‘যতদিন বেঁচে থাকবো, মনে একটা প্রশান্তি কাজ করবে এই ভেবে যে, আমি জাতীয় বীরদের পাশে থেকে তাদের চিকাৎসাসেবা দিতে পেরেছিলাম।’
জুলাই অভ্যুত্থানের কথা স্মরণ করে এমন কথাই জানালেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের রেজিস্ট্রার ডা. ইশরাত জাহান ইভা। জাগো নিউজের সঙ্গে একান্ত আলাপকালে জুলাই অভ্যুত্থানে নিজের অভিজ্ঞতার গল্প বলেন এই চিকিৎসক।
ডা. ইশরাত জাহান ইভা বলেন, ১৯ জুলাই শুক্রবার সেদিন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে আটটার দিকে আমার ফোনে একটা কল আসলো। হাসপাতাল থেকে আমাকে বলা হলো একটা ঘটনা ঘটেছে। চরপাড়া থেকে বদরের মোড়ের মধ্যে ঘটনাটি ঘটেছে, দ্রুত হাসপাতালে আসেন। আমাদের যেকোনো সময় ২৪ ঘণ্টা ইমার্জেন্সির জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। সঙ্গে সঙ্গে আমি চলে আসলাম। আসার পর যখন জানতে চাইলো আহত নিহতের কী অবস্থা? তখন আমাকে বলা হলো, তুমি একটু সিচুয়েশনটা জানাও। আমি এখানে একজন সিনিয়র মেডিকেল অফিসার। সেই হিসাবে আমার দায়িত্ববোধ থেকে প্রথম গেলাম ইমারজেন্সিতে। ইমারজেন্সিতে গিয়ে আমি খোঁজ নিলাম কী অবস্থা, কতজন আহত হয়েছে, কতজন নিহত হয়েছে। সেখান থেকে ক্যাজুয়ালটিতে গেলাম। ক্যাজুয়ালটি থেকে আসলাম আট নম্বর ওয়ার্ডে। এসে দেখলাম আহত যারা আছে তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ৮ নম্বর ওয়ার্ডের খোঁজখবর নেওয়ার পর আমি ওটিতে চলে গেলাম। এবং ওটিতে গিয়ে আহতদের নিয়ে কাজ শুরু করে দিলাম।
পরের দিন ২০ জুলাই শনিবার বেলা সাড়ে ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে আমার আরেক কলিগের কাছে ফোন এলো যে গৌরীপুরের কলতাপাড়ায় গুলাগুলি হয়েছে। অনেক মানুষ আহত নিহত। আমরা মোটামুটি প্রস্তুতি নিয়ে ছিলাম, পাশাপাশি হাসপাতাল প্রশাসন থেকে আমাদের ফোন দিয়েছে। দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে ১টার মধ্যে হঠাৎ করে অনেক লোকজন চলে এলো, ট্রলির শব্দ শুনে আমি দৌড় দিয়ে যখন গেলাম, দেখলাম তিনটা ট্রলি পাশাপাশি সারিবদ্ধভাবে রাখা। আমি জিজ্ঞেস করলাম আরও আছে? ওরা বললো- হ্যাঁ, আরও আসতেছে ম্যাডাম। তিনজনের অবস্থা খুব ক্রিটিক্যাল ছিল। তিনজনের অবস্থা দেখে আমি আমার স্যারকে জানালাম। স্যার বললেন ওটিতে নাও। আমি প্রথম মানুষ যে এখান থেকে দৌড় দিয়ে ওটিতে গেলাম। ওটিতে গিয়ে আহতদের ভেতরে ঢুকালাম। প্রাথমিকভাবে যা যা করণীয় সবকিছু করলাম। মৃতপ্রায় রোগীদের যে ধরনের চিকিৎসা দিতে হয় তার সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করি আমরা। তারপর দেখা গেলো যে তারা আসলে মৃত। তাদেরকে মৃত ঘোষণা করলাম।
আমাদের পাশাপাশি আরেকটা ওটি, সেটিতেও আহত দুজন ছেলে নাম জুনায়েদ ও শ্রাবণ। এই দুজনের চিকিৎসা দেওয়া অলরেডি চলছিল। যারা আসছে বাকিদের গায়ে গুলি ছিল। গুলিগুলো বের করা হচ্ছে। ওই সময়ের মধ্যেই শ্রাবণের অপারেশন শুরু হয়ে গিয়েছে। আর যারা মৃত্যুবরণ করেছে তাদের ডেড সার্টিফিকেটগুলো তৈরি করছি।
সার্টিফিকেটগুলো রেডি করে আমি গেলাম তখন দেখি জুনায়েদ শুয়ে আছে। জুনায়েদের ইমারজেন্সি ম্যানেজ করা হচ্ছে। ওর ভেতরে একটি টিউব দিলাম ওটা দিয়ে গলগল করে প্রায় তিন চার লিটার রক্ত বেরিয়ে এসেছে। সিদ্ধান্ত হলো অপারেশন করতে হবে। কিন্তু চেস্ট অপারেশন করার মতো প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আমাদের কাছে ছিল না। আমাদের এই জায়গায় সব সময় এমন অপারেশন হয় না। তারপরও যখন এমন অবস্থা তখন আমরা ঢাকায় রেফার্ড করার কথা চিন্তা করলাম। কিন্তু আমাদের কাছে মনে হলো ও হয়তো ঢাকায় যেতে যেতে মারা যেতে পারে। আমরা ডিরেক্টর স্যারের সঙ্গে পরামর্শ করলাম। এই ঘটনায় আমরা পাঁচটা মিনিট সময় নষ্ট করিনি। সিদ্ধান্ত আসলো আমরা যেন কাজ শুরু করি। যুদ্ধক্ষেত্রে তো লিমিটেড জিনিস নিয়ে কাজ করতে হয়। আল্লাহ ভরসা, আমাদের কাছে যা আছে তা নিয়ে আমরা কাজ শুরু করে দিলাম। একজনের প্রাণ বাঁচাতে আমাদের যা যন্ত্রপাতি আছে তা দিয়ে আমরা কাজ করবো। আমরা অপারেশন শুরু করলাম।
এমন একটি রিস্কি অপারেশন টিমে আমি একজন গর্বিত সদস্য ছিলাম। আমি সারাজীবন মনে রাখবো যে আমি এমন একটি অপারেশন টিমের একজন সদস্য ছিলাম। এই অপারেশন টিমে ফার্স্ট অ্যাসিস্ট ছিলাম আমি। তারপর অপারেশন করে সবকিছু ওয়াশ করে সুন্দরভাবে চলে আসলাম। ও গেলো আইসিইউতে। আইসিইউতে যে কয়দিন ছিল প্রতিদিন তাকে আমি দেখতে যেতাম। পরদিন ওর এনেস্থেসিয়া রিকভারি করার পর প্রথম যার সঙ্গে কথা বলেছে সে হলাম আমি। সেটাও আমার জন্য একটা বড় বিষয়। ওর সঙ্গে কথা বললাম। ওকে ফলোআপ করলাম। যে কয়দিন ছিল প্রতিদিন সকালে আমি তাকে দেখতে গিয়েছি। ওর ব্যাপারে কী করা যায় আইসিইউ ডক্টরদের সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলেছি। পরবর্তীতে ওয়ার্ডে ওকে শিফট করা হয়।
আমাদের আরেকজন গুরুতর আহত রোগী ছিল শ্রাবণ। এছাড়াও গুলিবিদ্ধ আরও অনেক রোগী ছিল। শ্রাবণের অপারেশন হয়েছে। অপারেশনের পরদিনই ওকে ওয়ার্ডে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। রেগুলার ড্রেসিং করা হতো, খুবই একটা ক্রিটিক্যাল অবস্থা। আমরা দেখতাম যে ওদের ফ্যামিলি খুব আতঙ্কগ্রস্ত। জিজ্ঞাসা করলাম কী সমস্যা? বললো- ম্যাডাম, আমাদের নামেতো মামলা হয়ে গিয়েছে। আমরা তো আর বাড়ি ফিরতে পারবো না। এখন খুব ভয় পাচ্ছি হাসপাতাল থেকে আমাদের ছেলেদের ধরে নিয়ে যায় কি না। আহত অবস্থায় কোনো রোগীকে ধরে নিয়ে যায় সেটা আমার জানা নেই, আমি তাদের সান্ত্বনা দিলাম। আশ্বস্ত করলাম আমরাতো আছি, আমরা তোমাদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা নিশ্চিত করবো।
ওরা আস্তে আস্তে সুস্থ হচ্ছিল। ৪ আগস্টে এসে আমরা দেখলাম ওরা সুস্থ। ওদের ছুটি দেওয়া যায়। শ্রাবণের ফ্যামিলিকে যখন আমরা বললাম আগামীকাল আপনাদের ছুটি হবে, তারা প্রথমেই খুব ভয় পেলো। আমি তাদেরকে ডেকে বুঝালাম। আমার কলিগদের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিলাম ওদের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলবো। জুনায়েদের মা এবং শ্রাবণের ভাইকে ডাকলাম। বললাম- আপনাদের বাচ্চাদেরকে তো বাসায় পাঠাতে চাই। এভাবে পাঠালে সবাই আপনাদেরকে দেখে ফেলবে। জেনে ফেলবে যে আপনারা চলে যাচ্ছেন। উনাদেরকে বললাম, আপনাদেরকে আমরা ছুটি দিবো। ৫ তারিখ সকাল বেলা আপনাদেরকে বলবো ছুটি, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগ গুছিয়ে আপনারা একসঙ্গে চলে যাবেন না। সকাল আটটায় যখন আমরা ওদেরকে দেখবো, ওদেরকে আগে পাঠিয়ে দিবেন তারপর আপনারা আস্তে আস্তে যাবেন। ওদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই আমরা আসলে এই কাজটি করেছি। আমরা তো জানতাম না পাঁচ তারিখে এমন ঘটনা ঘটবে। দেশের পট পরিবর্তন হবে। ছাত্র জনতার অভ্যুত্থান হবে।
আমরা ওদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে আগের দিনই ছুটির কাগজ সব রেডি করে ফেললাম। কবে আমাদের সঙ্গে দেখা করবে, পরবর্তী চিকিৎসা কী হবে তা বুঝিয়ে দিলাম। ছুটির কাগজ রেডি করে পরের দিন শুধু তারিখ বসাবো। পরদিন সকালে ওদের সঙ্গে এসে দেখা করলাম। বললাম যে আপনাদের ছুটি। চলে যেতে পারেন। আমার পরামর্শ অনুযায়ী খুব সকাল সকাল সন্তানদেরকে উনারা পাঠিয়ে দিলেন। প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে আমার সঙ্গে যে দুজন ডাক্তার ছিলেন রেসিডেন্ট মেডিকেল অফিসার ডা. তুহিন এবং ডা. আবদুল হাই তাদেরকে সব কাগজ রেডি করতে বললাম। তারপর আমি ওদের হাতে দিয়ে দিব।
৫ আগস্ট আমি অন্যান্য দিনের মতো আমার পেশাগত কাজে ব্যস্ত ছিলাম। হঠাৎ দুপুরে জানতে পারলাম দেশে এমন একটা অভ্যুত্থান হয়েছে। আমার সঙ্গে আমার স্যার ছিলেন। বললাম স্যার তাড়াতাড়ি শেষ করেন, আমার আর ভালো লাগছে না, দ্রুত বের হতে হবে। আমাদের কাজ শেষের দিকে ছিল। ৫ মিনিটের মধ্যে বাকি কাজ শেষ করে আমরা বের হলাম। আমি দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলাম জুনায়েদের মাকে। বললাম আপা আপনিতো বীরের মা। আপনি বীর ছেলে জন্ম দিয়েছেন। আপনার ছেলের জন্য আমি যে কয়দিন কাজ করতে পেরেছি, নিজেকে ধন্য মনে করেছি। আপনার ছেলের জন্য আমি এতটুকু করতে পেরেছি। শ্রাবণের ভাইকেও অভিনন্দন জানালাম।
তারপর আমি বললাম এখন তো আর ওদেরকে এভাবে ছুটি দেবো না, ওদেরকে বীরের বেশে ছুটি দেবো। পরদিন সকালে ওদেরকে আসতে বললাম। পরদিন সকালে ওরা আসলো, জাতীয় বীরদেরকে আমরা জাতীয় বীরের মতোই ছুটি দিলাম।
এফএ/জেআইএম