আমাদের দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতা আছে কি?
বাংলাদেশে ভূমিকম্পের সংবাদে আতংকিত বোধ করেছি। দুই শিশুসহ পাঁচজনের মৃত্যৃ হয়েছে, আহত দুই শতাধিক। ঝড় তুফানের পূর্বাভাস পাওয়া যায়। সেজন্য জানমাল রক্ষার প্রস্তুতি নেয়া যায়। কিন্তু ভূমিকম্প কোথায় কখন হবে সেটা কেউ বলতে পারে না। অবশ্য ভূপৃষ্ঠের কম্পন পর্যালোচনা করে ভূমিকম্প হওয়ার সময় সতর্কবার্তা পাঠিয়ে থাকে গুগলের আর্থকোয়েক অ্যালার্ট সিস্টেমসহ বেশ কয়েকটি অ্যাপ। তবে ভূমিকম্প হবে কিনা তা কয়েক ঘন্টা আগে জানার কোন প্রযুক্তি এখনও বিশ্বে নেই। ভূমিকম্প হওয়ার পর দুর্গতদের উদ্ধার করা সব দেশেই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সেজন্য দরকার উদ্ধার কাজের সক্ষমতা অর্জন। রবীন্দ্রনাথের শেষে কবিতা উপন্যাসের নায়ক অমিত রায় বলেছিলেন, ‘সম্ভবপরের জন্যে সব সময়ে প্রস্তুত থাকাই সভ্যতা; বর্বরতা পৃথিবীতে সকল বিষয়েই অপ্রস্তুত।’ আমাদেরও প্রস্তুত থাকা উচিত। বাংলাদেশে শক্তিশালী ভূমিকম্পের আশংকা রয়েছে এমনটি অনেক বছর ধরেই বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। আফটার শকের আশংকাও রয়েছে। অতীতে নাটোরে ও ঢাকায় প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পের ইতিহাস পড়েছি। নরসিংদীর কাছেও সোনাগড়া সভ্যতার সময়ে প্রবল ভূমিকম্পে নদীর খাত পরিবর্তনের সুপ্রাচীন ইতিহাস জানিয়েছেন প্রত্নতত্ত্ববিদর
বাংলাদেশে ভূমিকম্পের সংবাদে আতংকিত বোধ করেছি। দুই শিশুসহ পাঁচজনের মৃত্যৃ হয়েছে, আহত দুই শতাধিক। ঝড় তুফানের পূর্বাভাস পাওয়া যায়। সেজন্য জানমাল রক্ষার প্রস্তুতি নেয়া যায়। কিন্তু ভূমিকম্প কোথায় কখন হবে সেটা কেউ বলতে পারে না। অবশ্য ভূপৃষ্ঠের কম্পন পর্যালোচনা করে ভূমিকম্প হওয়ার সময় সতর্কবার্তা পাঠিয়ে থাকে গুগলের আর্থকোয়েক অ্যালার্ট সিস্টেমসহ বেশ কয়েকটি অ্যাপ। তবে ভূমিকম্প হবে কিনা তা কয়েক ঘন্টা আগে জানার কোন প্রযুক্তি এখনও বিশ্বে নেই। ভূমিকম্প হওয়ার পর দুর্গতদের উদ্ধার করা সব দেশেই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সেজন্য দরকার উদ্ধার কাজের সক্ষমতা অর্জন।
রবীন্দ্রনাথের শেষে কবিতা উপন্যাসের নায়ক অমিত রায় বলেছিলেন, ‘সম্ভবপরের জন্যে সব সময়ে প্রস্তুত থাকাই সভ্যতা; বর্বরতা পৃথিবীতে সকল বিষয়েই অপ্রস্তুত।’ আমাদেরও প্রস্তুত থাকা উচিত। বাংলাদেশে শক্তিশালী ভূমিকম্পের আশংকা রয়েছে এমনটি অনেক বছর ধরেই বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। আফটার শকের আশংকাও রয়েছে। অতীতে নাটোরে ও ঢাকায় প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পের ইতিহাস পড়েছি। নরসিংদীর কাছেও সোনাগড়া সভ্যতার সময়ে প্রবল ভূমিকম্পে নদীর খাত পরিবর্তনের সুপ্রাচীন ইতিহাস জানিয়েছেন প্রত্নতত্ত্ববিদরা।
বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার মধ্যে কোথায় প্রবল ভূমিকম্প হতে পারে সেই তালিকাও দিয়েছেন। কিন্তু সেই সাবধানবাণী শুনে আমরা কতটা সচেতন হয়েছি? ঢাকার মতো একটি জনবহুল শহরে শক্তিশালী ভূমিকম্প হলে কী পরিস্থিতি হবে ভাবা যায়? বিশেষ করে পুরান ঢাকায় যেখানে একটি বাড়ির কাঁধে ভর দিয়ে আরেকটি বাড়ি দাঁড়ানো। সরু সরু গলিপথ। এর মধ্যেই এক কাঠা, দেড় কাঠা, এমনকি আধা কাঠা জায়গার উপরেও বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে। রাজউকের অনুমতি হলো ছয়তলা পর্যন্ত। কিন্তু কেই বা সেকথা মানে? নিজের ইচ্ছামতো আরও কয়েক তলা তো গড়ে নেয়াই যায়, তাই না?
ভবন বানানোর নিয়মের মধ্যে রয়েছে, সেগুলো শকপ্রুফ ও ভূমিকম্পপ্রুফ করে বানাতে হবে। কিন্তু সিমেন্ট, বালির পরিমাপে হামেশাই হেরফের করা আমরা, নিম্নমানের আয়রন রড ব্যবহার করা আমরা, যথাযথ নিয়ম মেনে ভিত্তি না দেয়া আমরা কোন নিয়ম কানুনেরই পরোয়া করি না।
পুরান ঢাকার বেশিরভাগ জায়গাতেই কোনো বড় দুর্ঘটনা ঘটলে অ্যাম্বুলেন্স পর্যন্ত প্রবেশ করতে পারবে না। ফায়ার ব্রিগেডের বড় গাড়ি তো যেতেই পারবে না। পুরো পুরান ঢাকাই যেন এক মৃত্যু ফাঁদ।
কেমন করে ডিম ভাজতে হয় সেই প্রশিক্ষণ নিতে বিদেশে লোক পাঠানোর হুড়োহুড়ি। বিদেশ থেকে চুরির কলাকৌশল শিখতে প্রায়ই আমলাদের একেকটি টিম দেশের টাকা খরচ করে বিদেশে যায়। অথচ ফায়ার ব্রিগেডকে প্রশিক্ষিত করা, বিদেশ থেকে উন্নত প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি করার দিকে কারও খেয়াল নেই।
শুধু পুরান ঢাকা নয়। নতুন ঢাকাতেও দুটি বহুতল ভবনের মাঝখানে যতটুকু ফাঁকা জায়গা রাখার নিয়ম ততটুকু জায়গা অনেক সময়ই রাখা হয় না। আমরা তো নিয়মভাঙা জাতি। এরমধ্যে আমাদের বাড়িতে বাড়িতে সিলিন্ডার গ্যাস। ভূমিকম্পে হোক বা অন্য যে কোনভাবে হোক, সংশ্লিষ্ট ঝুঁকি হিসেবে থাকে অগ্নিকাণ্ডের আশংকা। ধসে পড়া ভবনে যেমন আগুন লাগতে পারে, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হতে পারে, শর্ট সার্কিটও হতে পারে। যে কোনো কিছু থেকেই ঘটতে পারে মহাবিপদ। ধসে পড়া ভবনে আটকে পড়া মানুষ উদ্ধারের জন্য বিশেষ ধরনের প্রযুক্তি দরকার। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার সময়ই বোঝা গেছে আমাদের দৌড় কতদূর। বেইলি রোডের আগুনের সময়, পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টা আর নিমতলির দুর্ঘটনার সময়ও বোঝা গেছে আমাদের কাছে মানুষের জীবনের মূল্য কতটুকু।
ঢাকায় অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে বহুতল ভবনগুলোতে ফায়ার ব্রিগেডের মহড়াও হওয়া দরকার নিয়মিত। অথচ বেশিরভাগ ভবনেই ইহজন্মেও মহড়া হয়নি। বেশিরভাগ ভবনের মধ্যে ইমার্জেন্সি এক্সিট ব্যবস্থা অতি দুর্বল। অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রগুলো বেশিরভাগই মেয়াদ উত্তীর্ণ।
ভূমিকম্পের সময় কী করণীয় সেগুলো নিয়েও মহড়া হওয়া দরকার দেশজুড়ে। কিন্তু আমরা এসব বিষয়ে ভয়াবহ মাত্রায় উদাসীন। আমাদের টনক ধরে বড় দুর্ঘটনা ঘটার পর, অসংখ্য প্রাণহানির পর। উদ্ধার কাজে ফায়ার ব্রিগেড, বিজিবি ও সেনাবাহিনীসব সময় অংশ গ্রহণ করে (বিপদের মাত্রা বুঝে)। প্রশ্ন হলো আমাদের ফায়ার ব্রিগেড ও অন্যান্য বাহিনীর হাতে কতখানি উন্নত প্রযুক্তি রয়েছে?
বিদেশ থেকে সামরিক বিমান কেনার আগে আমাদের কী দুর্যোগ মোকাবিলায় নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত নয়? আমাদের বিদেশ থেকে এমন সব প্রযুক্তি, যন্ত্র ও কৌশল আনতে হবে যেগুলো মানুষের জীবন বাঁচাতে কাজে লাগে। সেইসঙ্গে দরকার প্রশিক্ষিত জনবল। কেমন করে ডিম ভাজতে হয় সেই প্রশিক্ষণ নিতে বিদেশে লোক পাঠানোর হুড়োহুড়ি। বিদেশ থেকে চুরির কলাকৌশল শিখতে প্রায়ই আমলাদের একেকটি টিম দেশের টাকা খরচ করে বিদেশে যায়। অথচ ফায়ার ব্রিগেডকে প্রশিক্ষিত করা, বিদেশ থেকে উন্নত প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি করার দিকে কারও খেয়াল নেই। জরুরি অবস্থায় চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য ডাক্তার ও নার্স এবং প্যারামেডিকদেরও উন্নত প্রশিক্ষণ দরকার।
আমাদের অনেক বেশি প্যারামেডিক জনশক্তি প্রয়োজন। দরকার প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার জ্ঞান। স্কুল পর্যায় থেকেই হাতে কলমে প্রত্যেককে প্রাথমিক চিকিৎসার জ্ঞান দেয়াটা অতি জরুরি।
ভূমিকম্পসহ যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের সমন্বিত এবং ব্যাপক পরিকল্পনা ও কর্সূচি থাকা দরকার। কিন্তু কে আর এসব নিয়ে মাথা ঘামায়? বরং ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়ে বসে থাকাটাই আমাদের মতো দেশের মানুষের চিরাচরিত অভ্যাস।
লেখক: কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট। চীনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন।
এইচআর/এমএস
What's Your Reaction?