আত্মহত্যা হলো নিজের ভেতরের লড়াইয়ে হেরে যাওয়া। অনেক সময় মানুষ ভেতরের অদৃশ্য লড়াইয়ে এমনভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, যে বেঁচে থাকাটাই তার কাছে অসহ্য মনে হয়। তখন জীবনের সব রং ম্লান হয়ে যায়, স্বপ্নগুলো ভেঙে পড়ে, আর চারপাশের কোলাহলও হয়ে ওঠে ভারী। ঠিক সেই মুহূর্তে অনেকে ভেবে বসেন সব শেষ করে দিলে বুঝি মুক্তি মিলবে! আর এই মুক্তি চাওয়ার পেছনে থাকে অগণিত কারণ।
আত্মহত্যার অনেক কারণই থাকতে পারে। তাই নির্দিষ্ট করে কোনোটিকেই দায়ী করা যায় না। আসলে যিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নেন তিনি কী কারণে এটি করেছেন তা আগে জানতে পারলে হয়তো এই কাজটি করার সুযোগ পেতেন না। কেউ না কেউ তার দিকে সাহায্য এবং সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিতেন।
আসুন কী কী কারণে মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে তা জেনে নেওয়া যাক-
১. মানসিক অবসাদ: আত্মহত্যার অন্যতম প্রধান কারণ হলো ডিপ্রেশন। দীর্ঘদিন ধরে মানসিক চাপে থাকা, হতাশা থেকে বের হতে না পারা, একাকীত্ব বা জীবনের প্রতি অনাগ্রহ একজন মানুষকে ধীরে ধীরে ভেতর থেকে ভেঙে দেয়। অনেকেই ভেতরের যন্ত্রণা প্রকাশ করতে পারেন না। লোকলজ্জা কিংবা পরিবারের কথা ভেবে নিরবেই লড়াই করে যান। যখন এই লড়াই অসহনীয় হয়ে ওঠে, তখন তারা মৃত্যুকেই মুক্তি হিসেবে বেছে নেন।
২. বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক সংকট: অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা আত্মহত্যার আরেকটি বড় কারণ। চাকরি না পাওয়া, আয় কমে যাওয়া বা ঋণের বোঝা এসব পরিস্থিতি একজন মানুষের আত্মমর্যাদা ও আত্মবিশ্বাসকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়। সমাজে বেকারত্বের কারণে অনেক তরুণ নিজেকে অপ্রয়োজনীয় মনে করেন। অনেক সময় পরিবার ও সমাজের চাপেও মনে তৈরি হওয়া হতাশা থেকে মানুষ ভুল পথে পা বাড়ান।
৩. সম্পর্ক ভাঙ্গন ও পারিবারিক দ্বন্দ্ব: প্রেমের সম্পর্ক ভাঙন, বিবাহিত জীবনের টানাপোড়েন কিংবা পরিবারে অবহেলা মানসিকভাবে দুর্বল করে তোলে। যখন কেউ তার সবচেয়ে কাছের মানুষের কাছ থেকেই প্রত্যাশিত মানসিক সমর্থনও পান না, তখন তিনি একা হয়ে পড়েন। সেই শূন্যতা পূরণ করার পথ খুঁজে না পাওয়ায়, অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। বিশেষ করে তরুণ তরুণীরা এই কারণে বেশি প্রভাবিত হয়।
৪. সামাজিক চাপ ও কলঙ্কের ভয়: আমাদের সমাজে ব্যর্থতাকে গ্রহণ করার জায়গা খুব কম। পরীক্ষায় খারাপ ফল, পেশাগত জীবনে ব্যর্থতা বা সামাজিক মর্যাদাহানি এসব কারণে অনেকেই প্রচণ্ড চাপ অনুভব করেন। ‘মানুষ কি বলবে’ এই ভয়ে অনেকে আত্মহত্যাকে শেষ সমাধান মনে করেন। তাছাড়া আত্মহত্যার চিন্তা করলে বা মানসিক সমস্যায় পড়লে সাহায্য নেওয়ার প্রবণতাও সমাজে কম। কেননা মানসিক অসুস্থতাকে এখনও লজ্জার বিষয় হিসেবে দেখা হয়।
৫. নেশায় আসক্তি: মাদকাসক্তি বা অতিরিক্ত নেশার কারণে আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়ে। মাদকের প্রভাবে মস্তিষ্কের ভারসাম্য নষ্ট হয়, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে। অনেক সময় মাদক নেওয়ার পর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে বা আবেগতাড়িত হয়ে আত্মহত্যা পথে ঝুঁকেন অনেকে।
৬. শারীরিক অসুস্থতা: দীর্ঘদিন ধরে ক্যানসার, কিডনি জটিলতা, প্যারালাইসিস বা অন্য কোনো কঠিন রোগে ভুগতে থাকা মানুষরা অনেক সময় জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। শারীরিক যন্ত্রণা ও চিকিৎসার খরচের চাপ মিলে তাদের মনে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা ধীরে ধীরে কমে যায়।
৭. সামাজিক মাধ্যমে হয়রানি: একযুগের বেশি সময় ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হয়রানি, ট্রল বা সাইবার বুলিং আত্মহত্যার নতুন কারণ হয়ে উঠছে। বিশেষ করে কিশোর-কিশোরীরা অনলাইনে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। অনলাইনে চাকচিক্য দেখে কেউ কেউ নিজেকে ছোট মনে করে হতাশায় ভুগছে, যা আত্মহত্যার দিকে তাদের ঠেলে দিচ্ছে। অথচ এসবই শুভঙ্করের ফাঁদ!
আজ বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। বিভিন্ন স্থানে সচেতনামূলক অনুষ্ঠান, সেমিনার, র্যালি কিংবা আলোচনা সভা হবে ঠিকই। বক্তৃতায় বলা হবে সচেতনতার কথা। প্রচার হবে মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়ার গুরুত্ব। তবে এগুলো করে প্রতিরোধ কতটা করতে পেরেছি? কতজন মানুষের হৃদয়ে পৌঁছাতে পেরেছি? কজনের মনোযন্ত্রণা ভাঙতে পেরেছি? মেডিটেশন, কাউন্সেলিং কিংবা সাইকিয়াট্রিস্ট দেখিয়ে কতটা রোধ করতে পেরেছি!
আসলে পরিবার, বন্ধু কিংবা সমাজের সহমর্মিতা ছাড়া, এরকম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা, রোধ করা পুরোপুরি সম্ভব নয়। কাছের মানুষ যদি মনোযোগ দিয়ে শোনে, পাশে থাকে, মানসিক চাপ ভাগ করে নিতে সাহায্য করে; তাহলেই অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়ানো সম্ভব।
কেএসকে/জেআইএম