তের বছর আগে ঢাকার বক্ষব্যাধি হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ও আওয়ামী লীগপন্থি ‘স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদে’র (স্বাচিপ) নেতা ডা. নারায়ণ চন্দ্র দত্ত নিতাইকে হত্যার ঘটনায় পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এছাড়া চারজনকে আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দেওয়া হয়েছে।
রোববার (১৭ আগস্ট) ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১০ এর বিচারক রেজাউল করিম এ রায় দেন।
আদালতে রায় ঘোষণার পর আসামিরা বলেন, ‘আমরা নির্দোষ। আমরা কোনো অপরাধ করিনি। শেখ হাসিনা সরকার আমাদের এ হত্যা মামলায় জড়িয়েছে। ডিবি আমাদের পিটিয়ে টিপসই নিয়েছে।’
এদিন বেলা সাড়ে ১২ টার দিকে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের হাজতখানা থেকে দশ আসামিকে আদালতে উপস্থিত করেন পুলিশ। এরপর বিচারক রায় পড়া শুরু করেন। রায়ে সব আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ৫ জনের মৃত্যুদণ্ড, ৪ জনকে আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেন আদালত।
রায় শুনে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা দশ আসামি বিচারককে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আমরা কোনো অপরাধ করিনি। ঘটনার বিষয়ে কিছুই জানি না স্যার (বিচারক)। আমরা নির্দোষ। আমাদের অনেকের স্ত্রী সন্তান রয়েছে। একটু দয়া করবেন স্যার।’
পরে বিচারক বলেন, রায় ঘোষণা হয়ে গেছে। এখন আর কিছুই করার নেই।
এসময় দাঁড়িয়ে থাকা এক আসামি কান্না করতে করতে বলেন, ‘আল্লাহর ওপর বিচার ছেড়ে দিলাম। আমি নির্দোষ। এসময় সব আসামিদের কান্নাকাটি করতে দেখা গেছে।’
সাজা পরোয়ানা নিয়ে কারাগারে যাওয়া পথে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মাসুম মিন্টু ওরফে মিন্টু ওরফে বারগিরা মিন্টু বলেন, শেখ হাসিনা সরকার আমাদের এই হত্যা মামলায় জড়িয়েছেন। সাগর রুনির হত্যা মামলার সঙ্গে জড়িয়ে মিথ্যা মামলা দিয়েছে। আমার ভাইকে জিম্মি করে আমার কাছ থেকে টিপসই নিয়ে আমাকে ফাঁসিয়েছে। আমার বাসা লালবাগে, আর ঘটনা হয়েছে বনানীতে বক্ষব্যাধির কাছে। ডিবি আমাদের ধরে পিটায়া পিটায়া টিপসই নিয়েছে। আমরা এ মামলা সম্পর্কে কিছুই জানি না। আমরা নির্দোষ।
আসামি পক্ষের আইনজীবী আব্বাস উদ্দিন মাতুব্বর বলেন, এই মামলার ১০ আসামিই দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিলেও কেউ নিজে ছুরি মারার কথা স্বীকার করেনি। জবানবন্দি দুই ধরনের হয়। ইন কালপেটরি, অর্থাৎ নিজেকে জড়িয়ে। অন্যটা হলো, এক্স কালপেটরি অর্থাৎ অন্যকে জড়িয়ে। আসামিদের জবানবন্দিগুলো কোনটা কোনটার সঙ্গে কো-অপারেট করেনি। মাসুম বলছে, বকুল ছুরি মারছে। বকুল বলছে মাসুম ছুরি মারছে। এই মামলায় পাঁচ জনকে মৃত্যুদণ্ড, চার জনকে আমৃত্যু কারাদণ্ড ও একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। আমরা মনে করি, এ রায়টা যথাযথ ও সঠিক হয়নি। আমরা উচ্চ আদালতে আপিল করবো। আশাকরি সেখানে ন্যায়বিচার পাবো।
আরও পড়ুন:
রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, আসামিরা ডা. নিতাইয়ের বাসায় চুরি করতে গিয়ে তাকে হত্যা করে। পরবর্তীতে চুরি যাওয়া জিনিসপত্র উদ্ধার করা হয়। এই মামলায় সব আসামিরই সাজা হয়েছে। প্রত্যেকেই তাদের ভূমিকার কথা স্বীকার করেছে। দীর্ঘদিন বিচারের পর এই মামলার রায় হয়েছে। আমরা রায়ে সন্তুষ্ট। আমরা ন্যায় বিচার পেয়েছি।
তিনি আরও বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন সময়ে দেশের সমস্ত হাসপাতালে কর্মবিরতি পালিত হয়েছে। তৎকালীন সরকার এ ঘটনায় ন্যায় বিচারের আশা দিয়েছিল। বর্তমান সরকার আশার পর আমরা দায়িত্বের সঙ্গে এ মামলার নিষ্পত্তির ব্যাপারে কাজ করেছি। আদালত পর্যবেক্ষণে বলেছেন, এটা অত্যন্ত ঘৃণ্য কাজ। যাদের সেবায় মানুষ সুস্থ হয়, আমরা বেঁচে থাকি। তাদেরই হত্যা করা হয়েছে।
মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্তরা হলেন- নিতাইয়ের গাড়িচালক কামরুল হাসান অরুন, মাসুম মিন্টু, সাইদ ব্যাপারী, বকুল মিয়া এবং সাইদ মিজি। মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড করা হয়েছে।
আমৃত্যু দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন, আবুল কালাম, সাইদুল, ফয়সাল এবং পেদা মাসুম। যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হলেন রফিকুল ইসলাম। পাশাপাশি প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড করা হয়েছে।
এছাড়া রফিকুল ইসলাম নামে আরেক আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় ঘোষণা করেন আদালত। দণ্ডের পাশাপাশি প্রত্যেকের দশ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে।
এদিকে রায়ে রাতে ঘরে অনুপ্রবেশের দায়ে প্রত্যেককে ১৪ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড, পাঁচ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড, অনাদায়ে এক মাস করে সশ্রম কারাভোগ করতে হবে। মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে চুরির দায়ে প্রত্যেককে ১০ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড, পাঁচ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড, অনাদায়ে এক মাস করে সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
এমআইএন/এনএইচআর/এমএস