• র্যাব, পুলিশ ও সিটিটিসির সমন্বয়ে যৌথ অপারেশন শুরু
• পুলিশ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিজিবির সমন্বয়ে যৌথ টহল, তল্লাশি
• গত কয়েকদিনের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে জড়িতদের শনাক্তের কাজ চলছে
• নজরদারিতে কারাগার থেকে জামিন পাওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসীরা
• কারাগার থেকে পালানো ৭০০ আসামিও নজরদারিতে
• অপরাধে যুক্ত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে
• গত জানুয়ারি মাসে সারাদেশে মোট মামলা ১৪,৫৭২টি
• ভাসমান অপরাধীরা সুযোগ নিচ্ছে
প্রকাশ্যে গুলি, চাপাতি দিয়ে কোপানো এবং ভয় দেখিয়ে চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা যেন বেড়েই চলেছে। সম্প্রতি এসব ঘটনায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। আতঙ্কে অনেকেই ঘর থেকে বেরোতেও ভয় পাচ্ছেন। সন্ধ্যার পর শহরাঞ্চলের অলিগলি ও রাস্তাঘাটে বিরাজ করছে সুনসান নীরবতা। কোথাও কোথাও এসব ঘটনা সামাজিকভাবে প্রতিরোধের চিত্রও দেখা যাচ্ছে।
গত কয়েকদিনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেটিজেনরা সরকারের সমালোচনা করেও দিচ্ছেন পোস্ট। বেশ কয়েকদিন ধরেই স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ চাচ্ছেন কেউ কেউ। পদত্যাগের বিষয়ে সোমবার আলটিমেটামও দেওয়া হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে কঠোর হচ্ছে সরকার। পদত্যাগের বিষয়টি নাকচ করে দিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, আপনারা আজ (সোমবার) রাতেই দেখবেন আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অ্যাক্টিভিটিস অনেক বেড়ে গেছে। আমি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সবাইকে নির্দেশ দিয়েছি। আপনারা সন্ধ্যার পর থেকেই টের পাবেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকাসহ সারাদেশে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে। গত কয়েকদিনের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও ভাইরাল হওয়া ভিডিওর ফুটেজগুলো দেখে জড়িতদের শনাক্তের কাজ চলমান। এছাড়া চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি ও হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনায় ৫ আগস্টের পর যাদের নাম আসছে তাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। এমনকি সম্প্রতি কারাগার থেকে জামিনে আসা শীর্ষ সন্ত্রাসীরাদেরও নজরদারিতে আনা হয়েছে।
আরও পড়ুন
- বনশ্রীতে গুলি করে ব্যবসায়ীর কাছে থাকা ২০০ ভরি সোনা ডাকাতি
- ১৭ দিনে অপারেশন ডেভিল হান্টে গ্রেফতার ৯২৫৩
- আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রম সন্ধ্যার পর থেকেই টের পাবেন
পুলিশের একটি সূত্র বলছে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের দোসররা এরই মধ্যে বেশকিছু অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করেছে। সেসব ফুটেজ গোয়েন্দাদের হাতে এসেছে। তাদের চিহ্নিত করে দ্রুতই আইনের আওতায় আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
ক্রমাগত হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের কারণে দেশজুড়ে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, তা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম না হলে রাষ্ট্র ও সরকারের স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের।
ক্রমাগত হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের কারণে দেশজুড়ে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, তা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম না হলে রাষ্ট্র ও সরকারের স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নাগরিকের নিরাপত্তাই রাষ্ট্রের নিরাপত্তা। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা ও সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অধিকার রাষ্ট্র কর্তৃক সংরক্ষিত এবং নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকারের রক্ষাকবচ। অন্য মানুষকে নিরাপদ রাখা ও বাঁচতে দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে অন্যতম। কিন্তু সম্প্রতি নাগরিকরা যে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। দিনেদুপুরে প্রকাশ্যে গুলি চলছে, ধারালো অস্ত্র দিয়ে রিকশাযাত্রী মা-বোনদের সবকিছু ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এর দ্রুত সুরহা দরকার এবং যারা এসব করছে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তির আওতায় এনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা দরকার।
দেশের মহানগর ও আশপাশের এলাকাগুলোয় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী মহানগর এবং রেঞ্জের আওতাধীন এলাকাগুলোয় নানা ধরনের অপরাধের ঘটনা ও এর প্রতিকার চেয়ে করা মামলার সংখ্যা বাড়ছে।
পুলিশ সদরদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গত জানুয়ারি মাসে সারাদেশে মোট মামলা হয়েছে ১৪ হাজার ৫৭২টি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ঢাকা রেঞ্জে ২ হাজার ৩৭৮টি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক মামলা নথিভুক্ত হয়েছে চট্টগ্রাম রেঞ্জে ২ হাজার ১৯৯টি। এর পরের অবস্থানে থাকা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে (ডিএমপি) মামলা নথিভুক্ত হয়েছে ১ হাজার ৭৯১টি।
এরপর যথাক্রমে রাজশাহী রেঞ্জে ১ হাজার ৫৭৫টি, রংপুর রেঞ্জে ১ হাজার ৪৭৩, খুলনা রেঞ্জে ১ হাজার ৩৪৯, ময়মনসিংহ রেঞ্জে ৮৬৭, বরিশাল রেঞ্জে ৮৪৭ ও সিলেট রেঞ্জে ৭১১টি মামলা নথিভুক্ত হয়েছে।
পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা মূলত এখন কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে চান না। কেবল নির্ধারিত সময় ধরে থানায় ডিউটি করাই এখন তাদের প্রধান কাজ। দৈনিক হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করা এবং থানার ভেতরে টেবিলওয়ার্কের দিকেই তাদের বেশি মনোযোগ। বাইরে ডিউটি করতে গেলে নানা ধরনের অপরাধের শিকার হয়ে ভুক্তভোগীরা তাদের কাছে আসেন। কিন্তু তাদের জন্য তেমন কিছুই করার থাকে না।
ছিনতাইকারীকে ধরতে গেলেও হামলার শিকার হতে হয় তাদের। এমন পরিস্থিতিতে নিয়মিত টহল এবং তল্লাশি কার্যক্রম পরিচালনাই অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একজন উপপরিদর্শক (এসআই) ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, চোর ধরে আনলেও সংঘবদ্ধ হয়ে আমাদের ওপর হামলা করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বাইরে ডিউটি করে ভুক্তভোগীদের সেবা নিশ্চিত করা কঠিন। ঝুঁকি নিতে হচ্ছে প্রতিদিন।
সাম্প্রতিক কয়েকটি আলোচিত ঘটনা
গত কয়েকদিনের ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ও সমালোচিত ঘটনা রাজধানীর বনশ্রী এলাকায় সোনা ব্যবসায়ীকে গুলি করে ১৬০ ভরি সোনা ও নগদ এক লাখ টাকা ডাকাতি। দুর্বৃত্তরা এক-দুটি নয়, পর পর চার রাউন্ড গুলি করে এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে জখম করে সোনা নিয়ে যায়।
আমি বলবো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্যাটিসফ্যাক্টরি (সন্তোষজনক)। তবে এটার উন্নতি করার অবকাশ রয়ে গেছে। আগে কী হতো, যেমন বনশ্রীর ঘটনাটি জানতে জানতে দুদিন সময় লেগে যেতো, এখন সঙ্গে সঙ্গে ঘটনা জেনে যায়।- স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
এ ঘটনাটির ৩১ সেকেন্ডের একটি ভিডিও মুহূর্তেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন নেটিজেনরা। তাদের বেশিরভাগের মন্তব্য- ‘স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্যর্থ, তাকে পদত্যাগ করতে হবে।’ এ ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিষয়ে জরুরি প্রেস ব্রিফিং করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।
মোহাম্মদপুরে রিকশা আটকে চাপাতি দিয়ে নারীকে আক্রমণ
২৩ ফেব্রুয়ারি একই রাতে বেশি অপরাধপ্রবণ এলাকা হিসেবে পরিচিত রাজধানীর মোহাম্মদপুরে একটি রিকশা থামিয়ে দুই তরুণ ছিনতাই করে। রিকশায় এক নারীকে বসে থাকতে দেখা যায় এবং তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন বোরখা পরা আরেক নারী। এসময় দাঁড়িয়ে থাকা নারীর দিকে এক ছিনতাইকারীকে চাপাতি হাতে তেড়ে যেতে দেখা যায়। সেখানে আরেক ব্যক্তিকে দেখা যায় ছিনতাইকারীদের সরিয়ে দিতে। তবে তিনি ওই দুই নারীর সঙ্গে ছিলেন কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
ডাকাতদের হামলায় ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয় ছাত্রের চোখে আঘাত
একই রাতে নারায়ণগঞ্জের ভুলতায় গভীর রাতে ডাকাতদের হামলায় কাওছার মাহমুদ (২২) নামের এক ছাত্র আহত হন। পরে তাকে ঢাকার জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কাওছার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ছাত্র।
ঢাকার জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কাওছারের বরাত দিয়ে তার বন্ধু পারভেজ মিয়া জাগো নিউজকে জানান, কাওছারের বড় ভাই মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই প্রবাসী এবং সপরিবার নারায়ণগঞ্জের মদনপুরে থাকেন। সম্প্রতি কাওছারের বড় ভাই দেশে এসেছেন। আজ সকালে তার দুবাইয়ে যাওয়ার কথা ছিল। সেজন্য গতকাল গভীর রাতে কাওছার তার বড় ভাইকে নিয়ে মদনপুরের বাসা থেকে প্রাইভেটকারে ঢাকায় হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরে পৌঁছে দিতে রওনা দেন।
রাত দুইটার পর তারা নারায়ণগঞ্জে জেলার রূপগঞ্জের ভুলতা ব্রিজ পার হলে দেখতে পান, রাস্তায় আড়াআড়ি করে একাধিক ট্রাক রেখে ব্যারিকেড দিয়েছে ৩০ জনের মতো দুর্বৃত্ত। আটকে পড়া যানবাহনে তারা ডাকাতি করছে। একপর্যায়ে দুর্বৃত্তরা কাওছারদের বহনকারী প্রাইভেটকারটির কাচ ভেঙে ফেলে এবং সেটি রামদা নিয়ে কোপায়। এর মধ্যে একটি কোপ প্রাইভেটকারের পেছনে বসা কাওছারের কপাল এবং ডান চোখে লাগে। এসময় কাওছারের বড় ভাই সামান্য আহত হন।
পারভেজ মিয়া বলেন, ডাকাতেরা কাওছারের ভাইয়ের কাপড়চোপড়, গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র, বিমানের টিকিট, একটি পাসপোর্টসহ নগদ টাকা লুট করে নিয়ে যায়। সেখানে অনেক গাড়ি আটকে ডাকাতি করে ডাকাতরা।
বাসায় ডেকে নারীকে জোরপূর্বক ধর্ষণ
গত ২০ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ভাটারায় নিজের বাসায় ডেকে নিয়ে এক নারীকে ধর্ষণ করেন শাহরিয়ার কবির নামের এক ব্যক্তি। ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ না করার ভয় দেখিয়ে বের করে দেওয়া হয় ভুক্তোভোগী নারীকে। পরে তিনি বাড়িতে গিয়ে সবার সঙ্গে কথা বলে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেন। ২২ ফেব্রুয়ারি এ ঘটনায় মামলা করেন ওই নারী। মামলার দিনই ধর্ষণে অভিযুক্ত শাহরিয়ার কবিরকে গ্রেফতার করে ভাটারা থানা পুলিশ।
আগের আমলের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা যে ভাষায় কথা বলতেন বর্তমান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাও একই ভাষায় কথা বলছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে, এটা গণঅভ্যুথানের চেতনার সঙ্গে যায় না। পরিস্থিতি স্বীকার করতে হবে।- অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক
শিক্ষার্থীকে কুপিয়ে টাকা ও মোবাইল ছিনতাই
গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মালিবাগের শান্তিনগর মোড়ের মাঝামাঝি এলাকায় দিনের বেলায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আবু রায়হান ইভান (২২) নামের এক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। আহত ইভানের বন্ধু নাহিদুর রহমান জিসান বলেন, ইভান মালিবাগ মোড় এলাকায় একটি বিকাশের দোকান থেকে ৪৫ হাজার টাকা তোলেন। এরপর যখন কলেজে ফিরছিলেন, তখন চার-পাঁচজন ছিনতাইকারী তার পিছু নেয়। কিছুক্ষণ পর ছিনতাইকারীরা রাস্তায় তার গতিরোধ করে। এ সময় তারা ইভানের বুকে, পেটে ও হাতে ছুরিকাঘাত করে। ছিনতাইকারীদের ছুরির আঘাতে আবু রায়হান ইভান আহত হলে তার মোবাইল ও ৪৫ হাজার টাকা ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা।
ভাসমান অপরাধীরা সুযোগ নিচ্ছে
ডিএমপির একটি সূত্র বলছে, রাজধানী ঢাকায় ভাসমান ও ছদ্মবেশী অপরাধীরা এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে। এরা মূলত অপরাধ করে সরে পড়ে। ঠিকানাবিহীন এসব অপরাধী যে কোনো ধরনের অপরাধ সংঘটিত করে নির্বিঘ্নে কেটে পড়ে। এদের শনাক্ত করতে গিয়ে বেগ পেতে হচ্ছে।
ঢাকায় ৬ হাজারের বেশি অপরাধীকে ডিএমপির ডাটাবেজে যুক্ত করা হয়েছিল ২০২৩ সালের দিকে। তবে ভাসমান ও ছদ্মবেশী অপরাধীদের ডাটাবেজের আওতায় আনা হয়নি কখনো। এজন্য যারা ভাসমান অপরাধী রয়েছে তাদের শনাক্ত করাও কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
যা বলছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী
ডিএমপি মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেসন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ডিএমপির স্পেশাল ইউনিটের সমন্বয়ে র্যাবসহ যৌথ পেট্রোলিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এছাড়া ডিবির সদস্যরা গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করেছে। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে চেকপোস্ট কার্যক্রম বাড়ানো হয়েছে।
আরও পড়ুন
- জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকারের, সেটি সুচারুভাবে করতে চাই
- দেশ অস্থিতিশীল করলে আওয়ামী দোসরদের ঘুম হারাম করে দেব
- সেমিস্টারের টাকা জমা দেওয়া হলো না ইভানের, খোয়া গেলো ফোনও
নিরাপত্তার বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর জাগো নিউজকে বলেন, পুলিশের লক্ষ্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখা। অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে আসা এবং অপরাধ প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া। এলাকা ভেদে অপরাধের ধরন ভিন্ন হয়ে থাকে। সে অনুযায়ী অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, ভবিষ্যতেও পেশাদারত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় এবং অপরাধ দমনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পুলিশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে দেশব্যাপী চুরি, ছিনতাই, খুন ও ডাকাতি প্রতিরোধে র্যাবের প্রতিটি ব্যাটালিয়নের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। র্যাবের সব ব্যাটালিয়ন তাদের নিজস্ব দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় রোবাস্ট প্যাট্রোলিং পরিচালনা করছে।
তিনি বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিরতিহীনভাবে অতিরিক্ত টহল মোতায়েনের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এছাড়া আইজিপির নির্দেশনায় র্যাব, পুলিশ ও সিটিটিসি যৌথ অপারেশন করবে; সেই নির্দেশনা আমরা পেয়েছি। অভিযান শুরু হচ্ছে।
সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে আজ রাত থেকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রম টের পাওয়া যাবে। আমি বলবো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্যাটিসফ্যাক্টরি (সন্তোষজনক)। তবে এটার উন্নতি করার অবকাশ রয়ে গেছে। আগে কী হতো, যেমন বনশ্রীর ঘটনাটি জানতে জানতে দুদিন সময় লেগে যেতো, এখন সঙ্গে সঙ্গে ঘটনা জেনে যায়।
একই বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, সরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সিরিয়াসলি নিচ্ছে বলেই আজকের মিটিংটা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে যে এজেন্সিগুলো কাজ করে তারা সবাই এখানে ছিলেন।
বৈঠকের বরাত দিয়ে শফিকুল আলম বলেন, ঢাকা এবং যেসব জায়গায় আমরা দেখছি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিছুটা অবনতি হয়েছে, সেসব জায়গায় টহল বাড়াবো। এই টহল আজকে (সোমবার) সন্ধ্যা থেকে আপনারা দেখবেন। পুরো ঢাকা শহরেই দেখবেন।
তিনি বলেন, এজন্য যে জিনিসটি করা হচ্ছে, যৌথ টহল হবে। পুলিশ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিজিবির সমন্বয়ে যৌথ টহল হবে। জায়গায় জায়গায় চেকপোস্ট বসিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মনিটর করা হবে। তল্লাশির ব্যবস্থা করা হবে।
গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে জানিয়ে প্রেস সচিব বলেন, আমাদের ইন্টেলিজেন্স উইং, ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি- তারা তাদের মতো করে নজরদারি করবেন। সে অনুযায়ী আমরা অ্যাকশনে যাবো।
বর্তমান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কথায় অতীতের সুর
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, গণঅভ্যুথানের ছয় মাস পরেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রত্যাশিত উন্নতি হচ্ছে না। মানুষের মনে নিরাপত্তা প্রশ্নে ভয়ের মাত্রা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এটিকে ভয়াবহ পরিস্থিতি হিসেবে আমরা দেখছি। প্রশ্ন হতে পারে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো কীভাবে? কারণ হিসেবে বলা যায়, শুরু থেকেই কারণগুলো এড্রেস করা হয়নি বা সমাধান করা হয়নি।
তিনি বলেন, তার মধ্যে অন্যতম আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা। শীর্ষ অপরাধী থেকে শুরু করে যারা নানা ধরনের অপরাধ করছে তাদের অপারেশন ডেভিল হান্টের আওতায় আনা প্রয়োজন। সেই প্রয়োজনটি সঠিকভাবে হয়নি। অর্থাৎ অপারেশন ডেভিল হান্ট কাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হবে, কারা ডেভিল হিসেবে চিহ্নিত হবে এর সংজ্ঞায়ন একপেশে হয়েছে। এ কারণে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার প্রসঙ্গ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আইন প্রয়োগ, অপরাধীদের গ্রেফতার এবং আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে কোথাও সরব কোথাও আবার ঢিলেঢালা ভাব নানাভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা প্রত্যাশিত মাত্রায় ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের আলটিমেটামের বিষয়ে জানতে চাইলে অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা যে-ই হোন তাকে পরিপূর্ণভাবে সহযোগিতা না করলে কারও পক্ষেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। কারণ এটি বিশেষ পরিস্থিতি। যারা সহযোগিতা করবেন তারা কি চাকরির সূত্রে আছেন নাকি দায়িত্ব পালনের মধ্যে আছেন, সেটি বড় প্রশ্ন।
‘পরিস্থিতিকে স্বীকার করে কী করা যায়; সেক্ষেত্রে নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক দল, শিক্ষার্থী ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ শুরু করতে বিলম্ব করেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। আগের আমলের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা যে ভাষায় কথা বলতেন বর্তমান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাও একই ভাষায় কথা বলছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে, এটা গণঅভ্যুথানের চেতনার সঙ্গে যায় না। পরিস্থিতি স্বীকার করতে হবে’- যোগ করেন তিনি।
টিটি/এমকেআর/এমএস