অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে টিকে থাকার জ্ঞান ও কৌশল

2 months ago 7

অর্থনীতি কখনোই একরৈখিক নয়। কখনো তা ঊর্ধ্বমুখী প্রবাহে চলে, আবার কখনো বা গভীর মন্দায় নিমজ্জিত হয়। মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি কিংবা বৈশ্বিক সংকট—এসবই একটি দেশের অর্থনীতিকে অস্থির করে তোলে। আর এই অস্থিরতা সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে সাধারণ মানুষের জীবনে। তাই এই সময়ে অর্থনৈতিক সচেতনতা ও সঠিক ব্যক্তিগত অর্থ ব্যবস্থাপনা হয়ে ওঠে জরুরি অস্ত্র।

আমাদের জীবনে অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব

যখন একটি দেশের অর্থনীতি মন্দার দিকে যায়, তখন চাকরির বাজার সংকুচিত হয়, পণ্যের দাম বেড়ে যায়, আয় স্থির থাকে বা কমে যায় এবং অনিশ্চয়তা বাড়ে। বাংলাদেশে যেমন ২০২৩-২৪ সালে মুদ্রাস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট মানুষকে আতঙ্কে ফেলেছিল, তেমন সময়েই দেখা যায় মানুষ সবচেয়ে বেশি হোঁচট খায় তাদের ব্যয়ের অভ্যাসে। অনেকেই ঋণে জড়িয়ে পড়ে, কেউবা সঞ্চয় ভেঙে টিকে থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু পূর্বপ্রস্তুতি থাকলে এই ধাক্কা অনেকটা সামলানো যায়।

মন্দার প্রথম প্রতিরক্ষা হচ্ছে ব্যক্তিগত বাজেট

অর্থনৈতিক দুর্দিনে ‘বাজেট’ হয়ে ওঠে জীবনরক্ষার ব্লুপ্রিন্ট। আপনি যদি মাসের শুরুতেই আয়ের অনুপাতে ব্যয় পরিকল্পনা করেন, তাহলে অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে টিকে থাকতে পারবেন। এই সময় বিলাসী খরচ, অনিয়ন্ত্রিত অনলাইন শপিং, ঘন ঘন খাওয়া-দাওয়ার বিল—এসব কাটছাঁট করা জরুরি। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির ব্যবহারেও সচেতনতা আনতে হবে। বাজেটে “জরুরি তহবিল” বা ‘ইমার্জেন্সি ফান্ড’ রাখা অবশ্যই দরকার।

জরুরি তহবিল হচ্ছে অচেনা ঝুঁকির বিরুদ্ধে ঢাল

বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, একজন ব্যক্তির ন্যূনতম তিন থেকে ছয় মাসের ব্যয়ের সমপরিমাণ একটি জরুরি তহবিল থাকা উচিত। মন্দার সময় চাকরি চলে যাওয়া, হঠাৎ অসুস্থতা বা অন্য কোনো আর্থিক বিপর্যয়ে এই সঞ্চয় আপনাকে রক্ষা করতে পারে। কেউ যদি এখনো এই তহবিল তৈরি না করে থাকেন, তবে অবিলম্বে তা শুরু করা উচিত, যদিও তা খুব ছোট অঙ্ক দিয়েই হোক।

ঋণ ব্যবস্থাপনা করে সুদের বোঝা কমানো জরুরি

অর্থনৈতিক মন্দায় ঋণের সুদ হার বাড়তে পারে, আয় কমে যেতে পারে, ফলে ঋণের কিস্তি শোধ করাও কঠিন হয়ে পড়ে। তাই এই সময়ে প্রথম কাজ হওয়া উচিত—উচ্চ সুদের ঋণ যেমন ক্রেডিট কার্ড বা ব্যক্তিগত ঋণ আগে শোধ করা। যদি ঋণ নেওয়াই লাগে, তবে খুব হিসেব করে, স্থির আয়ের উৎস বিবেচনায় নিয়ে তবেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অপ্রয়োজনীয় নতুন ঋণ একেবারেই এড়িয়ে চলতে হবে।

আয় বৃদ্ধির বিকল্প উৎস তৈরি করা দরকার

অর্থনৈতিক সংকট কেবল খরচ কমানোর বিষয় নয়, বরং আয় বাড়ানোর দিকেও গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। আপনি যদি একটি নির্দিষ্ট চাকরির উপর নির্ভরশীল থাকেন, তবে একটি পার্ট-টাইম অনলাইন কাজ, ফ্রিল্যান্সিং, বা নিজের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে কোচিং বা কনসালটিং-এর মতো কাজ শুরু করতে পারেন। এ সময় আয়-বৃদ্ধির বিকল্প খোঁজা মানে হলো ঝুঁকি কমিয়ে আত্মনির্ভরতা গড়ে তোলা।

বিনিয়োগে বিচক্ষণতা ও ধৈর্য

অনেকেই ভয় পেয়ে অর্থনৈতিক মন্দায় শেয়ার বাজার বা মিউচুয়াল ফান্ড থেকে সরে আসেন। কিন্তু সঠিক জ্ঞান ও গবেষণার মাধ্যমে এই সময়েই বিনিয়োগের জন্য ভালো সুযোগ তৈরি হয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যেসব বিনিয়োগকারী মন্দায়ও স্থির থেকেছেন, তারা দীর্ঘমেয়াদে লাভবান হয়েছেন। তাই আবেগ নয়, তথ্যনির্ভর সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি।

নিজের প্রতি বিনিয়োগ করুন

মন্দার সময় পেশাগত প্রতিযোগিতা বেড়ে যায়। তাই নিজের দক্ষতা বাড়াতে হবে। প্রয়োজনীয় দক্ষতা আপনাকে বাজারে আরও প্রতিযোগিতামূলক করে তুলবে। দক্ষতা কখনো অবমূল্যায়িত হয় না। বরং, এটি হয় আপনার সবচেয়ে লাভজনক বিনিয়োগ।

পরিবারকে যুক্ত করুন অর্থ ব্যবস্থাপনায়

ব্যক্তিগত অর্থনীতি কখনো একক ব্যাপার নয়—পরিবারের সবাইকে এই সংকট বুঝতে ও সহযোগিতা করতে হবে। সন্তানদেরও শেখাতে হবে অর্থের মূল্য ও সঞ্চয়ের গুরুত্ব। একসাথে পরিকল্পনা করলে খরচ নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয় এবং মানসিক চাপও কমে।

সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করা প্রয়োজন

অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা মানুষের মনে ভয়, হতাশা ও চাপ সৃষ্টি করে। তাই নিজেকে মানসিকভাবে শক্ত রাখাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। পরিবার, বন্ধু, অথবা কাউন্সেলরের সাহায্য নেওয়া একেবারেই দুর্বলতা নয়—বরং সচেতনতার পরিচয়। জীবনের অস্থির সময়ে শান্ত থাকা নিজেই এক বড় শক্তি।

অর্থনৈতিক মন্দা জীবনের একটি ধাপ। এটি অমোঘ সত্য হলেও, তার মোকাবিলা করার জন্য আমাদের হাতে রয়েছে জ্ঞান, কৌশল ও সদিচ্ছা। যারা সচেতনভাবে আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখে, প্রয়োজন অনুযায়ী খরচ করে, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় অটুট থাকে—তারা এই মন্দাকালেও স্থির থাকতে পারে।

অর্থ ব্যবস্থাপনা শুধু টাকা জমানোর বিষয় নয়, এটি হলো জীবন ব্যবস্থাপনা। তাই আজ থেকেই শুরু করুন আপনার বাজেট, কাটছাঁট করুন অপ্রয়োজনীয় খরচ, গড়ে তুলুন বিকল্প আয়, তৈরি করুন জরুরি তহবিল, আর নিজের দক্ষতায় বিনিয়োগ করুন।

মনে রাখবেন, অর্থনৈতিক ঝড় আসে, কিন্তু প্রস্তুত মানুষগুলো সেই ঝড় সামলে নতুন করে পথচলা শুরু করে।

লেখক : কলামিস্ট, ইউটিউবার এবং ফাইনান্স ও বিজনেস স্ট্রাটেজিস্ট অ্যান্ড সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশিপ ইন্টারন্যাশনাল।

এইচআর/এমএস

Read Entire Article