আমার দেখা কোরবানি দেশে-বিদেশে

3 months ago 51

পৃথিবীজুড়ে যত মানুষ আছে, সবাই কোনো না কোনো ধর্মে বিশ্বাসী। হযরত আদম (আ.) থেকে হযরত নুহ (আ.) পর্যন্ত যত ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোর সত্যতা যাচাই করতে সময় ফুরিয়ে যাবে, তবুও সঠিক তথ্য জানা যাবে না। ইতিহাসবিদদের মতে, নবী হযরত নুহ (আ.)-এর সময়ে সংঘটিত মহাপ্লাবনের পর তার তিন পুত্র হাম, শাম, ইয়াফেসের মাধ্যমে পৃথিবীতে মানব সভ্যতার পুনর্জাগরণ ঘটে। সেই মহাপ্লাবনের পর শামের নামে গড়ে ওঠে শামদেশ ও সেমেটিক সভ্যতা।

ইব্রাহিম (আ.) থেকে শুরু করে ইসমাইল (আ.) এবং ইসহাক (আ.) পর্যন্ত ঘটনার তথ্য জানা যায়। ইহুদি, খ্রিষ্টান ও মুসলিম এই তিন ধর্মের মানুষের কাছেই ফিলিস্তিন আবেগের জায়গা। ইব্রাহিমীয় তিন ধর্মেই জেরুজালেম নগরীর সমান আবেদন। এই মাটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রাচীন এই তিন ধর্মের বিশ্বাস, সংস্কৃতি ও ইতিহাস।

ইব্রাহিম (আ.) এবং তার বংশ
নবী ইব্রাহিম (আ.) ইরাক থেকে হিজরত করে জেরুজালেমে আসেন। এখানেই জন্মগ্রহণ করেন তার দুই পুত্র ইসমাইল (আ.) ও ইসহাক (আ.)। ইসমাইল মক্কায় হিজরত করেন এবং তার বংশ থেকে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেন। অন্যদিকে ফিলিস্তিনে ইসহাক (আ.)-এর বংশে আরও অনেক নবীর জন্ম হয়, যেমন মুসা, হারুন, দাউদ, সোলায়মান এবং সর্বশেষ ইসা (আ.)। বংশ পরম্পরায় এসব নবীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইব্রাহিম (আ.) থেকে উৎসারিত তিন ধর্মের বিশ্বাস ও ইতিহাস।

কোরবানি এবং আত্মত্যাগ
ইব্রাহিম (আ.) থেকে কথিত স্যাক্রিফাইস শব্দটি শুরু হয়। আমরা মুসলমানরা হজ ও কোরবানি পালন করে আসছি, কিন্তু প্রকৃত স্যাক্রিফাইস বা ত্যাগের অর্থ এখনও অনেকেই পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারিনি। স্যাক্রিফাইস মানে উৎসর্গ হলেও আমি ছাড় দেওয়া শব্দটি ব্যবহার করেছি আলোচনায় সুবিধার জন্য।

কোরবানির অভিজ্ঞতা দেশে-বিদেশে

সৌদি আরব
মক্কা-মদিনার পবিত্র ভূমি সৌদি আরবে ঈদুল আজহা উদযাপন এক কথায় অনন্য অভিজ্ঞতা। লাখ লাখ মুসল্লির উপস্থিতি এবং হজ পালন প্রধান আকর্ষণ। ফজরের নামাজের পর মিনা, মুজদালিফা, ও আরাফাতের ময়দানে কোরবানি শুরু হয়। পরিবারের সাথে একত্রিত হয়ে নামাজ আদায়, সুস্বাদু খাবারের আয়োজন, এবং কোরবানির মাংস বিতরণ দিনটিকে বিশেষ করে তোলে।

তুরস্ক
তুরস্কে কোরবানির পশু কেনার জন্য বড় বড় বাজারে মানুষের ভিড় লক্ষ্য করা যায়। পূর্ব তুরস্ক থেকে কোরবানির পশু আনা হয়। তুর্কি পরিবারগুলো নিজেদের ঘরে বা নির্দিষ্ট স্থানে কোরবানি করে। তুর্কি মিষ্টান্ন, বিশেষ করে বাকলাভা, এবং ঈদের বিশেষ খাবার তৈরি করা হয়। শিশুদের মধ্যে উপহার বিতরণ এবং পরিবার ও বন্ধুদের সাথে সময় কাটানোর প্রচলন রয়েছে।

মিশর
মিশরে রাস্তায় রাস্তায় পশু কোরবানি করা হয়। সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে নির্দিষ্ট কোরবানির স্থান নির্ধারণ করা হয়। ভোরে মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করার পর কোরবানির কাজ শুরু হয়। জনপ্রিয় খাবার কুসারি, কাবাব ও ফালাফেল দিয়ে বিশেষ ভোজ আয়োজন করা হয়। সামাজিক সম্প্রদায়ের মধ্যে মাংস বিতরণ ও দান করার প্রচলন রয়েছে।

ইন্দোনেশিয়া
ইন্দোনেশিয়ায় কোরবানি আমাদের দেশের মতোই উদযাপিত হয়। পরিবারের সাথে একত্রিত হয়ে নামাজ আদায়, পশু কোরবানি, এবং মাংস বিতরণ করা হয়। গ্রামাঞ্চলে সময়টি খুবই প্রাণবন্ত থাকে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে কোরবানির পশু কেনা ও বিতরণের ব্যবস্থা থাকে। ঐতিহ্যবাহী খাবার সাতে (শশলিক) ও রেন্ডাং বিশেষভাবে প্রস্তুত করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডা
কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রে ঈদুল আজহা উদযাপন ভিন্নধর্মী। মুসলিম কমিউনিটি মসজিদ বা ইসলামিক সেন্টারে একত্রিত হয় ঈদের নামাজ আদায়ের জন্য। কোরবানি করার জন্য নির্দিষ্ট কোরবানির স্থানে যাওয়া হয়। কোরবানির মাংস সংরক্ষণ ও বিতরণের জন্য বিভিন্ন সংগঠন ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান কাজ করে। পরিবার ও বন্ধুদের সাথে বারবিকিউ পার্টি আয়োজন এবং শিশুদের উপহার দেওয়া হয়।

যুক্তরাজ্য
যুক্তরাজ্যে মুসলিম সম্প্রদায়ের ঐক্যবদ্ধতা লক্ষণীয়। বিভিন্ন শহরের মসজিদগুলোতে ঈদের নামাজ আদায় করা হয়। কোরবানির পশু কেনা ও কোরবানি করার জন্য নির্দিষ্ট পশু খামার এবং কসাইখানা রয়েছে। কোরবানির মাংস দরিদ্র ও অসহায় মানুষের মাঝে বিতরণ করা হয়। পরিবার ও বন্ধুদের সাথে বিশেষ খাবারের আয়োজন করা হয়।

ফ্রান্স
ফ্রান্সে মুসলিম সম্প্রদায় উদ্দীপনার সাথে ঈদুল আজহা উদযাপন করে। প্যারিস, মার্সেই, এবং লিয়োঁসহ বড় বড় শহরে মসজিদে ঈদের নামাজ আদায় করা হয়। সরকার অনুমোদিত পশু জবাই কেন্দ্র রয়েছে। মুসলিম পরিবারগুলো কোরবানির মাংস নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয় এবং দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করে।

জার্মানি
জার্মানিতে মুসলিম কমিউনিটির সদস্যরা একত্রিত হয়। বার্লিন, ফ্রাঙ্কফুর্ট, এবং হামবুর্গসহ শহরের মসজিদগুলোতে ঈদের নামাজ আদায় করা হয়। কোরবানির পশু কেনার জন্য বিশেষ খামার এবং হালাল মাংসের দোকান রয়েছে। মুসলিম পরিবারগুলো কোরবানির মাংস নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয় এবং কিছু অংশ দান করে।

নেদারল্যান্ডস
নেদারল্যান্ডসে উৎসবমুখর পরিবেশে ঈদুল আজহা উদযাপন হয়। আমস্টারডাম, রটারডাম, এবং হেগের মসজিদগুলোতে ঈদের নামাজের আয়োজন করা হয়। কোরবানির জন্য নির্দিষ্ট স্থান এবং পশু খামার রয়েছে। কোরবানির মাংস পরিবার এবং দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করা হয়। ডাচ এবং মুসলিম খাবারের সংমিশ্রণে বিশেষ ভোজের আয়োজন করা হয়।

সুইডেন এবং অন্যান্য নর্ডিক দেশগুলো
নর্ডিক দেশগুলোসহ সুইডেনে ঈদুল আজহা উদযাপন পারিবারিক ও সামাজিক মিলনের সুযোগ এনে দেয়। নর্ডিক দেশগুলোর বড় বড় শহরগুলোতে মসজিদ রয়েছে এবং সেখানে ঈদের নামাজ আদায় করা হয়। সুইডেনে স্টকহোম, গোথেনবার্গ, এবং মালমোর মসজিদগুলোতে ঈদের নামাজ আদায় করা হয়। কোরবানির পশু কেনা ও কোরবানি করার জন্য নির্দিষ্ট পশু খামার রয়েছে। মুসলিম পরিবারগুলো কোরবানির মাংস নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়।

ইদুল আজহা উদযাপনের কারণ
ইদুল আজহা, মুসলিম বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব, পালন করা হয় আল্লাহর প্রতি মহানবী ইব্রাহিম (আ.) এর অগাধ বিশ্বাস এবং ত্যাগের স্মরণে। কোরান অনুযায়ী, ইব্রাহিম (আ.) স্বপ্নে আল্লাহর আদেশে তাঁর প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ.) কে কোরবানি করতে প্রস্তুত হন। আল্লাহ তাঁর ত্যাগের পরীক্ষা নিয়ে ইসমাইলের বদলে একটি পশু কোরবানি করতে বলেন। এই ঘটনার স্মরণে মুসলিমরা কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি তাদের সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ এবং ত্যাগের প্রতীকী প্রকাশ করে।

ইদুল আজহা কেবল এক দিনের জন্য নয়
ইদুল আজহা বছরে একবার পালিত হলেও এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য এবং শিক্ষা সারা বছর ধরে মুসলিমদের জীবনে প্রতিফলিত হওয়া উচিত। ইদুল আজহার মূল উদ্দেশ্য হলো:

১. আত্মত্যাগ ও সংযম: জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ত্যাগ ও সংযমের গুরুত্ব উপলব্ধি করা।
২. আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও আনুগত্য: আল্লাহর আদেশ এবং তাঁর প্রতি বিশ্বাসের নিদর্শন হিসেবে আত্মত্যাগ করা।
৩. সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ: কোরবানির মাংস বিতরণের মাধ্যমে সমাজের দরিদ্র ও অসহায় মানুষের প্রতি সহানুভূতি ও দায়িত্ববোধ।

বাংলাদেশে ইদুল আজহা উদযাপন
বাংলাদেশে ইদুল আজহা উদযাপনের সময় লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে গরু, ছাগল, উট বা ভেড়া কিনে কোরবানি করা হয়। এই মহৎ উদ্দেশ্য পালন করা হলেও, কোরবানির আসল উদ্দেশ্য যেন প্রতিফলিত হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা জরুরি।

কিছু রিফ্লেকশন
১. আত্মপ্রচারের পরিবর্তে প্রকৃত ত্যাগ: অনেক সময় দেখা যায় যে, কোরবানির পশু কেনার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা এবং প্রদর্শনীর প্রবণতা থাকে। বড় পশু কোরবানি করার মাধ্যমে সামাজিক মর্যাদা দেখানোর প্রবণতা কখনো কখনো প্রকৃত ত্যাগের মূল উদ্দেশ্যকে আড়াল করে দেয়। ইদুল আজহা কেবল প্রদর্শনের জন্য নয়, বরং আন্তরিকভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য হওয়া উচিত।

২. দরিদ্র ও অসহায়দের প্রতি দায়িত্ববোধ: কোরবানির মাংস সমাজের দরিদ্র ও অসহায় মানুষের মধ্যে বিতরণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় দেখা যায়, মাংস বিতরণ সঠিকভাবে হয় না এবং তা শুধুমাত্র আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। সমাজের সকল স্তরের মানুষের মাঝে ন্যায্যভাবে মাংস বিতরণ করা ইদুল আজহার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।

৩. পরিবেশ সচেতনতা ও পরিচ্ছন্নতা: কোরবানির সময় পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করা এবং পরিবেশের ক্ষতি না করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় দেখা যায়, কোরবানির পর রাস্তা এবং আশেপাশের পরিবেশ নোংরা হয়ে যায়। ইসলামের শিক্ষা হলো পরিচ্ছন্নতা এবং এটি কোরবানির সময়ও মেনে চলা উচিত।

বিশ্বের মুসলিম জনগোষ্ঠির প্রশ্ন: ইউরোপে ঈদুল আজহা উপলক্ষে সরকারি ছুটি নেই কেন?
ইউরোপের বেশিরভাগ দেশেই ঈদুল আজহা উপলক্ষে সরকারি ছুটি নেই। এর প্রধান কারণ হল এই দেশগুলোর ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সেখানে মুসলিম জনসংখ্যার অনুপাত কম হওয়া। ইউরোপের দেশগুলোতে সরকারি ছুটি সাধারণত খ্রিস্টান ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা জাতীয় দিবসগুলির সাথে সম্পর্কিত হয়। মুসলিম জনসংখ্যার অনুপাত কম থাকায় এবং বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষের সহাবস্থান থাকায়, সরকার সাধারণত কোনো নির্দিষ্ট ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে সরকারি ছুটি হিসেবে ঘোষণা করে না। তবে, মুসলিম কমিউনিটির সদস্যরা ব্যক্তিগতভাবে এবং নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যে এই দিনটি উদযাপন করে থাকেন।

উপসংহার
ইদুল আজহা হলো আত্মত্যাগ, সংযম, এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের প্রতীক। বছরে একবার এই উৎসব পালিত হলেও এর মূল শিক্ষা সারা বছর আমাদের জীবনে প্রতিফলিত হওয়া উচিত। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোরবানির সময় যে আড়ম্বর ও প্রতিযোগিতা দেখা যায়, তা থেকে বিরত থেকে কোরবানির আসল উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা জরুরি। সমাজের দরিদ্র ও অসহায় মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধ এবং পরিবেশের প্রতি সচেতনতা রেখে ইদুল আজহা উদযাপন করা আমাদের সকলের লক্ষ্য হওয়া উচিত।

রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
[email protected]

Read Entire Article