জুলাই অভ্যুত্থানের নিহত রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদের মরদেহের ‘ত্রুটিপূর্ণ’ সুরতহাল প্রতিবেদন দিতে ‘বাধ্য করা হয়েছে’ বলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন পুলিশ সদস্য। তিনি বলেন, ‘আমাকে হুমকি দিয়ে বলা হয় কথা না শুনলে তোকে জামায়াত-শিবির বানিয়ে চালান দেব’।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে রংপুরের প্রথম শহীদ আবু সাঈদ হত্যা মামলায় সাক্ষী হিসেবে এসআই মো. তরিকুল ইসলাম তার জবানবন্দিতে এমন কথা বলেন।
তরিকুল ইসলাম গত বছর ১৬ জুলাই রংপুর কোতোয়ালি থানা এলাকা ও হাসপাতালে ইউডি (অপমৃত্যু) ডিউটি ছিলেন। ট্রাইব্যুনালে তিনি বলেন, আবু সাঈদের মাথার পেছনে গুলির আঘাত ছিল। কিন্তু গুলিতে মৃত্যুর কথা না লিখতে তাকে ‘বাধ্য করা হয়’।
এসময় তিনি জানান, স্ট্রেচারে রক্তমাখা মরদেহ। শরীরজুড়ে ছররা গুলির ক্ষত। আর মাথার পেছনে রক্তাক্ত চিহ্ন। এমন ভয়াবহ চিত্র নিজ চোখে দেখলেও সুরতহাল প্রতিবেদনে সত্য লুকানোর নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছিল, ছররা গুলির আঘাত লেখা যাবে না। আপত্তি জানাতেই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা হুমকি দিয়ে বলতেন, কথা না শুনলে তোকে জামায়াত-শিবির বানিয়ে চালান করে দেব।
মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) আবু সাঈদের মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের চতুর্থ সাক্ষী হিসেবে তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারিক প্যানেল। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন- অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মঞ্জুরুল বাছিদ এবং জেলা ও দায়রা জজ নূর মোহাম্মদ শাহরিয়ার কবীর। সাক্ষ্যগ্রহণে প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম ও বি এম সুলতান মাহমুদ সহযোগিতা করেন। পরে সাক্ষীকে জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। এ মামলায় পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য বুধবার (১০ সেপ্টেম্বর) দিন ধার্য করা হয়েছে।
এদিন বেলা ১১টার পর আবু সাঈদ হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) সাবেক ভিসি হাসিবুর রশীদসহ ৩০ জনের বিরুদ্ধে চতুর্থ দিনের মতো সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও প্রসিকিউটর মঈনুল করিম।
এর আগে সকালেও মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে থাকা ছয় আসামিকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। তারা হলেন- এএসআই আমির হোসেন, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলাম, কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায়, ছাত্রলীগ নেতা ইমরান চৌধুরী, রাফিউল হাসান রাসেল ও আনোয়ার পারভেজ। তবে বেরোবির ভিসিসহ এখনও ২৪ জন পলাতক রয়েছেন। তাদের পক্ষে সরকারি খরচে চারজন আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া গ্রেফতার আসামিপক্ষের আইনজীবীরাও রয়েছেন।
তরিকুলের বাড়ি গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলায়। ৩৫ বছর বয়সী এই পুলিশ পরিদর্শক বর্তমানে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ভাষানটেক থানায় কর্মরত রয়েছেন। তবে ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই রংপুর মেট্রোপলিটন কোতোয়ালি থানা এলাকা ও হাসপাতালে ইউডি (অপমৃত্যু) দায়িত্বে ছিলেন।
সাক্ষী তরিকুল বলেন, গত বছরের ১৬ জুলাই রংপুরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলছিল। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি মরদেহ রয়েছে বলে তাজহাট থানার বেতার বার্তার মাধ্যমে জানতে পারি। মরদেহটির সুরতহাল করতে হবে। ওই সময় কনস্টেবল লিটন দেবনাথসহ রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উপস্থিত হই। পুলিশের গুলিতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে একজন ছাত্র নিহত হয়েছেন বলে জেনেছি। তার নাম আবু সাঈদ। তখন মেডিকেল কলেজের ভেতরে অনেক উত্তেজনা বিরাজ করছিল। অনেক পুলিশ দায়িত্বরত ছিলেন।
তিনি বলেন, সন্ধ্যা ৭টার দিকে হাসপাতালে আসেন রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী কমিশনার আরিফুজ্জামান আরিফ। তিনি আমাকে বলেন— তুমি মরদেহ দেখেছো? জবাবে আমি বলি, না স্যার, আমি মরদেহ দেখিনি। এরপর তিনি বলেন, তুমি মরদেহ দেখে আসো। আমি মরদেহ দেখে এসে আরিফুজ্জামানকে বলি— মরদেহের শরীরে অসংখ্য ছররা গুলির আঘাত রয়েছে। মাথার পেছনে ক্ষত চিহ্ন। সেখান থেকে রক্ত বের হচ্ছে; যা স্ট্রেচারে রক্তমাখা অবস্থায় রয়েছে। এসব শুনে আরিফুজ্জামান স্যার আমাকে বলেন, সুরতহালে ছররা গুলির আঘাতের কথা লেখা যাবে না। এ কথায় একমত পোষণ না করলে তিনি আমাকে গালিগালাজ শুরু করেন। একপর্যায়ে বলেন, ব্যাটা তুই কথা শুনবি না? কথা না শুনলে তোকে জামায়াত-শিবির হিসেবে চালান করে দেব।
এসআই তরিকুল বলেন, ওই সময় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যায়। এসি আরিফুজ্জামান আমাকে বলেন, আমার ওপর চাপ আছে, তোকে এটা করতেই হবে। আমি তার কথায় রাজি হইনি। তার কথামতো সুরতহাল প্রস্তুত করলে পরবর্তী সময়ে আমার সমস্যা হতে পারে বলে জানিয়ে দেই। তিনি এ কথা শুনে আরও রেগে গিয়ে আমার মৃত বাবা-মা তুলে গালিগালাজ শুরু করেন। একই সঙ্গে বলেন, তোকে আওয়ামী লীগের লোক দিয়ে মেরে ফেলব। তখন আমি ভয় পেয়ে যাই।
এই সাক্ষী আরও বলেন, রাত সাড়ে ১০টার দিকে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে সঙ্গে নিয়ে আসেন এসি আরিফুজ্জামান স্যার। পুনরায় আমাকে সুরতহাল প্রস্তুত করতে চাপ দেন তিনি। আমি উপায় না দেখে রংপুর মেট্রোপলিটনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আহমেদ সাদাতের উপস্থিতিতে আবু সাঈদের সুরতহাল প্রতিবেদনে ছররা গুলির কথা বাদ দিয়ে দেই। একই সঙ্গে শরীরে অসংখ্য ছোট ছোট ক্ষত চিহ্ন ও মাথায় আঘাতের চিহ্ন লিখে সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে বাধ্য হই। পরবর্তী সময়ে সুরতহাল প্রতিবেদনে সই করেন ওই ম্যাজিস্ট্রেট। এ ছাড়া মৃত্যুর সঠিক কারণ জানতে আমি আবু সাঈদের মরদেহ রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠিয়ে দেই। মূলত ত্রুটিপূর্ণ সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করতে আমাকে বাধ্য করা হয়েছে।
এফএইচ/এমআইএইচএস