাকলেও তা নেই। পার্কে বর্তমানে ১টি জিরাফ, ৪২টি জেব্রা, ১১টি ওয়াইলবিস্ট, ৭টি বাঘ, ৪টি সিংহ, ২২টি ভালুক, ২ শতাধিক হরিণ, ১১টি গয়াল, ৯টি নীলগাই, ৫টি সাম্বার হরিণ, ৩টি কমন ইলন, ১৫টি মায়া হরিনসহ হাতি, ঘোড়া, ম্যাকাউ, ময়ুর, ময়না, শকুন, ধনেশ, মদনটাক, প্যালীকেনসহ কয়েক প্রজাতির প্রাণী, পাখি ও সরিশ্রিপ রয়েছে। এছাড়া দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে শিশু পার্কসহ অনেকগুলো স্থান একেবারেই বন্ধ রাখা হয়েছে।

ভেতরে কোর সাফারির চার কিলোমিটার সড়কে বিশেষ বাসে চড়ে বাঘ সিংহ ভালুকসহ বিভিন্ন আফ্রিকান প্রাণী পর্যবেক্ষণ করেন দর্শনার্থীরা। ওই সড়কের তিন কিলোমিটার কাদা-জল আর খানাখন্দে ভরে গেছে। সড়কের বিভিন্ন স্থানে দেবে গেছে। সৃষ্টি হয়েছে খানাখন্দ আর গভীর খাদ। ঝুঁকি নিয়ে দর্শনার্থী বহন করে থাকে বাসগুলো। মূলত মানুষ এসব প্রাণীগুলো দেখতে বা বাচ্চাদের দেখাতে পরিবারসহ আসেন সাফারি পার্কে। কিন্তু প্রতিনিয়ত দর্শনার্থীরা এসে হতাশ হচ্ছেন।

অযত্নে ভুগছে গাজীপুর সাফারি পার্ক, ধুঁকছে প্রাণী

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পার্কের একজন কর্মচারী জানান, পার্কে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা চলছে দীর্ঘদিন। পূর্বে পার্কটির বিভিন্ন প্রকল্প ইজারা দেওয়া হয়েছিল। সরকার পতনের পর থেকে তারা পলাতক। প্রবেশগেটে দলবদ্ধভাবে ঘুরতে আসা স্কুল-কলেজ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শতাধিক মানুষ এলে ৩০-৪০ জনের টিকিট কেটে বাকি টিকিটের টাকার হদিস থাকে না।

এছাড়া পার্কে সিকিউরিটি, টিকিটম্যানসহ বনের লোকদের যোগসাজসে ভেতরে দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরিয়ে দেখানোর কথা বলে চুক্তি করে গাইড পরিচয় দেওয়া এক শ্রেণির দালাল। পার্কে প্রবেশে ফি ছাড়া দর্শনাথীদের প্রতিটি দর্শনীয় স্থানে মাথাপিছু ফের কাটতে হয় টিকিট। কিন্তু ওই দালালরা ৯টি স্থান ৪০০ টাকায় ঘুরিয়ে দেখানোর কথা বলে চুক্তি করে নিয়ে ভেতরে ঢুকে যায়। অথচ ওই ৯টি স্থান ঘুরতে প্রতি দর্শনাথীর গুণতে হতো প্রায় ৮০০ টাকার মতো।

পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঢাকা থেকে ঘুরতে আসা রফিকুল ইসলাম বলেন, পার্কের মধ্যে অনেক কিছু পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে, হরিণের বেষ্টনীতে খাবার নেই, ঘোড়াটা শুকিয়ে গেছে। বোঝাই যাচ্ছে দায়িত্বে থাকারা পশু-প্রাণীগুলোর স্বাস্থ্যের বিষয়ে অবহেলা করছেন। এছাড়া দর্শনীর্থীদের বসার কোনো যায়গা নেই বা ওয়াক ওয়েগুলো ভালো না।

‘প্রবেশগেটে দলবদ্ধভাবে ঘুরতে আসা স্কুল-কলেজ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শতাধিক মানুষ এলে ৩০-৪০ জনের টিকিট কেটে বাকি টিকিটের টাকার হদিস থাকে না।’

দর্শনার্থী রমজান হোসেন বলেন, সুন্দর একটা পরিবেশ উপভোগ করার জন্য মানুষ এখানে আসে। কিন্তু এখানে প্রত্যেকটা প্রাণী দেখে মনে হচ্ছে অগোছালো অবস্থায় রয়েছে। যেভাবে থাকা দরকার সেভাবে নেই। ভেতরে একটি মাত্র বাঘ দেখলাম তাও রোগা হয়ে রয়েছে। অনেক খাঁচা আছে পাখি নেই। ঢুকতে ৫০ টাকা আবার প্রতিটি দর্শনীয় স্থানে ফের টিকিট কাটতে হচ্ছে। কিন্তু যতটুকু দেখে মনমুগ্ধ হওয়া উচিৎ সেটা নেই।

পার্কের গেইটের বাইরে ভাতের হোটেলের মালিক আবুল কালাম বলেন, বর্তমানে পার্কে কোনো দর্শনার্থী আসে না বললেই চলে। শুধু শুক্রবার কিছু মানুষ আসে। অন্যান্য দিন মাঝে মাঝে দোকান বন্ধও রাখতে হয়।

দায়িত্বে থাকা বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) রফিকুল ইসলাম বলেন, পার্কের কিছু সংস্কার করা হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পার্ক নিয়মিত খোলা রয়েছে। পার্কের মূল ফটকসহ বিভিন্ন অংশের ইজারা প্রক্রিয়াধীন। চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত সরকারি ব্যবস্থাপনায় পার্কের কার্যক্রম চলমান থাকবে। পার্কের অনুকূল পরিবেশে বিভিন্ন পশু পাখি প্রজনন করছে। আমরা চেষ্টা করছি। পার্কের সমস্যাগুলোর বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অবগত আছেন।

বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের ঢাকা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) শারমীন আক্তার বলেন, পার্কের রাস্তার বিষয়ে দায়ীত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে তথ্য দিতে বলা হয়েছে। পেলেই দরপত্র আহ্বান করে দ্রুত রাস্তার সংস্কার করা হবে।

এফএ/এমএস

Read Entire Article