আন্দোলন সামলাতেই বেশি ব্যস্ততা, ৭ মাসে হত্যা-ডাকাতিসহ ১০৪০ মামলা

2 hours ago 3

ঘটনাটি গত ২৮ জুনের। লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ থেকে অসুস্থ ছেলে নাঈম হোসেনের চিকিৎসার জন্য ঢাকায় এসেছিলেন সৌদিপ্রবাসী মনির হোসেন ও স্বপ্না আক্তার দম্পতি। রাত কাটানোর জন্য তারা উঠেছিলেন মগবাজারের একটি আবাসিক হোটেলে। রাতে যথারীতি খাবার খেয়ে তিনজন শুয়ে পড়েন। পরদিন হোটেলের কক্ষ থেকে উদ্ধার করা হয় তাদের মরদেহ। অভিযোগ ওঠে, মনিরের সম্পদ হাতিয়ে নিতে খাবারে বিষাক্ত পদার্থ মিশিয়ে তাদের হত্যা করা হয়।

গত ৮ অক্টোবর মালিবাগের ফরচুন শপিংমলের ‘শম্পা জুয়েলার্স’ থেকে অভিনব পন্থায় প্রায় ৫০০ ভরি স্বর্ণালংকার চুরি হয়। সিসিটিভি ফুটেজে বোরকা পরা দুই ব্যক্তিকে তালা কেটে দোকানে প্রবেশ করে চুরি করতে দেখা যায়। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে চারজনকে গ্রেফতার ও তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ চোরাই স্বর্ণালংকার জব্দ করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)।

দুটি ঘটনাই ঘটেছে ডিএমপির ছয়টি থানা নিয়ে গঠিত রমনা বিভাগের মধ্যে। সেখানে প্রায়ই ঘটছে হত্যা, চুরি, ডাকাতি, দস্যুতা, ধর্ষণ, শিশু নির্যাতন, অপহরণসহ বিভিন্ন অপরাধ।

সব মিলিয়ে রমনা বিভাগের বিভিন্ন থানায় মামলা হয়েছে জানুয়ারিতে ১৬৭টি, ফেব্রুয়ারিতে ১৩৮টি, মার্চে ১৬৪টি, এপ্রিলে ১৪০টি, মে মাসে ১৫৫টি, জুনে ১৫১টি ও জুলাইয়ে ১২৫টি। আর গ্রেফতার করা হয়েছে জানুয়ারিতে ৪৩০ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৪১৫ জন, মার্চে ৪৯৬ জন, এপ্রিলে ৪৮৬ জন, মে মাসে ৫১১ জন, জুনে ৩৫২ জন ও জুলাইয়ে ৪৯৪ জনকে।

প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন, সচিবালয়, সুপ্রিম কোর্টসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের অবস্থান এই রমনা বিভাগে। গত বছরের ৮ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর নিয়মিত একের পর আন্দোলন হচ্ছে এই বিভাগে। ঘটছে সড়ক অবরোধ, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা।

রমনা বিভাগের থানাগুলো হলো রমনা মডেল থানা, ধানমন্ডি মডেল থানা, শাহবাগ থানা, নিউমার্কেট থানা, হাজারীবাগ থানা ও কলাবাগান থানা।

আন্দোলন সামলাতেই বেশি ব্যস্ততা, ৭ মাসে হত্যা-ডাকাতিসহ ১০৪০ মামলা
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)

ডিএমপির তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে রমনা বিভাগের থানা এলাকায় নানান অপরাধে মোট এক হাজার ৪০টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছে মোট তিন হাজার ১৮৪ জনকে।

মামলার ধরন
ডিএমপির রমনা বিভাগে ডাকাতির ঘটনায় জানুয়ারি মাসে দুটি এবং ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে একটি করে মোট চারটি মামলা হয়। দস্যুতার ঘটনায় জানুয়ারিতে ছয়টি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চে তিনটি করে, এপ্রিলে একটি, মে মাসে দুটি, জুনে একটি ও জুলাইয়ে চারটি মামলা হয়। খুনের অভিযোগে মামলা হয় জানুয়ারিতে চারটি, মার্চে একটি, মে মাসে তিনটি, জুনে সাতটি ও জুলাইয়ে দুটি।

এছাড়া এসময়ে দ্রুত বিচার আইনে সাতটি ও দাঙ্গার অভিযোগে একটি মামলা করা হয়।

নারী নির্যাতন মামলার তথ্যে বলা হয়- ধর্ষণের ঘটনায় জানুয়ারিতে চারটি, ফেব্রুয়ারিতে একটি, মার্চে তিনটি, এপ্রিলে চারটি, মে মাসে নয়টি এবং জুন ও জুলাইয়ে দুটি করে মামলা হয়। অন্যান্য নির্যাতনের মামলা হয়েছে সাত মাসে ৩৩টি।

শিশু নির্যাতনের অভিযোগে জানুয়ারিতে চারটি, ফেব্রুয়ারিতে তিনটি, মার্চে চারটি, এপ্রিলে তিনটি, মে মাসে পাঁচটি, জুনে ছয়টি ও জুলাইয়ে ১০টি মামলা করা হয়। অপহরণের ঘটনায় মামলার সংখ্যা সব মিলিয়ে ১৯টি।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ডিএমপি গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। অপরাধ দমন, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, মাদকবিরোধী অভিযান, সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধ ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ডিএমপি নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে।- উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান

এসময় পুলিশ আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় মামলা হয়েছে ১২টি। এছাড়া সিঁধেল চুরির অভিযোগে সাত মাসে ২৮টি এবং অন্যান্য চুরির ঘটনায় জানুয়ারিতে ১৬টি, ফেব্রুয়ারিতে ১৮টি, মার্চে ২৩টি, এপ্রিলে ১২টি, মে মাসে ১৯টি, জুনে ১৮টি ও জুলাইয়ে ১১টি মামলা হয়েছে।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলা হয় একটি। সেই সঙ্গে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় দুটি, ‍সড়ক দুর্ঘটনায় ১৩টি, চোরাচালান ব্যতীত বিশেষ ক্ষমতা আইনে চারটি এবং মুদ্রা ও স্টাম্প সংক্রান্ত একটি মামলা হয়েছে।

অন্যান্য ঘটনায় জানুয়ারিতে ৫৫টি, ফেব্রুয়ারিতে ৬০টি, মার্চে ৬৯টি, এপ্রিলে ৫৬টি, মে মাসে ৫৫টি, জুনে ৩৪টি ও জুলাইয়ে ৩৭টি মামলা হয়েছে। একই সময়ে অস্ত্র আইনে ৩৮টি এবং বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে চারটি মামলা করা হয়েছে।

আন্দোলন সামলাতেই বেশি ব্যস্ততা, ৭ মাসে হত্যা-ডাকাতিসহ ১০৪০ মামলা
সৌদিপ্রবাসী মনির হোসেন, তার স্ত্রী স্বপ্না আক্তার ও ছেলে নাঈম হোসেন/ছবি: সংগৃহীত

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে জানুয়ারিতে ৪৯টি, ফেব্রুয়ারিতে ৪১টি, মার্চে ৩৮টি, এপ্রিলে ৪৬টি, মে মাসে ৩৭টি, জুনে ৩৮টি ও জুলাইয়ে ৩৭টি মামলা হয়েছে। সেই সঙ্গে চোরাচালানের ঘটনায় সাত মাসে সাতটি মামলা হয়েছে।

সব মিলিয়ে রমনা বিভাগের বিভিন্ন থানায় জানুয়ারিতে ১৬৭টি, ফেব্রুয়ারিতে ১৩৮টি, মার্চে ১৬৪টি, এপ্রিলে ১৪০টি, মে মাসে ১৫৫টি, জুনে ১৫১টি ও জুলাইয়ে ১২৫টি মামলা হয়েছে। আর গ্রেফতার করা হয়েছে মোট তিন হাজার ১৮৪ জনকে। তাদের মধ্যে জানুয়ারিতে ৪৩০ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৪১৫ জন, মার্চে ৪৯৬ জন, এপ্রিলে ৪৮৬ জন, মে মাসে ৫১১ জন, জুনে ৩৫২ জন ও জুলাইয়ে ৪৯৪ জন গ্রেফতার হন।

যা বলছেন ওসিরা
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খালিদ মনসুর জাগো নিউজকে বলেন, ‘আসামি গ্রেফতার করা আমাদের নিয়মিত কাজ। অপরাধ দমনে আমাদের যে পেট্রোল টিম, নাইট পেট্রোল, ডে পেট্রোল সেগুলো জোরদার করা হয়েছে। আগে আমাদের চারটা পেট্রোল টিম ছিল, এখন ছয়টা পেট্রোল টিম কাজ করছে। আমাদের থানা এলাকায় অপরাধীরা যাতে বিচরণ করতে না পারে, তাদের গ্রেফতারের জন্য নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি। এছাড়া যাদের নামে ওয়ারেন্ট আছে কিন্তু এখনো গ্রেফতারের আওতায় আসেনি, তাদের গ্রেফতারের আওতায় নিয়ে আসতে অভিযান চালাচ্ছি। সার্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। আমাদের এলাকায় অপরাধ করার প্রবণতা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে।’

ধানমন্ডি থানার ওসি ক্যশৈন্যু মারমা জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রথমত আমরা টহল জোরদার করেছি। সুনির্দিষ্ট তথ্যের ওপর ভিত্তি করে অভিযান চালাচ্ছি। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে অভিযান থেকে শুরু করে যত ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করা যায় সব কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি।’

পুলিশ কর্তৃপক্ষের বক্তব্য
অপরাধ নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. মাসুদ আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা তিনটা দিকে কাজ করি। একটা হচ্ছে প্রিভেনশন নিয়ে, যেমন: কোনো একটা ঘটনা যাতে না ঘটতে পারে। মানে ঘটনা ঘটার আগেই যাতে আমরা সমস্যাটা সমাধান করতে পারি, সেটার জন্য যতটুকু ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন সেই চেষ্টা করি। এটা আমাদের যে পেট্রোলিং ব্যবস্থা আছে, দিনের বেলা মোটরসাইকেলের মাধ্যমে পেট্রোলিং টিম আছে, ফুট পেট্রোলিং আছে, ফাঁড়িগুলো আছে; তারা আলাদা আলাদা করে কাজ করে। বিভিন্ন রকম চেকপোস্ট করা হয়। এগুলো হচ্ছে প্রিভেনটিভ।’

‘আরেকটা হচ্ছে ডিটেক্টিভ। সেটা হচ্ছে কোনো একটা ঘটনা ঘটলে সেগুলো ডিটেকশনের জন্য আমরা কাজ করি। বলা যায় রমনা ডিভিশনে ঘটনা ঘটার প্রবণতাটা বেশি। আর সেগুলো ডিটেকশনের হার প্রায় শত ভাগ।’

আন্দোলন সামলাতেই বেশি ব্যস্ততা, ৭ মাসে হত্যা-ডাকাতিসহ ১০৪০ মামলা
দোকানের সামনে বোরকা পরা ব্যক্তিরা/ছবি: সিসিটিভি ফুটেজ থেকে সংগৃহীত

‘এরপর আরেকটা হচ্ছে ইনভেস্টিগেশন এবং প্রসিকিউশন। প্রতি মাসেই যে মামলাগুলো হয় আমরা চেষ্টা করি তার থেকে বেশি যেনো খারিজ হয়। যাতে বেশি মামলা পেন্ডিং না থাকে। যে মামলাগুলো সেনসেটিভ সেগুলো আমরা পিবিআই, সিআইডি বা আমাদের যারা ডিবিতে আছে তাদের কাছে হস্তান্তর করি।’

ডিসি মাসুদ আলম বলেন, বিশেষ করে আমাদের রমনা ডিভিশনে শাহবাগ ও রমনা থানা এলাকায় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা (কেপিআই) আছে। যেমন: বাংলাদেশ সচিবালয়, প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন, জাতীয় প্রেস ক্লাব, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ, সিটি কলেজ এগুলোতে প্রায়ই ঘটনা থাকেই। আর আন্দোলনকারীরা মোটামুটি সারাদেশ থেকে এখানেই আসে। এই নন-অর্ডার সিচুয়েশন মেইনটেইন করতে করতেই আমাদের মোটামুটি অবস্থা খারাপ। প্রতিদিন আমরা দেখছি এসব এলাকায় ১০, ১২, ১৪টা পর্যন্ত গ্রুপ আন্দোলন করতে এসব এলাকায় আসে। বিভিন্ন ধরনের ইস্যু থাকে। আমরা এগুলো প্রথমে সমঝোতার চেষ্টা করি। তারপরও যদি সেটা সফল না হয় তখন সীমিত আকারে বলপ্রয়োগের চেষ্টা করি।’

অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কড়া অবস্থানে থাকার কথা বলছে ডিএমপিও। এ নিয়ে কথা হলে ডিএমপির গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপ-কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ডিএমপি গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। অপরাধ দমন, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, মাদকবিরোধী অভিযান, সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধ ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ডিএমপি নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে।

তালেবুর রহমান জানান, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে গোয়েন্দা কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে টহল দল নিয়মিত মাঠে কাজ করছে।

কেআর/একিউএফ/এমএমএআর/এমএফএ/জেআইএম

Read Entire Article