আইসিটি ক্যাডার বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি

মো. নাজমুল হুদা মাসুদ বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) এখন আর সহায়ক উপাদান নয়-এটি একটি মৌলিক প্রশাসনিক অবকাঠামো। জাতীয় পরিচয়পত্র, ই-পাসপোর্ট, ই-নথি, অনলাইন রাজস্ব ব্যবস্থা, ডিজিটাল ব্যাংকিং, নির্বাচন ব্যবস্থাপনা কিংবা সাইবার নিরাপত্তা সবখানেই রাষ্ট্রের কার্যকারিতা নির্ভর করছে দক্ষ প্রযুক্তি মানবসম্পদের ওপর। অথচ এই বাস্তবতার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, সংশ্লিষ্ট সংস্কার কমিশন এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ থাকা সত্ত্বেও আইসিটি ক্যাডার সার্ভিস গঠনের প্রজ্ঞাপন আজও জারি হয়নি। এই বিলম্ব কেবল প্রশাসনিক জটিলতা নয়; এটি রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকার ও নীতিগত সদিচ্ছার প্রশ্নও বটে। সুপারিশ আছে, সিদ্ধান্ত নেই রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে কোনো নতুন ক্যাডার সার্ভিস গঠনের প্রক্রিয়া সহজ নয়- এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তবে আইসিটি ক্যাডার সার্ভিসের ক্ষেত্রে বিষয়টি ব্যতিক্রম হওয়ার কথা ছিল। কারণ এটি কোনো তাৎক্ষণিক দাবি নয়; বরং দীর্ঘদিনের কাঠামোগত প্রয়োজন থেকে উৎসারিত। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ প্রশাসনিক বাস্তবতা ও জনবল ব্যবস্থাপনার যুক্তিকে স্বীকৃতি দেয়। সংস্কার কমিশন

আইসিটি ক্যাডার বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি

মো. নাজমুল হুদা মাসুদ

বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) এখন আর সহায়ক উপাদান নয়-এটি একটি মৌলিক প্রশাসনিক অবকাঠামো। জাতীয় পরিচয়পত্র, ই-পাসপোর্ট, ই-নথি, অনলাইন রাজস্ব ব্যবস্থা, ডিজিটাল ব্যাংকিং, নির্বাচন ব্যবস্থাপনা কিংবা সাইবার নিরাপত্তা সবখানেই রাষ্ট্রের কার্যকারিতা নির্ভর করছে দক্ষ প্রযুক্তি মানবসম্পদের ওপর।

অথচ এই বাস্তবতার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, সংশ্লিষ্ট সংস্কার কমিশন এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ থাকা সত্ত্বেও আইসিটি ক্যাডার সার্ভিস গঠনের প্রজ্ঞাপন আজও জারি হয়নি। এই বিলম্ব কেবল প্রশাসনিক জটিলতা নয়; এটি রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকার ও নীতিগত সদিচ্ছার প্রশ্নও বটে।

সুপারিশ আছে, সিদ্ধান্ত নেই

রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে কোনো নতুন ক্যাডার সার্ভিস গঠনের প্রক্রিয়া সহজ নয়- এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তবে আইসিটি ক্যাডার সার্ভিসের ক্ষেত্রে বিষয়টি ব্যতিক্রম হওয়ার কথা ছিল। কারণ এটি কোনো তাৎক্ষণিক দাবি নয়; বরং দীর্ঘদিনের কাঠামোগত প্রয়োজন থেকে উৎসারিত। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ প্রশাসনিক বাস্তবতা ও জনবল ব্যবস্থাপনার যুক্তিকে স্বীকৃতি দেয়। সংস্কার কমিশনের সুপারিশ রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি দক্ষতা ও কারিগরি সক্ষমতার দিকটি তুলে ধরে। আর অর্থ মন্ত্রণালয়ের সদিচ্ছা অর্থনৈতিক টেকসই ও বাজেট বাস্তবতার সঙ্গে বিষয়টির সামঞ্জস্য নিশ্চিত করে। এই তিনটি স্তরের সম্মতি থাকা সত্ত্বেও প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়া স্বাভাবিক প্রশ্নের জন্ম দেয়- তাহলে সিদ্ধান্ত আটকে আছে কোথায়? এটি কি নিছক প্রক্রিয়াগত বিলম্ব, নাকি নীরব অনীহা?

প্রযুক্তি কর্মকর্তাদের পেশাগত বাস্তবতা

বর্তমানে সরকারি আইসিটি কর্মকর্তারা প্রকল্পভিত্তিক নিয়োগ, খণ্ডিত পদোন্নতি কাঠামো এবং সীমিত নীতিনির্ধারণী ক্ষমতার মধ্যে কাজ করছেন। দায়িত্ব ও প্রত্যাশা দিন দিন বাড়লেও পেশাগত স্বীকৃতি সেই হারে বাড়েনি। এর ফলাফল সুদূরপ্রসারী। দক্ষ কর্মকর্তা প্রশাসনিক অনিশ্চয়তায় ভোগেন, তরুণ মেধা সরকারি সেবায় আসতে নিরুৎসাহিত হয় এবং রাষ্ট্র হারায় প্রাতিষ্ঠানিক স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা।

আইসিটি ক্যাডার বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি

ক্যাডার সার্ভিস কেবল একটি প্রশাসনিক শ্রেণিবিন্যাস নয়; এটি দায়িত্ব, জবাবদিহি ও ক্যারিয়ার উন্নয়নের একটি সুসংহত কাঠামো। আইসিটি ক্যাডার বাস্তবায়ন না হওয়া মানে প্রযুক্তি খাতকে ‘সহায়ক’ হিসেবে দেখার পুরোনো দৃষ্টিভঙ্গি আঁকড়ে থাকা-যা আজকের বাস্তবতায় অচল।

অন্তর্বর্তী সরকার ও নীতিগত সুযোগ

অন্তর্বর্তী সরকারের সীমাবদ্ধতা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও একটি বিষয় পরিষ্কার-যেসব সংস্কার ইতোমধ্যে নীতিগতভাবে অনুমোদিত ও সুপারিশপ্রাপ্ত, সেগুলোর বাস্তবায়ন প্রশাসনিক ধারাবাহিকতার অংশ। আইসিটি ক্যাডার সার্ভিস গঠনের ক্ষেত্রে নতুন কোনো মৌলিক নীতি প্রণয়নের প্রয়োজন নেই; প্রয়োজন কেবল বিদ্যমান সুপারিশের আলোকে একটি প্রজ্ঞাপন।

অতীতে সরকারগুলো বহু প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছে, যা পরবর্তী নির্বাচিত সরকার বহাল রেখেছে। সেক্ষেত্রে আইসিটি ক্যাডার প্রজ্ঞাপন জারি করা কোনো সাংবিধানিক বা নীতিগত ব্যতিক্রম হওয়ার কথা নয়। বরং এটি সংস্কার-প্রতিশ্রুতি রক্ষার একটি বাস্তব দৃষ্টান্ত হয়ে থাকতে পারে।

‘মূলা ঝুলিয়ে রাখা’ সংস্কৃতি

প্রশাসনে নতুন ক্যাডার মানেই ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস, পদসৃজন এবং আন্তঃক্যাডার সমন্বয়ের চ্যালেঞ্জ। এখানেই অনেক সময় গড়ে ওঠে নীরব প্রতিরোধ। ফাইল ঘোরে, মতামত পুনর্মূল্যায়নের নামে সময় নেওয়া হয়, আর সিদ্ধান্ত অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের জন্য স্থগিত থাকে। এই সংস্কৃতিই সাধারণভাবে পরিচিত ‘মূলা ঝুলিয়ে রাখা’ নামে। প্রশ্ন হলো—এই বিলম্বের খরচ কে বহন করছে? রাষ্ট্র যখন সাইবার আক্রমণ, ডেটা লিক এবং রাষ্ট্রীয় সেবা ব্যর্থতার ঝুঁকিতে রয়েছে, তখন একটি সুসংগঠিত আইসিটি ক্যাডার গঠনে বিলম্বের মূল্য অত্যন্ত চড়া।

নির্বাচিত সরকার বনাম প্রশাসনিক ধারাবাহিকতা

আরেকটি যুক্তি প্রায়ই শোনা যায়-নির্বাচিত সরকার এলেই প্রজ্ঞাপন হবে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সংস্কার কি কেবল নির্বাচনি চক্রের সঙ্গে আবদ্ধ থাকবে? প্রশাসনিক ধারাবাহিকতার মূল দর্শনই হলো, নীতিগতভাবে প্রস্তুত সিদ্ধান্তগুলো সময়মতো বাস্তবায়ন করা। নির্বাচিত সরকার এসে প্রয়োজনে কাঠামো উন্নত করতে পারে, কিন্তু শূন্য থেকে শুরু করার প্রয়োজন নেই।

আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা ও বাংলাদেশের বাস্তবতা

বিশ্বের বহু দেশে সরকারি আইটি সার্ভিসকে বিশেষায়িত ক্যাডার বা সিভিল সার্ভিস ট্র্যাক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এর ফলে সরকারি সেবা আরও নিরাপদ, দক্ষ ও ব্যয়-সাশ্রয়ী হয়েছে। বাংলাদেশও প্রযুক্তির অগ্রযাত্রায় উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে যার নেপথ্যে রয়েছে দেশীয় প্রযুক্তি মানবসম্পদ। এই মানবসম্পদকে কাঠামোগত স্বীকৃতি না দিলে দীর্ঘমেয়াদে সেই সাফল্য টেকসই হবে না।

নীতিগত ঝুঁকি ও ভবিষ্যৎ প্রভাব

আইসিটি ক্যাডার সার্ভিস বাস্তবায়ন বিলম্বিত হওয়ার সবচেয়ে বড়ো ঝুঁকি হলো নীতিগত অসংগতি। একদিকে রাষ্ট্র ই গভর্ন্যান্সের ঘোষণা দিচ্ছে, অন্যদিকে সেই ঘোষণার বাস্তবায়নে যে মানবসম্পদ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তাদের প্রশাসনিক স্বীকৃতি অনিশ্চিত রেখে দিচ্ছে। এই দ্বৈততা দীর্ঘমেয়াদে নীতির বিশ্বাসযোগ্যতাকে ক্ষুণ্ন করে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সাইবার নিরাপত্তা। আধুনিক রাষ্ট্রে সাইবার স্পেস এখন পঞ্চম যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত। ডেটা সুরক্ষা, গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো নিরাপত্তা এবং নাগরিক তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষায় বিশেষায়িত ও দায়বদ্ধ প্রশাসনিক কাঠামো অপরিহার্য। আইসিটি ক্যাডার সার্ভিস ছাড়া এই দায়িত্বগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকছে, যার ফলে জবাবদিহি দুর্বল হচ্ছে।

তরুণ প্রজন্ম ও মেধা ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ

সরকারি চাকরিতে তরুণ প্রযুক্তিবিদদের আগ্রহ দিন দিন কমে যাওয়ার একটি বড় কারণ হলো ক্যারিয়ার অনিশ্চয়তা। বেসরকারি খাতে যেখানে দক্ষতার স্বীকৃতি ও দ্রুত অগ্রগতির সুযোগ রয়েছে, সেখানে সরকারি আইসিটি পেশাজীবীরা কাঠামোগত সীমাবদ্ধতায় আটকে পড়ছেন। আইসিটি ক্যাডার সার্ভিস বাস্তবায়িত হলে মেধাবী তরুণদের জন্য একটি সুস্পষ্ট ও মর্যাদাপূর্ণ ক্যারিয়ার পথ তৈরি হতো, যা রাষ্ট্রের জন্য দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ হিসেবে কাজ করত।

প্রশাসনিক সমন্বয় ও জবাবদিহি

আইসিটি ক্যাডার গঠনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়। বর্তমানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে প্রযুক্তি সিদ্ধান্ত বিচ্ছিন্নভাবে গৃহীত হয়, যার ফলে মান ও নিরাপত্তায় বৈষম্য দেখা যায়। একটি কেন্দ্রীয় ক্যাডার কাঠামোর মাধ্যমে নীতি, মানদণ্ড ও জবাবদিহি একীভূত করা সম্ভব। এতে প্রকল্প ব্যয় কমবে এবং ব্যর্থতার দায় নির্ধারণ সহজ হবে।

আইসিটি ক্যাডার সার্ভিস বাস্তবায়ন কোনো গোষ্ঠীগত সুবিধা বা পেশাগত বিলাসিতা নয়; এটি রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা ও জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত একটি সংস্কার উদ্যোগ। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, সংস্কার কমিশন এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের সদিচ্ছা থাকার পরও প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়া প্রশাসনিক সিদ্ধান্তহীনতার দৃষ্টান্ত হয়ে উঠছে।

অন্তর্বর্তী সরকার চাইলে এই প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে প্রমাণ করতে পারে যে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্নে কেবল প্রতিশ্রুতিতেই সীমাবদ্ধ নয়। অন্যথায়, আইসিটি ক্যাডার সার্ভিস একটি যুগান্তকারী নীতিগত উদ্যোগ হয়েও বাস্তবায়নের অভাবে ইতিহাসের নথিতে আটকে থাকবে- আর প্রযুক্তি কর্মকর্তাদের মান-মর্যাদার প্রশ্নটি থেকে যাবে অমীমাংসিত।

লেখক: প্রকৌশলী মো. নাজমুল হুদা মাসুদ
রক্ষণাবেক্ষণ প্রকৌশলী, সাইবার সিকিউরিটি অ্যানালিস্ট (SB-CIRT)
স্পেশাল ব্রাঞ্চ, বাংলাদেশ পুলিশ ও জয়েন্ট সেক্রেটারি (একাডেমিক), বাংলাদেশ কম্পিউটার সোসাইটি

এমআরএম/জেআইএম

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow