দেশের বিভিন্ন এলাকায় বালু, কয়লা, পাথরসহ নানান খনিজ সম্পদ অবৈধ ও যথেচ্ছভাবে উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। এসব ঘটনায় আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কোনো নজির নেই বললেই চলে। স্থানীয় প্রশাসন মাঝে মাঝে অভিযান চালালেও তা দীর্ঘস্থায়ী কোনো প্রভাব ফেলতে পারছে না।
আইনজ্ঞরা বলছেন, শুধু আইন থাকলেই হবে না, তার যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরি। আইনে কঠোর শাস্তির বিধান (জেল বা কারাদণ্ডের মতো) না থাকায় অবৈধ খনন বা খনিজ সম্পদের অপচয় রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
যত দূর চোখ যেতো শুধু পাথর আর পাথর–একসময় যেখানে এমন দৃশ্য ছিল এখন সেখানে ছোট-বড় অসংখ্য গর্ত আর ধু ধু চর। বছরের পর বছর ধরে অবৈধ খনন আর লুটপাটের কারণে পাথরসাম্রাজ্য সিলেটের কোয়ারি ও নদ-নদীগুলো এখন পাথরশূন্য প্রায়।
অভিযোগ আছে, স্থানীয় প্রশাসনের নির্লিপ্ততার কারণে সেসব এলাকায় পাথর লুট বন্ধ করা যাচ্ছে না। আইনে জরিমানার মতো ঢিলেঢালা শাস্তিতে দৌরাত্ম্য না কমে উল্টো পেট বাড়ছে পাথরখেকোদের। এক্ষেত্রে লুটপাট বন্ধে আইনে কঠোর শাস্তির বিধান যুক্ত করার পরামর্শ পরিবেশ আইনবিদদের।
প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করে পাথর হরিলুটের এ মহোৎসব সবচেয়ে বেশি প্রকাশ্যে আসে গত বছর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর। বিশেষত, সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্রে পাথর লুটের ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে সারাদেশে ব্যাপকভাবে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। এসব লুটপাটের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় প্রভাবশালীদের সম্পৃক্ততার তথ্য উঠে আসে।
এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যম ও বিভিন্ন মহল সরব হয়ে উঠলে নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। লুট হওয়া সাদাপাথর উদ্ধারে তৎপর হঠে উঠে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। শুরু হয় দুদকের তদন্ত ও অভিযান, পাথর লুটকারীদের বিরুদ্ধে মামলা, প্রশাসনের বদলি, পাথর নিয়ে গণশুনানি এবং উচ্চ আদালতে রিটসহ নানা পদক্ষেপ। এরপর শুরু হয় যৌথ অভিযানে পাথর উদ্ধার ও সেগুলো প্রতিস্থাপনের কাজ।
আইন থাকলেও শাস্তির সুর্নিদিষ্ট কোনো বিধান বা দণ্ড উল্লেখ না থাকার সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা। আইনে বিধি প্রণয়নের সময় তিন বছরের শাস্তির বিধান যুক্ত করার কথা বললেও আদৌ তা করা হয়নি
তবে এসব পদক্ষেপেও শেষ পর্যন্ত পরিবেশের ওপর আঘাত থামছে না। অপরাধীদের লাগামহীন দৌরাত্ম্যে দিন দিনই ঝুঁকিতে পড়ছে দেশের পর্যটনশিল্প। এসব ক্ষেত্রে আইন থাকলেও শাস্তির সুর্নিদিষ্ট কোনো বিধান বা দণ্ড উল্লেখ না থাকার সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা। আইনে বিধি প্রণয়নের সময় তিন বছরের শাস্তির বিধান যুক্ত করার কথা বললেও আদৌ তা করা হয়নি।
আরও পড়ুন
- শ্রীপুর কোয়ারিতে পাথর লুটের আড়ালে বালুও সাবাড়
- উৎমা ‘পাথর কোয়ারি’ এখন ‘ফুটবল মাঠ’
- পাথর লুটে ক্ষতি নিরূপণে কমিটি গঠন-জড়িতদের তালিকা হচ্ছে
এ প্রসঙ্গে একজন আইনজীবী বলছেন, ‘আইন থাকার পরও যদি অপরাধীরা শাস্তি না পায়, তাহলে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে। রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষায় আইনে জরুরি ভিত্তিতে কঠোর শাস্তিমূলক ধারা যুক্ত করতে হবে।’
পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিবছর অবৈধভাবে উত্তোলিত বালু-পাথরের কারণে দেশের নদী ও পরিবেশের ভয়াবহ ক্ষতি হচ্ছে। অথচ খনি ও খনিজ সম্পদ আইন বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের গাফিলতির কারণে দায়ীরা পার পেয়ে যাচ্ছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, খনিজ সম্পদ রক্ষা ও যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে সরকার চাইলে রাজস্ব আয় কয়েকগুণ বাড়াতে পারে। তবে এর জন্য আইনের ফাঁকফোকর দূর করে বাস্তবায়নে কঠোরতা আনা জরুরি।
কঠোর শাস্তির বিধান ছাড়া ফিরবে না শৃঙ্খলা
সিলেটে নজিরবিহীন পাথর লুটপাটের ঘটনায় হতাশা ও আক্ষেপ প্রকাশ করেন খোদ পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, ‘আগের সরকারের আমলে চার বছর জাফলংয়ে পাথর উত্তোলন বন্ধ রাখতে পেরেছিলাম, এখন আমি উপদেষ্টা হয়েও ঠেকাতে পারলাম না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দ মামুন মাহবুব জাগো নিউজকে বলেছেন, ‘পরিবেশ উপদেষ্টার যে হতাশা এটিতো শুধু একজন উপদেষ্টা বা সরকারের অসহায়ত্ব না, এটি পুরো রাষ্ট্রেরই হতাশা। রাষ্ট্র যে ঠিকমতো চলছে না, সরকার যে ঠিকমতো চালাতে পারছে না এটিতো তারই নমুনা।’
‘সংবিধানের ১৮-এর (ক) অনুচ্ছেদে পরিষ্কার বলা আছে, রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন, প্রাকৃতিক সম্পদ জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের নিরাপত্তা দেবে। এটি আমাদের ফান্ডামেন্টাল প্রিন্সিপালে আছে। রাষ্ট্রের মূল নীতিমালা এবং সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন। তারপর তো খনি ও খনিজ সম্পদ, পরিবেশ ও জলাধার আইনও আছে। এসব অপরাধের ক্ষেত্রে শুধু বিচার না, দৃষ্টান্তমূলক বিচার হওয়া দরকার।’
পাথর লুট নিয়ে পরিবেশ উপদেষ্টার হতাশা শুধু একজন উপদেষ্টা বা সরকারের অসহায়ত্ব না, এটি পুরো রাষ্ট্রেরই হতাশা। রাষ্ট্র যে ঠিকমতো চলছে না, সরকার যে ঠিকমতো চালাতে পারছে না এটিতো তারই নমুনা।- সৈয়দ মামুন মাহবুব
এ আইনজীবী আরও বলেন, ‘প্রায় দেড় কোটি বর্গফুটের মতো পাথর লুট হয়েছে। যৌথ অভিযানে অনেক পাথর উদ্ধার হলেও মূল অপরাধীরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। অথচ গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকেই এ হরিলুট চলছে।’
‘সেখানে তো ডিসি, এসপি, ইউএনও এবং সংশ্লিষ্ট থানার ওসি, পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং জলাধারের কর্মকর্তারা থাকেন। তদন্ত করে লুটপাটে জড়িতদের শাস্তির আওতায় না আনতে পারলে রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা থাকবে না। ল‘ অ্যান্ড অর্ডার তো দূরে, আমরা একটি জঙ্গল রাজ্যে পরিণত হবো।’
মামুন মাহবুবের ভাষ্য, ‘শৃঙ্খলা ফেরাতে হলে এসব লুটপাটের ঘটনায় ক্ষতিপূরণ চিহ্নিত করতে হবে। ফৌজদারি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে হবে। মাফিয়াদের চিহ্নিত করে তাদের সাজার পাশাপাশি ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে।’
নেই যথাযথ কর্তৃপক্ষ
পাথর লুটের বিষয়ে পরিবেশ আইন বিশেষজ্ঞ আমাতুল করিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘যারা জুলোজি, টপসয়েল ও ওয়াটার সোর্স নিয়ে কাজ করেন তাদের কো-অর্ডিনেশনের চরম অভাব। পরিবেশ অধিদপ্তর বা বিশেষজ্ঞদের কো-অর্ডিনেশন না থাকায় রিসোর্স সম্পর্কে মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং ডেভেলপ করে। যেগুলো ক্রমাগত দেশের সম্পদ হিসেবে ব্যবহার করতে পারি সেদিকে না গিয়ে এর বিরুদ্ধে চলা শুরু হয়।’
তিনি বলেন, ‘স্থানীয়ভাবে পাথর, মাটি বা বালি এগুলোর দায়িত্ব দেওয়া হয় জেলা প্রশাসককে (ডিসি)। এখানে বস্তুর ওপর ভিত্তি করে দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়। তবে আমি যেটা বলছি, অর্থাৎ যথাযথ কর্তৃপক্ষ নেই। তত্ত্বাবধানের চরম অভাব আছে। পলিসিগত সিদ্ধান্তগুলোও যথাযথভাবে হয় না। যা রাষ্ট্রের জন্য খুবই দুর্ভাগ্যের।’
‘স্থানীয় প্রশাসনেরও দায় আছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। তাদের সঙ্গে স্থানীয় দুর্নীতিপরায়ন ব্যবসায়ীদের কারসাজি ও সিন্ডিকেটও জড়িত’- যোগ করেন এ পরিবেশ আইনবিদ।
জরিমানাও শাস্তি, কিন্তু এটি তো অর্থদণ্ড। কারাভোগের মতো শাস্তির বিধান বিধিমালায় যুক্ত করা হয়নি।- মনজিল মোরসেদ
ব্যর্থতার দায় নেবে কে
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘পার্টিকুলারলি কোম্পানিগঞ্জের বিষয়ে নির্দেশনাই আছে পাথর না তোলার। কারণ, সেটি পর্যটন এলাকা। সেখানে টুরিস্টরা যাবেন, সাদাপাথরের দৃশ্য উপভোগ করবেন।’
আরও পড়ুন
- আস্ত টিলাকে পুকুর বানিয়ে ফেলেছে পাথরখেকোরা
- ১৭ পাথর কোয়ারি সংরক্ষণে মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের নির্দেশ হাইকোর্টের
- দুদকের তালিকায় ‘টপ টু বটম’, রাজনীতিবিদদের দৌড়ঝাঁপ
তিনি বলেন, ‘কিন্তু নির্দেশনা থাকার পরও প্রশাসনের নাকের ডগায় বসে পাথর হরিলুট চলেছে। রাষ্ট্রের তেমন কোনো পদক্ষেপ ছিল না। মিডিয়ায়ও কোনো খবর নেই। একসময় যখন পুরো এলাকার পাথর শেষ হয়ে গেল সব মাধ্যমে তখন সংবাদ আসা শুরু হলো। এটি সরকারের জন্য বড় ব্যর্থতা।’
জরিমানার বিধান থাকলেও নেই কঠোর সাজা
মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘পাথর লুটপাট নিয়ে ব্যাপক আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এখন আমরা সবাই এ নিয়ে আইনে কী আছে তা জানতে চাচ্ছি। আমাদের মতো প্রশাসনও খোঁজা শুরু করেছে। কিন্তু এটি যদি সামনে না আসতো তাহলে আলোচনারও খুব একটা দরকার হতো না। আইনি দুর্বলতার বিষয়গুলো নিয়ে প্রশাসন ও সরকারও হিসাব করতো না।’
তিনি জানান, খনি ও খনিজ সম্পদ (নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন) আইন-১৯৯২-এ খনিজ সম্পদ ঘোষণা ও ব্যবহারের বিষয়ে বলা আছে। সেটি নিয়ে বিধিমালাও করা হয়েছে। ব্যবহারের নীতিমালা লঙ্ঘনে কী হবে সেটিও উল্লেখ আছে।
‘আইনটির বিধিমালা করার সময় শাস্তির বিধান সবোর্চ্চ তিন বছরের সাজা করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু বিধিমালায় শাস্তির কোনো বিধান রাখা হয়নি। বিধিমালা করার সময় জেল বা সাজার কথাও উল্লেখ করেনি। সেখানে বিভিন্ন পযার্য়ে এক লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। জরিমানাও শাস্তি, কিন্তু এটি তো অর্থদণ্ড। কিন্তু কারাভোগের মতো শাস্তির বিধান বিধিমালায় যুক্ত করা হয়নি’- বলেন এ আইনজীবী।
এসব ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তর ও খনিজ সম্পদ বিভাগের মধ্যে যথাযথ সমন্বয় সাধন প্রয়োজন বলেও মনে করেন পরিবেশ ও আইন বিশেষজ্ঞরা।
এফএইচ/এমকেআর/এমএস