অস্থির নেপালের হাল ধরা কে এই সুশীলা কার্কি?

17 hours ago 4

বিক্ষোভ-সংঘর্ষে উত্তালের নেপালে সরকারের পতন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার পর কিছুটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে। সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে দেশটির অন্তর্বর্তী সরকারের নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন সুশীলা কার্কি। প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও ইতিহাস গড়েছেন তিনি।

স্থানীয় সময় শুক্রবার (১২ সেপ্টেম্বর) রাজধানী কাঠমান্ডুতে প্রেসিডেন্ট ভবনে শপথ নেন তিনি। দেশটিতে চলমান অনিশ্চয়তার মধ্যে জেন-জি আন্দোলনকারীদের দাবি অনুযায়ী, তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেন প্রেসিডেন্ট রাম চন্দ্র পৌডেল।

শপথ গ্রহণের সময় অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট রাম সহায় যাদব, প্রধান বিচারপতি প্রকাশ মান সিং রাওয়াত এবং সেনাপ্রধান অশোক রাজ সিগদেল।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ থেকে নেপালে তিন দিনের টানা বিক্ষোভে প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি সরকারের পতন হয়। এরপর বুধবার আন্দোলনকারীরা কার্কিকে নতুন প্রধানমন্ত্রী করতে সমঝোতায় পৌঁছেছে বলে মনে হলেও অনেকের মধ্যেই মতপার্থক্য দেখা দেয়। নেপালের বিদ্যুৎ সংকট কাটিয়ে তোলার জন্য বিখ্যাত প্রকৌশলী কুল মান ঘিসিংকেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন অনেকেই।

বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর) এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে ‘জেন জেড’ আন্দোলনকারী দল জানায়, সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কি ছাড়াও অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রীর পদে কুল মান ঘিসিং ছাড়াও কাঠমান্ডুর মেয়র বালেন শাহ ও নাম বিবেচনায় আনা হয়েছিল। আন্দোলনকারীদের ছয় ঘণ্টার একটি ভার্চুয়াল বৈঠকে এই আলোচনা হয়।

ঘিসিংয়ের সম্ভাব্য নিয়োগকে কেন্দ্র করে আন্দোলনকারীদের মধ্যে মতপার্থক্যের খবরও সামনে আসে। জানা গেছে, আন্দোলনকারীদের প্রথম পছন্দ ছিলেন বালেন শাহ। তবে তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দিতে অস্বীকৃতি জানান। তরুণদের মাঝে জনপ্রিয় এই র‍্যাপার মেয়র সামাজিক মাধ্যমে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন।

এক বিবৃতিতে তার নামও প্রস্তাব করেছিলেন আন্দোলনকারীরা। কুলমানের নাম উঠে আসায় কিছুটা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল। আর এরও আগে ওলি সরকারের পতনের পরই প্রাথমিকভাবে নাম শোনা গিয়েছিল রাজধানী কাঠমাণ্ডুর নির্দল মেয়র ও জনপ্রিয় র‌্যাপার বলেন্দ্র শাহের।

এরপর আন্দোলনকারীরা কার্কির নাম প্রস্তাব করেন। কিন্তু আন্দোলনের একাংশ আবার কার্কিকে প্রত্যাখ্যান করে। তাদের যুক্তি, সংবিধান অনুযায়ী সাবেক বিচারপতিরা প্রধানমন্ত্রীর পদে আসতে পারেন না এবং ৭৩ বছর বয়সী কার্কি নেতৃত্বের জন্য অতিরিক্ত বয়স্ক। তবে সব মতপার্থক্য ছাপিয়ে শেষ পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে শপথ নিয়েছেন সুশীলা কার্কি।

বিচারপতি থেকে সরকারপ্রধান
নেপালে বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার ৬৫ বছরেরও বেশি সময়ের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর এবার দেশটির ৭৫ বছরের গণতন্ত্রের ইতিহাসে আনুষ্ঠানিক নিয়োগের মাধ্যমে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী (অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান) হলেন সুশীলা কার্কি।

এমন একটি সময় তিনি প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন, যখন দীর্ঘদিন ধরে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা হয়নি এবং উচ্চ আদালত গঠনসহ প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছিল বিচার বিভাগ। এছাড়াও সুপ্রিম কোর্টে মামলার জট বেশি থাকা এবং বিচারকের কম সংখ্যা নিয়েও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিল বিচার বিভাগ।

এমন নানা কারণে সে সময় তাকে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছিল বলে উল্লেখ করেছিলেন তার পূর্বসূরিরাও। যদিও কিছু বিতর্ক ছাড়া, তার মেয়াদকাল নিয়ে খুব বেশি প্রশ্ন তোলেননি সাধারণ মানুষ।

কিন্তু এখন অপ্রত্যাশিত ও অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে তিনিই দেশটির অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছেন। বর্তমানে তার বয়স ৭৩ বছর।

নেপালের বিরাটনগরে জন্ম নেওয়া এই নারী ভারতের বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় এবং নেপালের ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন। এরপরই যোগ দেন আইন পেশায়।

বলা হয়, সেই সময়ে একজন নারীর পক্ষে আইন পড়া এবং আইন অনুশীলন করা অস্বাভাবিক ছিল। বিরাটনগর এবং ধরণে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে সক্রিয়ভাবে ওকালতি করার পর, তিনি সরাসরি বিচারক হিসেবে প্রবেশ করেন সুপ্রিম কোর্টে।

তৎকালীন প্রধান বিচারপতি রাম প্রসাদ শ্রেষ্ঠা বলেছিলেন যে তিনি সুশীলা কার্কির সম্ভাবনা দেখেই তাকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হিসেবে সুপারিশ করেছিলেন।

নেপালের কংগ্রেস নেতা এবং দেশটির সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী জেপি গুপ্তকে দুর্নীতির মামলায় দোষী সাব্যস্ত করার পর বিচারক হিসেবে আলোচনায় আসেন সুশীলা কার্কি। বেশিরভাগ সময় তাকে দুর্নীতির মামলা শুনানি করতে হয়েছে।

সেসময় একটি মামলা পুনর্বিবেচনার জন্য তৎকালীন কমিশন ফর দ্য ইনভেস্টিগেশন অব অ্যাবিউজ অব অথরিটির (সিআইএএ) প্রধানের দায়ের করা আবেদনের প্রেক্ষিতে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন সুশীলা কার্কি।

পরবর্তীতে তিন বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ, তাকে বাদ দিয়ে লোকমান সিং কার্কিকে পদ থেকে অপসারণের সিদ্ধান্ত নেয়। লোকমান সিং কার্কির ওই মামলা পুনর্বিবেচনার জন্য পুনরুজ্জীবিত করতে সুশীলা কার্কির সিদ্ধান্ত সে সময়ে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছিল। সে সময় বৈষম্যের মাধ্যমে নারীর প্রতি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অভিযোগও আনা হয়েছিল তার বিরুদ্ধে।

বিতর্ক এবং আলোচনা
নেপালের সাবেক ক্ষমতাসীন জোটের (নেপালি কংগ্রেস এবং মাওইস্ট সেন্টার) সংসদ সদস্যরা সংসদে সুশীলা কার্কির বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রস্তাব দাখিল করলে তাকে প্রধান বিচারপতির পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়।

তবে সুপ্রিম কোর্টের আদেশে এই অভিশংসন প্রস্তাবকে অকার্যকর ঘোষণা করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ জারি করেছিলেন তৎকালীন বিচারপতি চোলেন্দ্র শমসের রানা।

তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সুযোগ দেওয়া এবং বিচারক নিয়োগের সময় নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছিল।

এছাড়া খিলরাজ রেগমি প্রধান বিচারপতি থাকা অবস্থায়, মন্ত্রিপরিষদের চেয়ারম্যান করার বিষয়েও সুশীলা কার্কি এবং তৎকালীন প্রধান বিচারপতি কল্যাণ শ্রেষ্ঠা তাদের মতামত জানিয়েছিলেন। সেখানে রেগমিকে মন্ত্রিপরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত করা অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধানের চেতনার পরিপন্থি বলে উল্লেখ করেছিলেন তারা।

সে সময় এ নিয়েও সমালোচনা হয়েছিল যে, বর্তমান প্রধান বিচারপতি নির্বাহী শাখার প্রধান হয়ে গেছেন, যা ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের নীতি লঙ্ঘন করে।

অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে আলোচনায় আসার পর, সুশীলা কার্কির আগের এই সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করে অনেকেই এখন তার সমালোচনা করছেন।

কিন্তু কেউ কেউ যুক্তি দিয়েছেন যে বর্তমান প্রধান বিচারপতির নির্বাহী বিভাগের প্রধান হওয়া এবং অবসর গ্রহণের পর বিক্ষোভকারীদের দাবি অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হওয়া এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরালো বার্তা দেওয়ায় নিজের খ্যাতি কিংবা তাকে নিয়ে বিতর্ক, এই দুইয়ের মধ্যে কঠিন পরিস্থিতিতে আশার আলো হিসেবে কাজ করাই এখন সুশীলা কার্কির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগ হিসেবেই মনে করা হচ্ছে।

সূত্র: খবরহাব, বিবিসি

টিটিএন

Read Entire Article