সম্প্রতি কাতারের রাজধানী দোহায় বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস নেতাদের লক্ষ্য করে হামলায় কাতারের একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা ছাড়াও হামাসের পাঁচ সদস্য নিহত হন। এতে সাময়িক উত্তেজনা, আতঙ্ক তৈরি হলেও দেশটির শ্রমবাজারে এর প্রভাব পড়েনি। তবে ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক হতে বলে মনে করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
ইসরায়েলি হামলার ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশটিতে কিছুটা উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। দেশটিতে নির্মাণ, সেবা ও জ্বালানি খাতে কয়েক লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক কর্মরত। অন্য দেশের শ্রমিকও থাকেন কয়েক লাখ। তবে হামলার পর তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি বলে জানিয়েছেন সেখানে অবস্থানরত প্রবাসীরা। তারা নিরাপদ আছেন।
কাতারে অবস্থানরত কয়েকজন বাংলাদেশি শ্রমিক জাগো নিউজকে জানান, দৈনন্দিন কাজ স্বাভাবিকভাবে চলছে। আমাদের কাজের সময়সূচি কিংবা উপস্থিতি নিয়ে কোনো পরিবর্তনের ঘোষণা নেই। আমাদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে যেন আতঙ্কিত না হয়ে কাজ চালিয়ে যাই।
হামাসের অফিস যেখানে অবস্থিত, সেখানে বাংলাদেশি শ্রমিকদের সরিয়ে রাখার মতো প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি। হাইকমিশনের উচিত কর্মীদের নিয়মিত মেসেজ দিয়ে সতর্ক করা। আপাতত কোনো বিপদ নেই, তবে ভবিষ্যতে কোনো অঘটন এড়াতে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেওয়া একান্ত প্রয়োজন।- অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর
কাতারের একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশি ইয়াসিন হামিদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘যেখানে হামলা হয়েছে এটা দোহায়। ওই এলাকায় শ্রমিকের ব্যারাক কম। কাতারের নাগরিকদের মুখে শুনেছিলাম হামাসের আশপাশে কর্মীদের কিংবা নাগরিকদের বাসভবন কম। এছাড়া এখানে আমাদের বাংলাদেশি কমিউনিটির গ্রুপগুলোতে কোনো হতাহতের খবর শুনিনি।’
- আরও পড়ুন
কাতারে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল
দোহায় জরুরি বৈঠকে বসছে মুসলিম দেশগুলো
উন্মুক্ত হলো কাতারের শ্রমবাজার, খুশি প্রবাসী বাংলাদেশিরা
বাংলাদেশি কর্মীদের দক্ষতার প্রশংসায় কাতারের শ্রমমন্ত্রী
কাতারে অবস্থানরত আরেক প্রবাসী রকি আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘এরকম হামলায় উদ্বিগ্ন থাকতে হয়। ইরান যখন যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিতে হামলা চালায় তখনও ভয়ে ছিলাম। দেশে আমাদের পরিবার চিন্তা করে। এক্ষেত্রে আমরা দূতাবাসের সহযোগিতা চাই।’
ইসরায়েলের এ হামলায় কর্মসংস্থান বা অভিবাসন প্রক্রিয়ায় তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না বলে মনে করেন অভিবাসন বিশ্লেষক ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা। তবে মধ্যপ্রচ্যের বিভিন্ন দেশে ইসরায়েলের হামলার বিষয়ে বাংলাদেশকে সতর্ক হতে হবে।
অভিবাসী ও শরণার্থী বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিগত কয়েক বছর ধরে প্রায়ই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে হামাসের কার্যক্রম ও অফিস লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। লেবানন থেকে অনেক কর্মী ফেরতও আসছে। যেহেতু আমাদের বিদেশি শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্যনির্ভর, তাই ইসরায়েলের হামলা নিয়ে আমাদের ভাবতে হব।’
আমাদের শ্রমিকরা যে অঞ্চলে থাকে, সেখানে হামাসের কোনো অফিস থাকার কথা না। এটা নিয়ে কাতারও কনসার্ন। এসব দেশে শুধু বাংলাদেশিরা থাকে না— ভারতীয়, পাকিস্তানিসহ সবাই একসঙ্গে ক্যাম্পে থাকে। কাতার এখন নিরাপদ, এটাই বলা যায়। এখানে এখনো কোনো অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি।- পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পশ্চিম এশিয়া অনুবিভাগের পরিচালক মোস্তফা জামিল খান
তিনি বলেন, ‘গত ৯ সেপ্টেম্বরের ঘটনায় হয়তো আমাদের শ্রমিকরা নিরাপদে আছেন, কাতারও নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। কিন্তু বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের যে সংকট, সে কারণে আমাদের শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশাসনকে কনসার্ন হতে হবে। আমাদের হাইকমিশনকে নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে।’
‘হামাসের অফিস যেখানে অবস্থিত, সেখানে বাংলাদেশি শ্রমিকদের সরিয়ে রাখার মতো প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি। হাইকমিশনের উচিত কর্মীদের নিয়মিত মেসেজ দিয়ে সতর্ক করা। একই সঙ্গে দোহায় বাংলাদেশ হাইকমিশনকে সব সময় সতর্ক থাকতে হবে। আপাতত কোনো বিপদ নেই, তবে ভবিষ্যতে কোনো অঘটন এড়াতে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেওয়া একান্ত প্রয়োজন।’- যোগ করেন আসিফ মুনীর।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পশ্চিম এশিয়া অনুবিভাগের পরিচালক মোস্তফা জামিল খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের শ্রমিকরা যে অঞ্চলে থাকে, সেখানে হামাসের কোনো অফিস থাকার কথা না। কাতারের নাগরিকদেরও একই বিষয়। এটা নিয়ে কাতারও কনসার্ন। হামাসের অফিস কোনো জনবসতি এলাকায় হয় না। এসব দেশে শুধু বাংলাদেশিরা থাকে না— ভারতীয়, পাকিস্তানিসহ সবাই একসঙ্গে ক্যাম্পে থাকে। কাতার এখন নিরাপদ, এটাই বলা যায়। এখানে এখনো কোনো অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে যারা কাজ করে তারা মূলত মালিকদের তৈরি বড় বড় ক্যাম্পে থাকে। অনেক সময় একেকটা ক্যাম্পে হাজারখানেক বাংলাদেশিও থাকে। সেখান থেকে তাদের কাজে নেওয়া হয় এবং সন্ধ্যায় ফেরত আনা হয়।’
জামিল খান বলেন, ‘হামাসের অফিস বা অবস্থান কোথায়, সেটা আসলে কেউ জানে না। কোনো কর্মী এখনো হাইকমিশনে অভিযোগ করেনি। যদি কখনো হুমকির পরিস্থিতি তৈরি হয়, যেমন ইরানে হয়েছিল বড় ধরনের যুদ্ধের সময়, তখন ভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তখন আমাদের কর্মীদের ফেরত আনার বিষয়ে চিন্তা করা হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘সাধারণত ইসরায়েলের আক্রমণগুলো অত্যন্ত লক্ষ্যভিত্তিক হয়। যেমন, আগে ইরানে দেখা গেছে— যেখানে সেনা সদস্যরা থাকতো, শুধু সেই নির্দিষ্ট অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্ল্যাটেই হামলা চালানো হয়েছে।’
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, সবশেষ ২০২৪ সালে দেশটিতে ৭৪ হাজার ৪২২ জন বাংলাদেশি কর্মী গেছেন। চলতি বছরের ২০২৫ সালের প্রথম পাঁচ মাসে গেছেন ৪০ হাজার ৩০৮ জন। এর আগের ৪ বছরের গেছেন প্রায় এক লাখ শ্রমিক। বাংলাদেশি কর্মীদের পছন্দের তালিকায় থাকা শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর মধ্যে কাতার অন্যতম।
কাতার থেকে রেমিট্যান্স
শ্রমবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে স্থিতিশীল শ্রমবাজার হলো কাতার। দেশটিতে নিয়মিত হারে উল্লেখ্যযোগ্য সংখ্যক শ্রমিক যাচ্ছেন। বিএমইটির তথ্য বলছে, সবশেষ ২০২০ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে দেশটিতে কাজের উদ্দেশ্যে গেছেন ১ লাখ ৬৯ হাজার ৭৮৩ জন শ্রমিক। চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসেই গেছেন ৪০ হাজার। বছর শেষে এ সংখ্যা আরও বাড়বে।
২০২১-২২ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছে এক হাজার ৩৪৬ দশমিক ৪৭ মিলিয়ন ডলার, ২০২২-২৩ অর্থবছরে এসেছে এক হাজার ৪৫২ দশমিক ৬৯ মিলিয়ন ডলার, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছে ৯শ ৪২ দশমিক ৪৬ মিলিয়ন ডলার।
আরএএস/এএসএ/জেআইএম