পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, 'তিনিই স্বীয় রহমতে তোমাদের জন্য রাত ও দিন সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা রাতে বিশ্রাম গ্রহণ করো ও তার অনুগ্রহ অন্বেষণ করো এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। ' (সুরা কাসাস, আয়াত : ৭৩)। এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ স্পষ্ট করে দিয়েছেন উপার্জনের জন্য হলো দিন, আর আরাম করার জন্য হলো রাত।
অথচ এখন আমাদের দেশে অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে এক শ্রেণির মানুষ রাতকে ভাঙচুর, আন্দোলন, সংগ্রাম, হামলা, মামলা চালানোর সময় হিসেবে বেছে নিয়েছেন। রাতে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই হয়ে থাকে নিয়মিত। এখন এগুলোর পাশাপাশি শুরু হয়েছে হামলা, মামলা ও অপারেশন সার্চলাইট টাইপের ব্যাপার। এইসব ঘটনা প্রবাহের নিউজ আপডেট পাওয়ার জন্য আমাদের মতো কিছু বোকা মানুষ ঘুম বাদ দিয়ে কিছুক্ষণ পর পর টিভি বা টেলিফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখছি। এছাড়াও আমাদের আরো আছে ফেইসবুক, নেটফ্লিক্স, প্রাইম, ম্যাসেঞ্জার, ইনস্টাগ্রাম, রিলসহ আরো কত কী, যা রাতের ঘুমকে হারাম করার জন্য যথেষ্ট।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ ঘুমকে তার অনুগ্রহ হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং রাসুলুল্লাহ (সা.) দ্রুত সময়ে রাতে ঘুমিয়ে পড়তে বলেছেন। আল্লাহ বলেছেন, ‘আর আমি তোমাদের নিদ্রাকে করেছি ক্লান্তি দূরকারী। রাত্রিকে করেছি আবরণ।’ (সুরা : নাবা, আয়াত : ৯-১০)
শুধু ধর্মগ্রন্থে নয়, স্বাস্থ্যবিজ্ঞানও বলে সাধারণত আমাদের শরীরে ঘুম ও জেগে থাকার একটি নির্দিষ্ট নিয়ম আছে, যাকে বলে ‘বায়োলজিক্যাল ক্লক’ বা দেহঘড়ি। এই দেহঘড়ি অনুযায়ী প্রতিদিন নির্দিষ্ট একটা সময় রাখতে হয় ঘুম বা বিশ্রামের জন্য। অথচ আমাদের শহর, আমাদের কর্মক্ষেত্র, পরিবার, জীবন-যাপন ব্যবস্থা কোনোটাই ঘুমের পক্ষে নয়। ’প্রয়োজনের চাইতে কম ঘুম’ শহুরে মানুষের জন্য বড় সমস্যা এবং দিনে দিনে তা বাড়ছে। আর তাই শহরের মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত মানুষের আলোচনার একটি অবশ্য বিষয় ’কম ঘুম’। রাতে ঘুমটা ঠিক হয়নি, কারো ঘুমানোর সময় নেই, কারো বাচ্চা রাত জাগে, কেউ রাতে ফেসবুকিং করেন অথবা রাত জেগে টিভি দেখেন। ডাক্তারি পরিভাষায় একধরনের ’ইনসমনিয়া’য় আক্রান্ত আমরা। রাতজাগার অসংখ্য উপায় থাকলেও, সকালে দেরিতে ওঠার কোন উপায় নেই। স্কুল-কলেজ, অফিস থাকে বলে যতটা সময় ঘুমানো দরকার, ঘুমানোর জন্য সেই সময়টা আমরা পাচ্ছি না।
ঘুমের সমস্যা দিন দিন প্রকট হচ্ছে। এই সমস্যার বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বিপজ্জনক মাত্রায় কম। মানুষ ওষুধনির্ভর হয়ে পড়ছে।’ যা অত্যন্ত বিপজ্জনক। ঘুম কম হলে সবচেয়ে বিপজ্জনক ক্ষতি হচ্ছে, স্বার্থপরতা বৃদ্ধি। কম ঘুমালে মানুষ স্বার্থপর হয়ে উঠতে পারে, ঘুম নিয়ে সাম্প্রতিক তিনটি গবেষণা এ কথাই বলছে।
এখন প্রায় সবাইকে নানাধরনের ঝামেলা ম্যানেজ করে চলতে হয়। আর এই ম্যানেজ করতে গিয়ে সবচেয়ে বড় চাপ পড়ে ঘুমের উপর। কথায় আছে “শরীরের নাম মহাশয়, যাহা সয়াবে, তাহাই সয়”আমরা বলি ঠিকই, কিন্তু শরীর ও মন কোনোটাই অতিরিক্ত চাপ সহ্য করতে পারে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, যে কারণেই হোক রাতে ঘুম ভালো না হলে পরের দিনটি হয় বিশৃঙ্খল। রাতে ঘুম না হলে মানুষ কাজের মধ্যে, স্কুলে অথবা গাড়ি চালানোর সময় ঘুমিয়ে পড়তে পারেন। ঘুম না হলে মানুষ ক্লান্তবোধ করেন, মনোযোগ ও সতর্কতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘুম না হলে অনেক সময় মানুষের স্মৃতি নষ্ট হয়। ঘুম না হওয়া মানুষ খিটখিটে মেজাজের হয়, কেউ কেউ হতাশায় ভোগেন। ঘুমের সমস্যায় থাকা মানুষের দুর্ঘটনায় পড়া বা আহত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। বাংলাদেশে যে ক্রমাগত দূরপাল্লার পরিবহন দুর্ঘটনা কবলিত হয়, এর বড় কারণ চালকের ঘুম ও বিশ্রাম কোনোটাই যথেষ্ট হয় না।
আধুনিক শহুরে জীবন মানে নানাধরনের প্রতিযোগিতা, চাপ ও তাপ মোকাবেলা করা। এই জীবনে আমরা যতো বেশি কাজ করতে পারছি, বোঝা নিতে পারছি, দায়িত্ব নিতে পারছি, ততোই নিজেদের সফল বলে মনে করছি। একটা সময় এসে এই বাড়তি কাজের ধাক্কা লাগে শরীরে ও মনে। চারিদিকে অনিশ্চয়তা, গোলযোগ, কোলাহল যতো বাড়ে আমাদের মনের উপর ঝড় ততো তীব্র হয়। একজন কর্মজীবী নারীকে সব দায়দায়িত্ব সারার পরেও, রাতে একরাশ চিন্তা নিয়ে ঘুমাতে যেতে হয়।
শহুরে জীবনে একজন কর্মজীবী পুরুষও অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেন। অফিসে কাজের দায়িত্ব, বহুমুখী কৈফিয়ত, বাসার খরচের চিন্তা, বাচ্চার পড়াশোনা ও চাকরি টিকিয়ে রাখার উদ্যোগ। শুধু যদি বাসা ও অফিসের চিন্তা থাকতো, তাহলেও অনেকটা সহজ হতো জীবন। অফিস, সংসার, হাসপাতাল, রোগী, অতিথি, অনুষ্ঠানসহ নানাধরণের চিন্তা চলতেই থাকে মানুষের মনোজগতে। আমাদের সকলের জীবনে মাল্টিটাস্কিং এর প্রভাবে বিশ্রাম, ঘুম, শান্তি সব উবে যাচ্ছে। এর উপর যোগ হয়েছে অস্বাভাবিক যানজট, সারাদিনের হল্লা, অবরোধ, হামলা-মামলা।
ঘুম কম হওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে বলে ২০২৪ এ স্টোরি করেছিল প্রথম আলো। একটি আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একজন নারী গবেষক ফেসবুকে বন্ধুদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, আগের রাতে বন্ধুদের ঘুম কেমন ছিল। উত্তর দিয়েছিলেন ৫৩ জন। তাঁদের মধ্যে ২৬ জন অর্থাৎ ৪৯ শতাংশ বলেছিলেন, ঘুমে সমস্যা ছিল। একই দিনে ওই নারী গবেষক তাঁর অফিসের ১১ জন সহকর্মীর কাছে ঘুমের বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন। উত্তরে ৯ জন বলেছিলেন, আগের রাতে ভালো ঘুম হয়নি। আগের রাতে নিজের ঘুম ঠিকভাবে না হওয়ার কারণ অনুসন্ধানে গবেষক এ অনুসন্ধান চালিয়েছিলেন।
ঘুমের সঙ্গে মানুষের মন ও স্বাস্থ্যের সম্পর্ক আছে। ঘুম কম হওয়ার সঙ্গে হৃদ্রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও ক্যানসার বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি আছে। ঝুঁকি কমাতে চিকিৎসকেরা মানুষকে পর্যাপ্ত ঘুমের পরামর্শ দেন। ভারতের প্রসিদ্ধ নিওরো সার্জন ডা: শাকির হোসাইন সবসময় বলেন নিজেকে সময় দেও, নিজের কথা ভাবো, খানিকটা স্বার্থপর হও। নিজে ভালো না থাকলে তুমি আরো পাঁচজনকে ভালো রাখতে পারবে না। যতোই কাজের চাপ থাকুক না কেন নিয়মিত ঘুমানো, ব্যায়াম ও ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করা প্রয়োজন। একসাথে অনেক কাজের দায়িত্ব নিয়ে কাজে নামার চেষ্টা করোনা। তাহলেই মন, মগজ ও শরীর তিনটিই বিগড়ে যাবে।
নিজেরাও বুঝতে পারছি অতিরিক্ত কাজের চাপ এবং মাল্টিটাস্কিং আমাদের মধ্যে ডিপ্রেশন, দুশ্চিন্তা, ক্রনিক পেইন বাড়িয়ে দিচ্ছে। সেইসাথে বাড়ছে ইনফারটিলিটি। এইসব কারণে মানুষের কাজেকর্মে পারফরমেন্স নষ্ট হয়, ব্রেইনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অথচ অনেকটা বাধ্য হয়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিশ্রামবিহীন ক্লান্ত জীবন-যাপন করতে হচ্ছে আমাদের।
যেসব কারণকে চিকিৎসকরা ঘুমের শত্রু বলে চিহ্নিত, সেগুলো সবই আমাদের চারপাশে ঘুরঘুর করছে। এর মধ্যে আছে শিশু, পোষা প্রাণী, শব্দ, আলো, তাপ, শয্যার ধরন, ব্যথা, শয্যাসঙ্গী, কাজের ধরন, অভ্যাস, মাদক, ওষুধ, টেলিভিশন, রেডিও, কম্পিউটার, মুঠোফোন ও আরও অনেক কিছু। সাথে যোগ হয়েছে ঢাকা শহরে রাস্তার কোলাহল, উচ্চ হর্ন, রাতভর যানবাহন চলাচলের শব্দ, ভবন বা রাস্তা নির্মাণের শব্দ মানুষের জীবনকে নির্ঘুম করে তুলেছে।
অক্সফোর্ড থেকে প্রকাশিত ‘আ ভেরি শর্ট ইন্ট্রোডাকশন’ বইটিতে বলা হয়েছে ঘুমানোর ঘরে টেলিভিশন ও কম্পিউটার রাখা যাবে না, ঘুমানোর আগে তর্কবিতর্ক বা কঠোর শরীরচর্চা করা যাবে না, শেষ বিকেলে বা সন্ধ্যায় ক্যাফেইন জাতীয় খাবার খাওয়া যাবে না, খুব ক্ষুধা নিয়ে বা ভরা পেটে ঘুমাতে যাওয়া যাবে না, অন্যের ব্যবস্থাপত্রে দেওয়া ঘুমের ওষুধ খাওয়া যাবে না, নিজ উদ্যোগে ঘুমের ওষুধ কেনা যাবে না, ঘুমের জন্য উদ্বিগ্ন হওয়া চলবে না। এই জাতীয় অনেক নিয়মের কথা বলা হয়েছে, যার ১০ শতাংশও আমরা মানে শহুরে মানুষ মেনে চলতে পারছি না, এই জীবন ব্যবস্থায়।
যদিও মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, কাজ ও কাজের চাপ থাকবেই, কিন্তু একে ম্যানেজ করে চলাটাই আসল। ঘুম যে ঠিকমতো হচ্ছে না, এটা বোঝার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে এটা দেখা যে, রাতে ঘুম হওয়ার পরও সকালে কাজের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ শক্তি পাচ্ছেন না। আগে যে কাজ অনায়াসে করতে পারতেন, সেই কাজ করতে অনেক বেশি ক্লান্তিকর লাগছে। ঘুমের অভাবে কমে যেতে পারে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাও। ক্লান্তির কারণে কাজে যেমন মনোযোগ কমে যায়, তেমনি সারাদিন মেজাজ খিটখিটে থাকে।
’অ্যাসোসিয়েশন অব সার্জনস ফর স্লিপ অ্যাপনিয়া বাংলাদেশ’ বলেছে, ‘ঘুমের সমস্যা দিন দিন প্রকট হচ্ছে। এই সমস্যার বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বিপজ্জনক মাত্রায় কম। মানুষ ওষুধনির্ভর হয়ে পড়ছে।’ যা অত্যন্ত বিপজ্জনক। ঘুম কম হলে সবচেয়ে বিপজ্জনক ক্ষতি হচ্ছে, স্বার্থপরতা বৃদ্ধি। কম ঘুমালে মানুষ স্বার্থপর হয়ে উঠতে পারে, ঘুম নিয়ে সাম্প্রতিক তিনটি গবেষণা এ কথাই বলছে। ঘুমের সঙ্গে স্বার্থপরতার সম্পর্ক নিয়ে গবেষণাগুলো প্রকাশিত হয়েছে ক্যালিফোর্নিয়ার ‘পিএলওএস বায়োলজি জার্নালে। ঘুমের ঘাটতি মানুষের মনকে নেতিবাচকভাবে বদলাতে সরাসরি প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশের মানুষের উপর কম ঘুমের এই প্রভাবতো সরাসরিই দেখতে পারছি এবং বুঝতে পারছি আমরা চরমভাবে স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছি।
১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
লেখক : যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক।
এইচআর/এএসএম