আমি মরেও বেঁচে থাকব তোমার জন্য

1 month ago 16

অমিয় দাশ, ফ্লোরিডা, যুক্তরাষ্ট্র

‘কি জানি বাবা। ঈশরাতের আম্মা তো তাই কইলো।’
বাবা বললেন,
‘কানুনগো একটা সরকারি পদ। হ্যাঁ, খারাপ না।’
‘কানুনগোদের কি কাজ?’
‘জমিজমার সার্ভে, মানে মাপঝোপ করে কানুনগো পদের চাকরি করা লোকজন।’
‘তার মানে কি সরকারি আমিন?’
‘তা ঠিক না, তবে কাছাকাছি।
‘তাহলি ঠিক আছে। জমিজমা মাপতি যাইয়ে এট্টু আট্টু কমবেশি দিলিই তো পয়সা। মাইয়েডা ভালোই থাইকপেনে।’
এবার উপরীর ব্যাপারটা বুঝলাম। আর মা যে সেটার খুব গুরুত্ব দিচ্ছে তাও বুঝলাম।

লোকমান ভাইয়ের জন্য মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। মনে হচ্ছিল তখনই গিয়ে লোকমান ভাইকে এ খবরটা দিয়ে আসি। কিন্তু সন্ধ্যা পেরিয়ে অন্ধকার হয়েছে। এ অন্ধকারে কোনোভাবেই আমাকে বাড়ি থেকে বের হতে দেবে না। মনস্থির করলাম যে, কাল সকালে স্কুলে যাওয়ার আগেই লোকমান ভাইকে খবরটা জানাতে হবে। কিন্তু তারপর লোকমান ভাই কি ব্যবস্থা নেবে? ঈশরাত আপুর হবু বর তো একটা ভালো সরকারি চাকরি করে। আর লোকমান ভাই তো বিএ পাস করে মাত্র চাকরি খুঁজছে। কবে চাকরি পাবে তা কি কেউ জানে?

দেখতে দেখতে মাসের শেষ ঘনিয়ে এলো। ঈশরাত আপুদের বাড়ি রঙিন কাগজ তিনকোনা করে কেটে, আঠা দিয়ে সুঁতুলির সাথে লাগিয়ে লম্বা লম্বা করে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। উঠোনে বড়ো চাঁদোয়া খাঁটিয়ে প্যান্ডেলের মতো করা হয়েছে। বিরাট জমজমাট ব্যবস্থা।

ঈশরাত আপুর বিয়ে হয়ে গেলো কানুন গো জামাইয়ের সাথে। বিয়ে অনুষ্ঠানমালার অনেক অংশেই আমি উপস্থিত ছিলাম। বিয়ের সাজে ঈশরাত আপুকে যে কি দারুণ সুন্দর লাগছিল, সে তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না। লাল একটি শাড়ীর মাঝে অনেক সোনালী রঙের কাজ করা। শাড়ীর পাড়টাকে মনে হচ্ছিল স্বর্ণ দিয়ে বানানো। নাকে নথ, মাথায় টিকলী, বড় আর ভারি হার, চুড়ি, হাতে মেহেদীতে তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন একটা ডানাকাটা পরী। যেন এখনই তার পীঠে হাল্কা গোলাপী দুটো পাখা গজিয়ে উড়ে চলে যাবে গাছের ওপর দিয়ে আকাশে।

বিয়ে হয়ে গেল বটে, কিন্তু পুরো সময়টাতেই ঈশরাত আপু মুখ খুব গোমড়া করে বসে ছিল। ভিডিওম্যান ও ক্যামেরাম্যানদের অনেক অনুরোধেও হাসতে পারলো না। শুধু সবার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল, যেন সে কাউকে দেখতেই পাচ্ছে না। আমাকে এক সময় হাতের ইশারা করে কাছে ডেকে নিয়ে আস্তে আস্তে বললো একটু পরে আমি একা হলে আমার সাথে দেখা করিস।

আমি ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ সম্মতি দিলাম। আমি তাকে তাকে থাকলাম, কখন ঈশরাত আপু একটু একাকী হয়। এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেলো। ঈশরাত আপু আজ ওখানকার মধ্যমণি। একাকী পাওয়া? সে যে বিরাট দুষ্কর ব্যাপার। দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল হয়ে গেল। লোকজন, আমন্ত্রিত অতিথিরা, পাড়াপড়শী সবাই আসছে বউ জামাই দেখতে। সে এক লোকে লোকারণ্য অবস্থা।

সবাই যখন বিকেলের চা নাস্তা খাওয়া নিয়ে ব্যাস্ত, তখন আমি কয়েক মিনিটের জন্য ঈশরাত আপুকে একাকী পেলাম। ঈশরাত আপু তার মাথার চুলের সাথে বাঁধা, কপালের উপর ঝুলে থাকা সুন্দর টিকলী টা খুলে, বিছানার নিচ থেকে একটা কাগজ বের করল। কাগজের চারভাঁজের মধ্যে টিকলীটা ঢুকিয়ে তাড়াতাড়ি আমাকে দিলো।

বলল,
‘দীপ্ত এটা ওকে দিস।’
বলেই সে হাউমাউ করে ফুপিয়ে কেঁদে বিছানায় গড়িয়ে পড়ল।
আমি কি করবো বুঝতে পারলাম না। ঈশরাত আপুকে কি সান্তনা দিয়ে, না কাঁদতে অনুরোধ করব? নাকি চলে যাব? ভেবে পেলাম না। কয়েকজন হাসাহাসি করতে করতে ওই রুমের দিকে আসছে শুনেই আমি সম্বিত ফিরে পেলাম। আমার মাথায় বুদ্ধি খেললো যে এখানে একা ঘরে কেনই বা দাঁড়িয়ে আছি? কেউ জিজ্ঞেস করতে পারে। ঈশরাত আপুকে কান্নারত রেখেই তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।

উঠানে বসা-দাঁড়ানো মেহমানরা, অন্যান্য দর্শনার্থীরা গুঞ্জন করছিল যে চা-নাস্তার পরপরই জামাই-বউ রওনা হবে। এই অধ্যায়টা আমি এ এলাকার বিয়েতে বারবার দেখেছি। বউ শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার সময় অনেক কাঁদে। সে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গীর, বিভিন্ন শব্দের কান্না। আর নতুন বউ কাঁদবেই বা না কেন? জন্মের পর থেকেই যে মেয়ে তার আশেপাশের প্রিয়জনের সাথে ছিলো, সে এখন ছেড়ে চলে যাচ্ছে একটা অজানায়।

যে জায়গা, মানুষজন, পারিপার্শ্বিকতা, সবকিছুই তার কাছে অপরিচিত। তারপর চিন্তা থাকে, সেখানে সবাই তাকে এই চিরচেনা সবার মতো স্নেহ করবে, ভালোবাসবে তো? তার সব অভ্যাস পাল্টে ফেলতে হবে, তার সব শখ হয়তো হারিয়ে যাবে। ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো দামই থাকবে না। ইচ্ছে হলেও সে তার প্রিয়জনগুলোর সাথে দেখা করা, কথা বলা, তাদের সুখ-দুঃখের সাথী হতে পারবে না।

বিয়ে হওয়ার পরে শ্বশুরবাড়ির লোকজন হয়তো অন্যকোনো নামে তাকে ডাকবে। বাবা-মায়ের দেওয়া এই অতি আদরের সাধারণ কিন্তু অমূল্য নামটাও হয়তো পাল্টে ফেলতে হবে। কে জানে? হয়তো এত সাধারণ নামে বর্তমানে বা পূর্বে শ্বশুরবাড়িতে কোন কাজের মেয়ে ছিল কোনো এক কালে। সবই সম্ভব।

কান্না একটা সংক্রামক ব্যাপার। আশপাশে অন্য কাউকে কাঁদতে দেখলে তার পাশের মানুষজনের কান্না পায়। কান্না না পেলেও তার মন বেশ খারাপ হয়ে যায়। ভাবলাম, কান্না পাক, আর যাই হোক, প্রিয় ঈশরাত আপুর বিদায় দৃশ্যতে আমি সাথে থাকবো। তাতে নিঝোরে কান্না পেলে কাঁদবো। মন থেকে যদি অনেক কান্না পায়, সে কান্না যদি বুকের খুব ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে, তবে সে কান্নাকে আটকে রেখে লাভ কি? আমার আপন জনের জন্য কাঁদবো, তাতে কার কি বলার আছে বলো?

হাত দিয়ে পকেটে রাখা কাগজে মোড়া টিকলীটাকে একটু ছুঁয়ে নিলাম, যে ঠিকঠাক আছে কিনা। মেহমানরা সবাই রঙিন চাঁদোয়ার নিচে গোল হয়ে বসে নাস্তা খাওয়া সেরে, জম্পেশ করে চা খাচ্ছে। সবাই একে অন্যের সাথে কথা বলছে। আমরা ছোটরাও নাস্তা খেয়ে দৌড়াদৌড়ি, লাফ-ঝাপ, খেলাধুলায় ব্যাস্ত। ওপাশে পাড়ার বউরা ঘোমটা মাথায় উঁকি দিয়ে নতুন জামাইকে দেখার পর নিজেদের মধ্যে হাল্কা কথাবার্তা, মাঝেমাঝে হাসি-খুনসুটি করছে। সব মিলিয়ে গুমগুম শব্দে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে বড় রঙিন চাঁদোয়ার নিচেটা।

হঠাৎ ঈশরাত আপুর ঘরের বারান্দা থেকে বরপক্ষের একজন মেয়ে একজন মহিলাকে ডেকে বলল,
‘আমি বউকে সাজগোজ ঠিক করে শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার জন্যে সাহায্য করছিলাম। বউয়ের টিকলীটা পাওয়া যাচ্ছে না।’
নারীটা হতভম্ব হয়ে বিস্ময়ের সাথে বলল, ‘বলিস কি? ওটা তো স্বর্ণের টিকলী। ইমিটেশনের না। সবখানে খুঁজেছিস্?’

বলেই তড়িঘড়ি করে ঈশরাত আপুর ঘরে গেলো। আমি খেলা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে চুপ হয়ে গেলাম। আস্তে আস্তে বারান্দার কাছে এসে দাঁড়ালাম।
ঘরের ভেতরে মহিলাটা ঈশরাত আপুকে উচ্চস্বরে জিজ্ঞেস করল,
‘টিকলী কি খুলেছিলে, কোন কারণে?’
ঈশরাত আপু বলল,
‘না।’
‘তাহলে গেলো কোথায়?’
‘তা জানি না। হয়তো কোথাও পড়ে গিয়েছে।’
‘টিকলীটা পড়লে তো এই খাটের ওপরে বা আশপাশেই পড়বে।’
ঈশরাত আপুকে কিছু বলতে শুনলাম না। চার-পাঁচ জন নারী আর মেয়ে মিলে ঘরের দরজার চৌকাঠ থেকে শুরু করে প্রতিটি কোনা তন্ন তন্ন করে খুঁজলো।

বর পক্ষের একজন অতি উৎসাহী মেয়ে উঠানে এসে বরপক্ষের মাতব্বর শ্রেণির একজনের কানে কানে কি যেন বলে গেলো। কানে কানের কথা ওই গোল মিটিঙের এক এক করে সবার কানেই গেলো। সবাই একটু রাগান্বিত আর বিরক্ত মুখে একে অন্যের মুখের দিকে তাকালো।

তাদের একজন মিনমিন করে বলল,
‘এইরহম আগেও দেখিছি। সুনার জিনিস দেখাইয়ে, রুপোর জিনিস দেয়। আর এতদিন-দুপুরি ডাহাতি। এক্কেবারে পুইরোডাই গায়েফ!’

এই ‘গায়েফ’ কথাটা শোনার সাথে সাথেই আমার গা চমকে উঠলো। আমার পকেটেই তো আছে গায়েব হওয়া টিকলীটা। এখনই হয়তো তুলকালাম কিছু একটা বেঁধে যাবে। চোর ধরার জন্যে হয়তো সবাইকে তল্লাশি করবে, কিংবা বাটি চালান দেবে। কে জানে? আমাকে হয়তো চোর সাব্যস্ত করে গণধোলাই দেবে। বাড়িতে ঢোকার বেকী বেড়ার দিকে যে ছেলেরা দৌড়ঝাঁপ খেলছিলো, আমি আস্তে আস্তে তাদের ওখানে গেলাম, যেন ওদের সাথে খেলতে যাচ্ছি। একটুখানি খেলার পরে আমি ওদের বললাম যে আমার বাড়ি যেতে হবে। বলেই টুক্ করে, টু শব্দ না করে, বেরিয়ে এলাম।

ঈশরাত আপুর বিদায় দৃশ্য আমি দেখতে পাইনি। তার কষ্টের গভীরতা যদিও আমি ঠিক ঠিক কল্পনা করতে পারি। আমি আর দেরী না করে সোজা লোকমান ভাইয়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। পকেটের মাঝে টিকলীটা আছে কিনা, বার বার পকেটে হাত দিয়ে পরখ করে নিচ্ছিলাম। বড় রাস্তা থেকে নেমে লোকমান ভাইদের বাড়িতে যেতে সরু মাটির রাস্তা ধরে আসার সময় কাউকেই চোখে পড়লো না এই বিকেলের শুরুতে।

এদিককার অনেককেই বিয়ে বাড়িতে দেখেছি। লোকমান ভাইদের বাড়ির সামনে আসতেই টমী কুঁইকুঁই করে কাছে এসেই লেজ নেড়ে নেড়ে আমার যে পকেটে টিকলী মোড়ানো কাগজটা আছে সেখানে মুখ ঘষতে লাগলো। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম, কিন্তু লোকমান ভাই বেরিয়ে এলো না। সে বাড়িতে আছে কিনা কে জানে?

আমি আস্তে আস্তে ডাকলাম,
‘লোকমান ভাই, বাড়িতে আছেন?’
লোকমান ভাইয়ের মা রান্নাঘর থেকে একটু মুখ বের করে বললেন,
‘লোকমান বাড়িতে নেই। সাইকেল নিয়ে বাজারে না কোথায় যেন গেলো।’
‘আচ্ছা। বাড়ি আসলে বলবেন যে আমি এসেছিলাম দেখা করতে।’
‘বলবা নে।’
বলেই তিনি তার কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলেন।

আমি তখন কি করি? বাড়ি যাবো, না ফুটবল মাঠে যাব? ভেবে স্থির করতে চিন্তা করছি। মনে হলো, নাহ্ ফুটবল মাঠে যাওয়া যাবে না। দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে টিকলীটা খেলার মাঠে পড়ে হারিয়ে গেলে মহাসর্বনাশ হয়ে যাবে। সিদ্ধান্ত নিলাম, লোকমান ভাইদের বাড়ির রাস্তা দেখা যায় এমন কোথাও তার জন্য অপেক্ষা করবো। অগত্যা ওনাদের বাড়ির কাছেই মাঠের মধ্যে একটা কচাগাছ তলায় গিয়ে হাজির হলাম।

কয়েকটা খণ্ড জমি পার হলেই কচা গাছটা। বেশ বড়সড় সাইজের গাছ। গাছের তলায় বেশ পরিষ্কার। হয়তো আশপাশের কৃষকরা কাজের ফাঁকে এখানে একটু বিশ্রাম করে কচাগাছের ছায়ায়। এখান থেকে লোকমান ভাইয়ের বাড়িতে ঢোকার রাস্তা পরিষ্কার দেখা যায়। চেয়ে রইলাম পথের দিকে কখন লোকমান ভাই বাড়িতে ফিরবে।

সে অনেকক্ষণ হবে বোধ হয়। কী করব ভেবে না পেয়ে পকেট থেকে সেই টিকলীটা বের করলাম। কি সুন্দর অর্ধচন্দ্রাকৃতির একটা ডিজাইন! চাঁদের দুই কোনা থেকে দুটি, আর মাঝখান থেকে একটি চেইনের টানা দিয়ে একত্রিত হয়েছে একটু ওপরে গিয়ে। অর্ধচন্দ্র থেকে সাতটি ছোট ছোট বলের ঝুলুম ঝুলছে। মাঝের ঝুলুমটা একটু বেশি লম্বা করে ঝুলে আছে, অন্যান্য ঝুলুমগুলোর চেয়ে। টিকলীর লকেটটা একটা বেশ চওড়া চেইনের সাথে ঝুলছে।

চেইনের অন্য মাথায় একটা হুকের মতো, দেখতে অনেকটা বড়শীর মতো আংটা। যা দিয়ে চুলের সাথে আটকিয়ে রাখা হয়েছিলো। টিকলীটা পরার পর ঈশরাত আপুকে খুব সুন্দর মানিয়েছিল। টিকলীটা কাগজের মধ্যে ফের রাখতে গিয়ে চোখে পড়ল ওই কাগজটা। কাগজটাতে কি যেন গোটা গোটা করে লেখা। ঈশরাত আপুর হাতের লেখা। লেখাটা অনেকবার পড়লাম। অনেকবার। এভাবে বারবার পড়াতে চিঠিটা আমার এক্কেবারে মুখস্থ হয়ে গেলো। তাতে লেখা ছিল,
‘প্রিয়তম টমীর বাবা,
আমি মরে গিয়েও বেঁচে থাকব।
তুমিও মরে বেঁচে থেকো।
এই টিকলীটা তোমাকে দিলাম।
জেনো, আমার যে তুমি ছাড়া আর কেউ নেই।
তুমি বেঁচে থাকলে অন্তত চোখের দেখাটা দেখতে পাবো।
ইতি,
শুধু তোমার টিকলী।’

আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে, ঈশরাত আপু লোকমান ভাইকে আদর করে ‘টমীর বাবা’ বলে ডাকে। আর লোকমান ভাই ঈশরাত আপুকে আদর করে ডাকেন ‘টিকলী’ বলে। ওগুলো আসলে ওদের একে অন্যকে দেওয়া গোপন নাম।

চিঠির একদম শেষে লাল রঙের একটা লিপিস্টিকের ঠোঁটের মতো আঁকা। তবে এই লাল রঙের ওখানে বেশ একটা সুন্দর ঘ্রাণ আছে। এই মাঠের ফুরফুরে বাতাসেও ঘ্রাণটা বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি কাগজটা ভাঁজ করলাম যাতে ঘ্রাণটা বাতাসে আর উড়ে না যায়। কাগজের মধ্যে যত্ন করে টিকলীটা ভরে আবার পকেটে ঢুকিয়ে রাখলাম, যেন আপাচাপ কেউ এসে পড়লে দেখতে না পায়।

এক সময় দেখলাম লোকমান ভাই খড়্খড়্ করে সাইকেলের শব্দ করে যেন পাখির মতো উড়ে এলো ওনাদের বাড়ির ওখানে। সাইকেলের গতি না কমিয়েই সাই করে বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেলো। তাড়াতাড়ি করে আমি লোকমান ভাইদের বাড়ির দিকে রওয়ানা হলাম। মাঠের আইলের ওপর দিয়ে হাঁটছিলাম বটে, কিন্তু আমার চোখ ওনাদের রাস্তার দিকে। কি জানি, যদি আবার কোথাও কোন কাজে বেরিয়ে যায় তাহলে একটা ভারী সমস্যা হবে।

আগের পর্ব পড়ুন

লোকমান ভাইয়ের বাড়ির সামনে পৌঁছাতেই টমী এসে আবার লেজ নাড়তে লাগলো। আর আমার পকেটের কাছে মুখ ঘষতে লাগলো। লোকমান ভাই এলো না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। ওনার মা নিশ্চয়ই এখনো আমার খবরটা দেয়নি বা দেওয়ার সময় পায়নি। এদিকে আমারও খেলার সময় প্রায় পেরিয়ে যাচ্ছে।
আস্তে আস্তে লোকমান ভাইকে ডাকলাম,
‘লোকমান ভাই।’
‘কে?’

’আমি।’ বলেই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম টমীর সাথে।

লোকমান ভাই বাইরে থেকে এসে মনে হয় হাত মুখ ধুচ্ছিল। গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে রাস্তার দিকে এলো। পরনে একটা জিন্সের প্যান্ট, আর তার গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জী। চুলগুলো লম্বা উল্লোঘুল্লো। ঝাঁকড়া চুলে বাতাস লেগে ফুরফুরিয়ে উড়ছে, যেন কোনো যত্ন পড়েনি কয়েকদিন।
বলল,
‘কিরে দীপ্ত, তুই এখানে?’
চোখে তার আশ্চর্য হওয়া দেখে মনে হলো সে আমাকে আজ এ সময়ে আশা করেনি।
বললাম,
‘‘ঈশরাত আপু এটা দিয়েছে আপনাকে দেওয়ার জন্য।’
বলেই কাগজে মোড়া টিকলীটা হাত উঁচু করে সামনে এগিয়ে ধরলাম। লোকমান ভাই কিঞ্চিত দ্বিধার সাথে কাগজটা হাতে নিলেন। টমী লেজ নাড়তে নাড়তে মুখ উঁচু করে লোকমান ভাইয়ের মুখের দিকে তাকালো। কাগজের মধ্যে টিকলীটার একটু কড়কড় শব্দ হতেই টমী দুবার ফুঃ ফুঃ করে ডেকে উঠলো। লোকমান ভাই কাগজে মোড়া টিকলীটা জিন্সের পকেটের রেখে বললেন,
‘একটু দাঁড়া, আমি আসছি।’
বলেই বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন। লোকমান ভাই ফিরে এলেন অন্যদিনের চেয়ে অনেকটা বড়, সাদা প্যাকেট নিয়ে। কাছে এসে আমার হাতে প্যাকেটটা দিয়ে বললেন,
‘নে খাস্।’

অবাক হয়ে আমি বললাম,
‘তাই বলে এতগুলি কদমা?’
‘হ্যাঁ। তোর জন্য কিনে এনে ঘরে রেখেছিলাম, অল্প অল্প করে দেবো বলে। এখন থেকে আর লাগবে না তোর কদমা, তুই নিয়ে যা।’

প্যাকেট থেকে দুটো কদমা টমীর দিকে উঁচু করে একটা একটা করে ছুঁড়ে দিলাম। টমী প্রথমটা ক্যাচ ধরলো। দ্বিতীয়টা শূন্যে ছোড়ার সাথে সাথে প্রথম কদমাটাকে মুখ থেকে মাটিতে রেখে, দ্বিতীয়টা ক্যাচ ধরে মুখে রাখল। তারপর অপলকে মাটিতে রাখা প্রথম কদমার দিকে চেয়ে কি যেন ভাবতে লাগলো। আমিও কদমার প্যাকেটটা নিয়ে ফুটবল মাঠে খেলতে চলে গেলাম। আমার মনে আছে আমি সেদিন সব ফুটবল-বন্ধুদের সাথে ভাগাভাগি করে কদমাগুলি খেয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, আজ আমার পিয়নের চাকরি থেকে এটা যেন বিদায় সংবর্ধনা।

জানো, এর পরের ব্যাপারগুলো ঘটলো খুব তাড়াতাড়ি, ঝড়ের গতিতে। আমি সব খবর পেতে লাগলাম আমার মায়ের সাথে গল্প করতে আসা এক মুখরা পড়শীর গল্প গুজব থেকে। এখানকার নারীরা দুপুরের খাওয়া পরবর্তী বাসন-কোসন মাজা, সবকিছু গুছিয়ে রাখা, এসব কাজ সেরে এবাড়ি ওবাড়ি গিয়ে একটু গল্প-গুজব করে। গল্প-গুজবের অধিকাংশ বিষয়ই কোনো না কোনো সমালোচনা, কুকথা ভরা। আমার মা অবশ্য ভালো শ্রোতা।

এ সময়টা আমারও তেমন কিছু করার থাকতো না। স্কুল থেকে এসে তাই মুখরা পড়শী এলেই কান খাড়া করে থাকতাম। যা শুনলাম, ঈশরাত আপুর বিয়ের পরদিন ভোরে লোকমান ভাই নাকি বাড়ি থেকে চলে গিয়েছে। সে তার সাইকেলটা নিয়ে গিয়েছে। কে না কে দেখেছে যে, সে এখান থেকে বেশ দূরে জেলা শহরের পাশের একটা বড় হাইওয়ের পাশ দিয়ে সাইকেল চালিয়ে কোথায় যাচ্ছে। শুনে খুব ভয় পেলাম, যদি বাস বা ট্রাকে ধাক্কা দেয়।

মাস খানেক পর একদিন শুনলাম, লোকমান ভাই বাড়িতে ফিরে এসেছে তার অজ্ঞাতবাসের পর। কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়িয়ে, ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া না করে, কঙ্কালসার হয়ে ফিরেছে। তার মুখের চোয়াল বসে গিয়েছে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি থাকলেও নাকি বোঝা যায় যে তার মুখে মাংস বলতে কিছু নেই। দেখে নাকি তাকে আর চিনতে পারা যায় না। তার ঘাড়ে নাকি ‘টিকলী’ নামে একটা জ্বীন-পরী আছর করেছে। ঝাড়-ফুঁক করার জন্য লোকমান ভাইয়ের আব্বা একটা ফকির এনেছিলেন।

লোকমান ভাই তাকে মারধোর করে তাড়িয়ে দিয়েছেন। এখন নাকি দিনের অনেক সময়ই ওদের বাড়ির কাছের বড় কচাগাছের তলায় দাঁড়িয়ে লোকমান ভাই অভিনয় করে, আর বক্তৃতা দেয়। লোকমান ভাই ফিরে এসেছে বটে কিন্তু সাথে এনেছে একটা কাগজের তৈরি বল। বড় সাইজের ফুটবলের মত কাগজের বল। সে সবসময়ই নাকি ওই বলটা বগলদাবা করে গোলকীপাররা ফুটবল ধরে যেভাবে ফুটবল খেলার মাঠে খেলতে নামে, সেরকম ধরে ঘোরাফেরা করে। ঘাড় থেকে জ্বীন-পরী নামানোর ঝাড়ফুঁকের ফকির নাকি তাড়া খেয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে বলেছিল, ‘জ্বীন-পরী ওই বলের মইধ্যেখানে বইসে আছে।’

এলাকার সবারও একই ধারণা। ফকির ফর্দ দিয়েছে যে, বলটাকে একটি মাটির নতুন হাড়ির মধ্যে ভরে, এগারটি জ্যান্ত তেলো টাকি মাছের মাথা কেটে ওই হাড়ির মধ্যে রাখতে হবে। তারপর হাড়ি মাটির সরা দিয়ে ঢেকে, পিচ গলিয়ে হাড়ির মুখের ফাঁকফোকর ভালোভাবে বন্ধ করে নদীতে ভাসিয়ে দিতে হবে। তবেই নাকি লোকমান ভাইয়ের ঘাড়ে ভর করা জ্বীন-পরী তাকে ছেড়ে যাবে। লোকমান ভাইয়ের বাড়ির সবাই তাকে তাকে আছে, ফকিরের ফর্দ পালন করার অপেক্ষায়। সুযোগ পেলেই ফকিরের ফর্দ অনুযায়ী বলটাকে হাড়িতে ভরে ওভাবে নদীতে ভাসিয়ে চালান করে দেবে।

ভাবলাম, একদিন দিনের বেলায় ওই কচাগাছ তলায় গিয়ে লোকমান ভাইকে দেখে আসব। কিন্তু চিন্তাটা মাথায় আসতেই বেশ ভয় ভয় করলো। আবার মনে হলো, কিছু একটা ফ্যাকরা আছে। স্থির করলাম, আমাদের পাড়ার কোনো বন্ধুকে নিয়ে যাব। তাতে একটু সাহস পাওয়া যাবে।

ভয়ের একটা বড় কারণ হলো লোকমান ভাই একটা ধারালো ছুরি নিয়ে নাকি তাড়া করে। সেটা অবশ্যই ভয়ঙ্কর বৈকি? এইতো সেদিনই নাকি তার সর্বক্ষণের সাথী ওই ধামা সাইজের কাগজের তৈরি বলটা কয়েকটা বখাটে দুষ্টু ছেলেরা ছিনিয়ে নিয়ে প্রথমে ক্যাচ-থ্রো খেলেছিল। লোকমান ভাইয়ের মাথার ওপর দিয়ে এপাশ থেকে ওপাশে ছুঁড়ে ছুঁড়ে খেলেছিল। লোকমান ভাই নাকি অনেক কাকুতি মিনতি করেছিল কাগজের বলটি ফেরত দেওয়ার জন্য।

কিন্তু বখাটে দুষ্টু ছেলেরা সেটি ফেরত দেয়নি। তারপর ওই দুষ্টু ছেলেদের একজন কাগজের বলটিকে গোলকিপারের মতো প্রথমে জোরে শটলাথি দিয়ে দূরে দিলো। হাসাহাসি, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে ফুটবলের মতো লাথি দিয়ে খেলা শুরু করল, তখন লোকমান ভাই আর নিজেকে শান্ত রাখতে পারেনি। যেসব লোকজন গোল হয়ে ঘিরে তামাশা দেখছিল, তাদের মধ্যের একজন ডাব বিক্রেতার কাছ থেকে দা ছিনিয়ে নিয়ে, দা উঁচু করে মহা উন্মাদের মতো একটা ঘূর্ণি দিয়ে
‘কুপাইয়ে ফালা ফালা করে ফেলবো’

বলে হুংকার দিলে সবাই জান বাঁচিয়ে পালিয়েছিলো। সবাই পালালে লোকমান ভাই তার কাগজের বলটা বুকে জড়িয়ে ধরে নাকি রাস্তার ওপর বসে চিৎকার করে অনেক কেঁদেছিল আর বিড়বিড় করে অনেককিছু বলেছিল। সেই থেকে লোকমান ভাই সব সময় একটা ধারালো ছুরি নিয়ে ঘোরে। তবে কাউকে কখনো সেটা দিয়ে খোঁচা টোঁচা দিয়েছে বলে শোনা যায়নি। ছোটখাটো দাঁ ছুরি নিয়ে যে কেউ তো ঘুরতেই পারে।

এটাতো কোনো মহা অপরাধ না, কি বলো? লোকমান ভাই কারো ক্ষতি করে না। সে থাকে তার মতো। তবে তার নিজস্ব কিছু সম্পদ রক্ষা করতে যদি হিংস্র হতে হয় তাতে কি তার কোনো দোষ আছে? এরপর থেকে কোন বখাটে দুষ্টু ছেলেরা বা কেউই এই টিকলী-পরীতে আছর করা লোকমান ভাইয়ের কাছ থেকে কাগজের বলটি ছিনিয়ে নিতে সাহস করেনি।

একটা ছুটির দিনে আমি আর এ পাড়ার ফুটবল-বন্ধুকে নিয়ে লোকমান ভাইদের বাড়িতে দেখা করতে গেলাম। বন্ধুটি যদিও প্রথমে রাজী হয়নি।
কিন্তু বলল,
‘যাতি পারি। তয় লইক্ক্যা পাগোল দাবোড় দিলি কিন্তু আমি ঝাইড়ে দোইড় মারবানে।’
ইদানীং লোকমান ভাইকে এ এলাকার লোকজন ‘লইক্ক্যা পাগোল’ বলে ডাকে।
বললাম,
‘আচ্ছা। তুই দোইড় মাল্লি আমি কি আর বইসে থাক্পানে নাকি? চল যাই, দেখি কি হয়।’

বুকের মাঝে দুরুদুরু করছে ভয়ে। লোকমান ভাইদের বাড়ি যত কাছে আসছে ততই বুকের সেই দুরুদুরুটা বাড়ছে। লোকমান ভাইদের বাড়ির সামনে এসে আমরা দুজন দাঁড়িয়ে পাঁচীলের বেড়ার ফাঁকফোকর দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারলাম। কিন্তু বাড়িতে কাউকে দেখতে পেলাম না। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে ইতস্তত কাটল আমাদের। তারপর হঠাৎ টমীর ডাক শুনেই চকিতে এদিক-ওদিক তাকিয়ে খুঁজলাম তাকে। আবার সে ফুঃ ফুঃ ডাক দিল।

বুঝলাম সেই শব্দটা কচাগাছের ওদিক থেকেই আসছে। তাকিয়ে দেখি টমী কচাগাছের নীচে আমাদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা ভয়ে ভয়ে মাঠের আইলের ওপর দিয়ে টমীর দিকে আগাতেই চোখে পড়লো লোকমান ভাই মাটিতে বসে আছে মাথা নিচু করে।

আস্তে আস্তে আমরা প্রায় লোকমান ভাইয়ের কাছাকাছি আসতেই সে উঠে দাঁড়ালো। আমি আরো কাছাকাছি এসে পড়েছি। কিন্তু আমার বন্ধুটা ভয়ে আইলের ওপরে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকলো। মনে হয় ভয়ে তার পা আর চলছিলো না। লোকমান ভাই ছুরি উঁচু করে আমার বন্ধুটিকে ইশারা করে বললো দূরে যেতে। বন্ধুটি আরও একটু পিছু হঠে বিপদমুক্ত দূরত্বে গিয়ে দাঁড়ালো।

আমি কচাগাছ তলায় এলাম বটে, কিন্তু বেশ খানিক দূরত্ব রেখে মাটিতে চুপটি করে বসলাম। লোকমান ভাই তার ছুরিটি কোমরে গুঁজে রেখে আমার দিকে খুব মন খারাপের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আগের স্থানে মাটিতে বসে পড়লো। আমার ভয় করলেও, আমি জানতাম লোকমান ভাই আমাকে কিচ্ছু বলবে না। আপন বুঝ তো পাগলেরও আছে।

তার সামনে অনেক কাগজ। আজ তেমন বাতাস নেই এই ভর দুপুরে। তার পরেও লোকমান ভাই প্রতিটি কাগজের ওপর একটা করে ছোট ঢেলা দিয়ে ভারা দিয়ে রেখেছে, যেন বাতাসে কোনো কাগজ উড়ে না যায়। ছড়ানো সব কাগজ ভর্তি অনেক কিছু লেখা। পাশে কয়টা খামও আছে। খামগুলো দেখে চিনতে পারলাম। এই খামগুলো আমিই লোকমান ভাইকে ঈশরাত আপুর কাছ থেকে এনে বিলি করেছিলাম। আমার আর বুঝতে বাকি রইল না যে ছড়ানো ছেটানো কাগজগুলো আর কিছু নয়, সব লোকমান ভাইকে লেখা ঈশরাত আপুর চিঠি।

লোকমান ভাই শেষ চিঠিটি তুলে আবার মনোযোগ দিয়ে পড়লো। হাতের তালুতে টিকলীটা ধরে খুব পরখ করে দেখে নিয়ে, তাতে একটা চুমু খেয়ে, বুকের সাথে ছোঁয়ালো। টিকলীটাকে ঈশরাত আপুর শেষ চিঠি দিয়ে গোল করে মোড়ক করলো। তারপর একটা একটা করে চিঠি, সুন্দর করে টিকলী-মোড়কের উপরে আস্তরণ দিতে শুরু করল। দেখতে দেখতে সেটি একটি বেশ বড় সাইজের বাঁধাকপির আকার ধারণ করলো। যেন সুন্দর একটা চিঠির বাঁধাকপি।

বলটাকে সে কয়েকটা চুলের ব্যান্ড দিয়ে প্যাঁচালো, যেন চিঠিগুলো আলগা হয়ে পড়ে না যায়। একটা আজব ঘটনা দেখলাম। চুলের ব্যান্ড দিয়ে প্যাঁচানোর আগে, সে প্রতিটি ব্যান্ডকে নাকের সামনে এনে তার ঘ্রাণ শুঁকে নিলো। আমি দেখেছি ঈশরাত আপু ওরকম সব রংধনুর রঙের ব্যান্ড দিয়ে চুল বাঁধত। নিশ্চয়ই ব্যান্ডগুলো সে লোকমান ভাইকে উপহার দিয়েছে। হয়তো ঈশরাত আপুর চুলের ঘ্রাণ লোকমান ভাইকে তার কথা মনে করিয়ে দেয়।

গোল বলটাকে একটি পলিথিনের ব্যাগে সুন্দর করে রেখে উঠে দাঁড়ালো। তারপর কচাগাছের মগডালের দিকে তাকিয়ে বেশ আবৃত্তি করে, চীৎকার করে বলতে থাকলো অনেক কথা, কবিতার মতো করে। প্রতিটি কবিতা তার ঠোটস্থ। কবিতাগুলো পড়তে একটুও জড়িয়ে যাচ্ছিল না। শেষ কবিতা পড়েই মাটিতে বসে টমীকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো।

শেষের কবিতাটা ছিল,
‘প্রিয়তম টমীর বাবা,
আমি মরে গিয়েও বেঁচে থাকব।
তুমিও মরে বেঁচে থেকো।
এই টিকলীটা তোমাকে দিলাম।
যেনো, আমার যে তুমি ছাড়া আর কেউ নেই।
তুমি বেঁচে থাকলে অন্তত চোখের দেখাটা দেখতে পাবো।
ইতি,
‘শুধু তোমার টিকলী।’

আমিও মনে মনে লোকমান ভাইয়ের আবৃত্তির সাথে সাথে অস্ফুটভাবে সুর মিলিয়ে আবৃত্তি করেছিলাম শেষ চিঠিটা। চিঠিটা যে আমার খুব মুখস্ত।

তারপর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ওখান থেকে চলে এলাম। আমার বন্ধুটির কাছে আসতেই সে বিরক্ত হয়ে বলল,
-‘কিরে তুই কান্তিছিস ক্যান? তোরেও কি ওই টিকলী পরীতি আছর কইরলো নাকি?’

আমি কিছু বলতে পারলাম না। জানি না কেন কাঁদছিলাম। তবে আমার সে কান্না যেন আর থামতেই চায় না। মনে মনে বললাম,
‘হ্যাঁ আমাকেও টিকলী-পরীতে আছর করেছে। বুকের খুব ভেতরে, অনেক ভেতরে, কব্জা করে বসে আছে। আর ছাড়বে না কোনোদিন। আমি চাইও না সে টিকলী পরী আমার বুকের মাঝ থেকে আর কোথাও চলে যাক।’

জানো দোয়েল পাখী? ওই দিনটির কথা মনে পড়লেই আমার এখনো চোখ ছলছল করে, কান্না পায়। মনে হয় আমার গলার নলীর মধ্যে কিছু একটা আটকে গ্যাছে। কথা আটকে যায়। সেদিন তাই ফোনে তোমাকে ওভাবে বলেছিলাম যে, ওসব বলতে আমার যে বড়ো কষ্ট হয়। এই যে, এখনই আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমাকে তুমি ভুল বুঝো না, প্লিজ!

আর একটা কথা, আমার খুব ভয় হয়, তুমিও আবার আমার কাছে সেই লোকমান ভাইয়ের ‘টিকলী-পরী’ হয়ে যাবে না তো?
ভালোবাসান্তে,
ইতি,
শুধু তোমার, বাবুই

লেখক: অমিয় দাশ, ফার্মাসিস্ট, ওষুধ প্রস্তুতকারক,
বোকা রেটন, ফ্লোরিডা, যুক্তরাষ্ট্র। Email: [email protected]

এমআরএম/এএসএম

Read Entire Article