আধুনিক যুগে বায়োস্কোপের ফেরিওয়ালা হিরু
মোহাম্মদ হিরু ৪৭ বছরের মধ্যবয়স্ক মানুষ। মাথার চুলে এখনো পাক ধরেনি। জন্ম বগুড়ার ধূনট উপজেলায়। দুই ছেলে এবং এক মেয়ে নিয়ে সংসার। মেয়ে পড়েন একাদশ শ্রেণিতে। এক ছেলে পড়ে অষ্টম শ্রেণিতে এবং আরেকজনের বয়স অল্প। শৈশবে তেমন পড়াশোনার সুযোগ হয়নি হিরুর। অল্প বয়সে মা পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যান।১৯৮৬ সাল। তখন থেকে তার জীবনটা কষ্টকর হয়ে ওঠে। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে সবাই পড়াশোনা করতে স্কুলে যান। হিরু তখন বাবার সাথে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ান। হাট-বাজার চষে বেড়ান। একদিন বাবার সাথে দুর্গাপূজা উপলক্ষে মেলায় যান। তখন পাঁচ-দশ পয়সার প্রচলন ছিল।হিরু খেয়াল করলেন, এক ব্যক্তি একটা বড় বাক্স নিয়ে বসে আছেন। বাক্সের ফাঁকগুলো দিয়ে উৎসুক জনতা কিছু একটা দেখছে। তার কৌতূহলী মন, বাবার কাছে বায়না করলেন, তিনিও দেখবেন। তখন চার আনা দিয়ে প্রথম বায়োস্কোপ দেখেন। ভাবেন, কোথা থেকে এই ছবি ও সিনেমা আসে। ভেতর থেকে এত আলোই বা আসে কোথা থেকে। হিরুর বয়স তখন ৯ বছর। তখন থেকেই মনের কোণে ইচ্ছে জাগে, বড় হয়ে একদিন বায়োস্কোপ বানাবেন।কৈশোর পার করে যুবক বয়সে পা দিয়েছেন হিরু। অভাবের সংসার আর চলছিল না। কর্মের খোঁজে ১৯৯৫ সালে প্রথম ঢাকায় পাড়ি জমান। চাকরি নেন
মোহাম্মদ হিরু ৪৭ বছরের মধ্যবয়স্ক মানুষ। মাথার চুলে এখনো পাক ধরেনি। জন্ম বগুড়ার ধূনট উপজেলায়। দুই ছেলে এবং এক মেয়ে নিয়ে সংসার। মেয়ে পড়েন একাদশ শ্রেণিতে। এক ছেলে পড়ে অষ্টম শ্রেণিতে এবং আরেকজনের বয়স অল্প। শৈশবে তেমন পড়াশোনার সুযোগ হয়নি হিরুর। অল্প বয়সে মা পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যান।
১৯৮৬ সাল। তখন থেকে তার জীবনটা কষ্টকর হয়ে ওঠে। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে সবাই পড়াশোনা করতে স্কুলে যান। হিরু তখন বাবার সাথে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ান। হাট-বাজার চষে বেড়ান। একদিন বাবার সাথে দুর্গাপূজা উপলক্ষে মেলায় যান। তখন পাঁচ-দশ পয়সার প্রচলন ছিল।
হিরু খেয়াল করলেন, এক ব্যক্তি একটা বড় বাক্স নিয়ে বসে আছেন। বাক্সের ফাঁকগুলো দিয়ে উৎসুক জনতা কিছু একটা দেখছে। তার কৌতূহলী মন, বাবার কাছে বায়না করলেন, তিনিও দেখবেন। তখন চার আনা দিয়ে প্রথম বায়োস্কোপ দেখেন। ভাবেন, কোথা থেকে এই ছবি ও সিনেমা আসে। ভেতর থেকে এত আলোই বা আসে কোথা থেকে। হিরুর বয়স তখন ৯ বছর। তখন থেকেই মনের কোণে ইচ্ছে জাগে, বড় হয়ে একদিন বায়োস্কোপ বানাবেন।
কৈশোর পার করে যুবক বয়সে পা দিয়েছেন হিরু। অভাবের সংসার আর চলছিল না। কর্মের খোঁজে ১৯৯৫ সালে প্রথম ঢাকায় পাড়ি জমান। চাকরি নেন এনজিও অফিসের পিয়ন হিসেবে। চা বানানো, চেয়ার-টেবিল মুছে দেওয়ার কাজ করেন। বিনিময়ে পেতেন প্রতিদিনের খাবার আর মাসে ২০০ টাকা। এ কাজ চলে তিন বছর।
এরপর বাসের হেলপারি শুরু করেন। হেলপার পেশায় বেশি দিন টিকতে পারেননি। শেষমেষ রিকশা চালানো শুরু করেন। তখন এক বড় ভাই বললেন, ‘একটা অফিসে লোক নেবে, তুমি কাজ করতে পারবে? বিকেল পাঁচটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত।’ তিনি বললেন, ‘কাজ কি?’ জন্মদিনে টম অ্যান্ড জেরি, মটু পাতলু, বাঘ ও হাতির পোশাক পড়ে জোকার ও মিমিক্রি করে বাচ্চাদের আনন্দ দেওয়ার কাজ। বিভিন্ন ভঙ্গিতে নাচ করা এবং তাদের চকলেট দেওয়া।
তখন হিরু এ কাজ করতে নেমে পড়েন। শিখে গেলেন ছোট ছোট শিশুদের আনন্দ দেওয়ার কাজটি। সেসময় একদিন ওস্তাদ বললেন, ‘হিরু তুই একটা বায়োস্কোপ বানা।’ হিরু মনের অজান্তেই বলে ফেলেন, ‘আমার স্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে।’ তখন থেকে শুরু হলো বায়োস্কোপের সাথে পথচলা।
২০০০ সালে প্রথম শুরু করেন। তখন বাচ্চা ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে বয়স্ক লোকজনও বায়োস্কোপ দেখতেন। গ্রামবাংলার ঐতিহ্য শহরের মানুষজনের তেমন একটা চোখে পড়ে না। প্রথমদিকে নায়ক-নায়িকার সিনেমার গল্প দেখানো হতো। এখন গরুর গাড়ি, পালকিতে বিয়ে, বাঁশের সাঁকো, বইপত্র হাতে নিয়ে স্কুলে যাওয়ার দৃশ্য, বৃষ্টির দিনে মাথায় পলিথিন ব্যবহারের দৃশ্য, গরু দিয়ে হাল চাষ, ছনের ঘর, মাটির ঘর, গ্রামের হাডুডু খেলা, গ্রাম্য মেলা, ঢেঁকিতে ধান ভাঙা—বিষয়গুলো ফুটিয়ে তোলা হয়। সাধারণত গ্রামবাংলার প্রাণ-প্রকৃতির দৃশ্যগুলো দেখানো হয়।
মোহাম্মদ হিরু বলেন, ‘বায়োস্কোপ দেখানোর পাশাপাশি আমি ডরিমন, মটু পাতলু, টম অ্যান্ড জেরি, বাঘ ও হাতি পোশাকে জোকার ও মিমিক্রি করি। বাচ্চাদের বিভিন্ন ভঙ্গিতে নাচানাচি করে আনন্দ দিয়ে থাকি। বাচ্চাদের বিনোদন দিতে ভালো লাগে। জোকার সেজে বাচ্চাদের সাথে নাচি। তারাও আমার সাথে নাচ করে। তাদের চকলেট দিই। বাচ্চাদের আনন্দ দিতে বিকেল হলে লেকের পাড়ে আসি। কাজটি এনজয় করি।’
হিরু বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়, পিকনিক অনুষ্ঠান, রেস্টুরেন্ট, ব্যাংক প্রতিষ্ঠান, রিসোর্ট এবং স্কুলে ক্লাস পার্টিতে বাচ্চাদের আনন্দ দিতে যান। এ ছাড়া ঢাকার অভিজাত এলাকা উত্তরা, গুলশান, বারিধারা, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুরে বায়োস্কোপ নিয়ে জোকার ও মিমিক্রি করেন।
হিরুর কাছে জানতে চাইলাম, ‘এখন কেমন সাড়া পান’। তিনি বলেন, ‘আগেরকার মানুষজন খুব আগ্রহ নিয়ে বায়োস্কোপ দেখতেন। তখন টেলিভিশন বা স্মার্ট ফোন ছিল না। বাংলার ঐতিহ্য ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। তবে এখন তাদের সন্তানদের দেখান। ছোট বাচ্চারা দেখেন। সাধারণত শুক্রবারে চাপ বেশি থাকে।’
এত পেশা থাকতে এই পেশায় কেন? তিনি ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে বলেন, ‘প্রথমে দুই বছর কাজ শেখা হয়। এরপর থেকে ২৩ বছর এই কাজে আছি। এখন পর্যন্ত এই পেশাকে মনে-প্রাণে ভালোবেসে আছি। এই পেশার পাশাপাশি অন্য কাজ করি। সকাল থেকে অটোরিকশা চালাই বা শাক-সবজি বিক্রি করি। বিকেলে ধানমন্ডি লেকে বায়োস্কোপ নিয়ে বসি। হালাল পথে উপার্জন করি। মাঝেমধ্যে গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হয়। সেখানে নিজের জমিতে চাষাবাদ করা হয়।’
২০২২ সালের ঘটনা। হিরুকে ভাড়া করে নেওয়া হয়েছে নোয়াখালীতে। সেখানে গিয়েছিলেন এক স্কুলের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে। প্রায় দুই হাজার ছাত্রছাত্রী। একা মানুষ, একটা বায়োস্কোপ। অবস্থা দেখে তিনি অবাক হয়ে যান। কীভাবে এত শিক্ষার্থীকে বায়োস্কোপ দেখাবেন। তখন স্কুলের শিক্ষকের অনুরোধে অল্প সময় করে দেখানো হয়। অল্প সময় বলতে, মাত্র পাঁচ সেকেন্ড করে দেখানো হয়। সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এরকম হিরুর জীবনে আগে কখনো ঘটেনি। তার কাছে বিষয়টি খুব মজার ছিল।
জানতে চাইলাম, ‘এই পেশায় আয় কত?’ হিরু বলেন, ‘প্রায় প্রতিদিন বিকেলে ধানমন্ডি লেকের ভেতরে বায়োস্কোপ নিয়ে বসার চেষ্টা করি। শুক্রবার ২০০০ থেকে ২৫০০ টাকার কাজ হয়। অন্যান্য দিন গড়ে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকার মতো কাজ করি। এ ছাড়া ক্লাস পার্টিতে সকাল ৮টা থেকে ২টা পর্যন্ত থাকলে ৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়। অন্যান্য অনুষ্ঠানে এই পরিমাণ টাকাই পাওয়া হয়। ঢাকাতে বিভিন্ন পারিবারিক অনুষ্ঠানে যাই। সেখানে বাচ্চাদের আনন্দ দিই। এতে বাচ্চার অভিভাবকরা খুশি হয়ে বকশিস দিয়ে থাকেন।’

পহেলা বৈশাখ, ঈদ, পূজা, একুশে ফেব্রুয়ারি, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, ভালোবাসা দিবস ও শীতকালীন মেলায় চাহিদা থাকে বেশি। রোজার মাসে কাজ বন্ধ থাকে। তখন ধানমন্ডিতে সাত মসজিদ রোডের একটি ভবনের সামনে দাঁড়ান। ‘ধানমন্ডি এলাকায় দুটি প্রতিবন্ধী শিশু থাকে। তাদের টাকা-পয়সার কমতি নেই। পরিবারের লোকজন শত চেষ্টা করেও তাদের হাসাতে পারেননি। তবে আমি বায়োস্কোপ নিয়ে একটু নাচ করলেই তাদের মুখে হাসি ফোটে’, বলছিলেন মোহাম্মদ হিরু।
হিরু যতদিন বেঁচে থাকবেন; ততদিন বায়োস্কোপকে আগলে রাখতে চান। যদিও তার সন্তানরা এ পেশায় আসবেন না। তারা পড়াশোনা করে সরকারি চাকরি করতে চান। তার একজন সাহায্যকারী আছেন। যিনি তার কাজগুলো মাঝেমধ্যে তদারকি করেন। তাকে হিরু প্রায়ই বলেন, ‘আমি মারা গেলে তুই বাংলার ঐতিহ্য ধরে রাখবি, আমার কাজটা করবি।’
এসইউ
What's Your Reaction?