জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যা মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের ষষ্ঠ সাক্ষী মো. সিয়াম আহসান আয়ানের জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেছেন, আবু সাঈদকে বাঁচাতে গিয়ে বাম পাশের পুরো শরীরে গুলিবিদ্ধ হই।
সিয়ামের বয়স ১৮ বছর। তিনি রংপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (আরসিসিআই) পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্র।
ট্রাইব্যুনালে সিয়াম বলেন, তৎকালীন সরকার আদালতের রায়ের মাধ্যমে ২০২৪ সালে কোটাব্যবস্থা ফের চালু করলে ওই বছরের জুলাই মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামের একটি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা পুরো দেশে আন্দোলন শুরু করেন। তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা, নাতিপুতি’ বলে সম্বোধন করেন এবং সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘এ আন্দোলন থামানোর জন্য ছাত্রলীগই যথেষ্ট।’ সরকারের এসব উসকানিমূলক বক্তব্যের পর আন্দোলন আরও বেগবান হতে শুরু করে।
সাক্ষী জানান, রংপুরে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগসহ তাদের অন্যান্য অঙ্গ সংগঠন এবং পুলিশ ও প্রশাসন আন্দোলনকারীদের হত্যার মাধ্যমে আন্দোলন দমনের পরিকল্পনা করে।
সিয়াম উল্লেখ করেন, ১৫ জুলাই রাতে রংপুরে তাদের সভা হয় এবং সেখানে তারা সিদ্ধান্ত নেন, ১৬ তারিখ দুপুর ১২টায় ছাত্ররা রংপুর জিলা স্কুলের সামনে একত্রিত হয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাবেন। সেখানে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগ দেবেন। সে অনুযায়ী তারা ঘটনার দিন স্কুলের সামনে একত্রিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে এগোতে শুরু করেন। পথে রংপুর পুলিশ লাইনসের সামনে পুলিশ তাদের লাঠিপেটা করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। তারা আবার একত্রিত হয়ে এগোতে শুরু করেন। সিয়াম তখন মিছিলের মাঝে অবস্থান করছিলেন। এ সময় সরকার ও পুলিশের ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশ ও সহায়তায় মিছিলে হামলা চালানো হয়। হামলা করেন রংপুর মহানগর পুলিশের ডিসি (ক্রাইম) আবু মারুফ, এডিসি (ডিবি) শাহানুর আলম পাটোয়ারী, এসি আরিফুজ্জামান, ওসি (তাজহাট) রবিউল ইসলাম, এসআই বিভূতী ভূষণ রায়, এএসআই আমির হোসেন, কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায়সহ পুলিশের ৪০-৫০ সদস্য। সেই সঙ্গে ছিলেন রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি পোমেল বড়ুয়া, সাধারণ সম্পাদক শামীম মাহফুজ, সাংগঠনিক সম্পাদক ধনঞ্জয় কুমার টগর, দপ্তর সম্পাদক বাবুল হোসেন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এমরান চৌধুরী আকাশসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ অন্যান্য সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
আরও পড়ুন
আবু সাঈদের ত্রুটিপূর্ণ সুরতহালে গুলির কথা না লিখতে বাধ্য করা হয়
‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলায় শিক্ষার্থীরা অপমানিত বোধ করেছিলেন
জুলাই আন্দোলন-গ্রাফিতির বিরোধিতাকারীরা কখনো ফিরে আসবে না
ট্রাইব্যুনালে সাক্ষী বলেন, পুলিশ বাহিনী আমাদের ওপর কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। যার প্রতিবাদে আবু সাঈদ সড়ক বিভাজকের পশ্চিম পাশে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেট বরাবর তার দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে যান। পুলিশ বাহিনী থেকে তাকে গুলি করা হয়। তখন আমি বিয়াম শপিং কমপ্লেক্সের সামনে রাস্তার পূর্ব পাশে অবস্থান করছিলাম। সেখান থেকে আমি আবু সাঈদকে দেখতে পারছিলাম। গুলি খেয়ে আবু সাঈদ তার ভারসাম্য হারিয়ে সড়ক বিভাজকের পূর্ব পাশে চলে আসেন। তখন আনুমানিক ২টা ১৭ মিনিট। আমি আবু সাঈদ ভাইকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে আসি। তখন তাকে আমি তুলে আমার ডান পাশে অর্থাৎ পূর্ব পাশে ঘুরিয়ে নিই। পুলিশের পক্ষ থেকে আবারও গুলি করা হয় এবং সেই গুলিতে আমি আহত হই। আমার বাম পাশের পুরো শরীরে গুলিবিদ্ধ হই।
এ সময় সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে তার শরীরে গুলির ক্ষতচিহ্ন দেখান। তিনি জানান, সাঈদ ভারসাম্য হারিয়ে তার হাত থেকে পড়ে যান। সাঈদের শরীর থেকে প্রচণ্ড পরিমাণে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। তখন এসি আরিফুজ্জামানের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল এসে সাঈদ ও অন্য আন্দোলনকারীদের ওপর লাঠিপেটা এবং সাঈদের মাথার পেছনে আঘাত করে। সিয়াম তারপর সাঈদকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাস্তার উত্তর পাশে, তৎকালীন পার্কের মোড়ের দিকে যেতে শুরু করেন এবং সেই মুহূর্তে আরও কিছু আন্দোলনকারী এসে তাকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান। তারপর তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
সিয়াম বলেন, আমি তখন পার্কের মোড়, বর্তমান আবু সাঈদ চত্বরে অবস্থান করি। আবু সাঈদের মৃত্যুর খবর যখন আমি ও অন্য আন্দোলনকারীরা জানতে পারি, আমরা বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ি এবং আন্দোলনকে আরও বেগবান করি। আমরা আরও লক্ষ্য করি যে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হাসিবুর রশিদ, প্রক্টর শরীফুল ইসলাম, সহকারী অধ্যাপক আসাদুজ্জামান, সহকারী অধ্যাপক মশিউর ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা রাফিউল, আপেল, আমুসহ আরও অনেকে ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, পুলিশসহ হামলাকারীদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করেন। ওই দিনের আন্দোলন শেষে আন্দোলনকারী এবং সংবাদ মাধ্যম থেকে জানতে পারি যে আরও অনেকে পুলিশ এবং হামলাকারীদের হামলায় আহত হন। এ মামলার সব আসামির সুষ্ঠু বিচার ও ফাঁসি চাই।
এফএইচ/একিউএফ/জিকেএস