মাকেন্দ্রিক শৈশবে পাখির ডাকই ছিল আমার কানের রোমাঞ্চকর
সিলেবাসের সত্তর ভাগ; আর যেদিন থেকে
বাড়তি শোনার কান হয়েছে,
বাড়তি মুগ্ধতায় দুটি কানে বাজতে থেকেছে
ক্ষীণকণ্ঠ লোকমান ভাইয়ের আজানের সুর
আর রেডিয়োর অর্ফিয়াস আবদুল আলীম:
‘আমারে সাজাইয়া দিও নওশার সাজন...’।
বিধাতার কী যে অভিপ্রায় ছিল—
আমার সারাজীবন কবিতাময়—গানময়!
মিথ্যা বলা মহাপাপ। অতএব বলতে হয়—প্রেমময়ও।
সহরাখাল তসলিমের বাঁশির কথা আরেকদিন বলবো।
কলেজ হোস্টেলে পাশের রুমের সমশের ভাই
এবং ভার্সিটি হলে বন্ধু নুর মোহাম্মদের টেপ রেকর্ডার:
‘সও সাল পাহেলে মুঝে তুমসে পেয়ার থা...।’
মেলোডির যমুনায় ভেসে যাওয়া রঙিন পাল উড়িয়ে
স্বপ্নমাখা আবেগের স্রোতে ও তরঙ্গে... আহা রফি-লতা!
জান্নাতেও কি গাইবে তোমরা হুর-পরি আয়োজিত মাহফিলে!
বাংলাদেশ গেজেটে নাম উঠিয়েও অবিবাহিত সাড়ে পাঁচ বছর
সিভিল সার্জনের এ প্লাস সার্টিফিকেট হাতে এক প্রাণ
অথচ বিয়ের প্রস্তুতিমূলক বাজেট নয়,
ভ্রমণ বিলের টাকা বাঁচিয়ে একটি জাপানি টেপরেকর্ডার:
ন্যাশনাল প্যানাসোনিক। স্বপ্নের রং মাখা। বিশাল সাইজ।
পক্ষীমানব সালিম আলীর যেমন কানস্থ ছিল সকল পাখির ডাক—
তেমনিভাবে আধা দুনিয়ার গান আমার শ্রবণ সীমানায়!
ফিরোজা বেগম থেকে ভূপেন হাজারিকা,
মান্না দে থেকে তালাত মাহমুদ।
কোনো কোনো ছুটির দুপুরে ব্যাচেলর প্রাণের ঘরখানা হয়ে ওঠে
হৃদয়ময়: ‘পল পল দিল কে পাশ তুম রেহতি হো’;
কোনো কোনো রাতে ‘নিশি নিঝুম ঘুম নাহি আসে’ কিংবা
‘সে চলে গেছে বলে কি গো স্মৃতিও হায় যায় ভোলা’,
কোনো কোনো রাতে ‘চুপকে চুপকে রাত দিন
আঁশু বাহানা ইয়াদ হ্যায়’
—উপচে দেয় ফার্স্ট ক্লাস গেজেটেড একাকিত্বের পেয়ালা;
সুরের শুঁড়িখানায় ওমর খৈয়াম হয়ে উঠি;
সাকী সেই ক্যাসেট প্লেয়ার;
বিছানার পাশ ঘেঁষে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকে
লা নুই বেঙ্গলীর মৈত্রেয়ী,
শেষের কবিতার লাবণ্য এবং
ফৌজদারী কার্যবিধির ভাষ্য হাতে
গাজী শামছুর রহমান: শোন নাতনীরা,
দবির বাড়াবাড়ি করলেও এর মধ্যে কিন্তু
কোনো মিনস রিয়া নাই।
মাঝে মাঝে গেয়ে ওঠেন হেমন্ত, রুনা; সন্ধ্যাও।
আর মেহেদী হাসান—
সে তো প্রেমিক হৃদয়ের শারাবান তাহুরা:
‘দুনিয়া কিসিসে পেয়ার জান্নাত সে কম নেহি...’
কিন্তু দুনিয়ার সকল শিল্পী আর স্বর্গের কিন্নরীদের পরিবেশনাকে
পিছু হটিয়ে সবার ওপরে স্থান করে নেয়
একটি হোম মেড ক্যাসেট।
সাতটি গান—তিনমিশালী—রবীন্দ্র-নজরুল-আধুনিক।
তবলা ছাড়া হারমোনিয়াম।
একজন শিল্পী। দর্শক-শ্রোতাও একজন।
রেকর্ডে অগ্রাধিকার আমারই পছন্দের। সেই রেকর্ডে বাঁধা
একটি কণ্ঠ- দুটি হৃদয় আর এলোমেলো কিছু স্বপ্নের প্রাক্কলন...
তারপর করতোয়া নদী আরেক ‘মল্লিকাদির নাম’ ভুলে গেলে
কোনো কোনো সাঁঝ কীর্তনখোলার ডাকাতিয়া ঢেউ—
কোনো কোনো রাত পার্বতীপুর স্টেশনের পকেটমার পাড়া;
সবাইকে গুলে ভুলিয়ে
একটি অবিবাহিত ঘুমকে ঝুলিয়ে রেখে জলপাই গাছে,
লো-ভলিউমে বাজতে থাকে চতুর্দশীর রাত:
‘ও যে মানে না মানা। আঁখি ফিরাইলে বলে, ‘না না না।’
ক্যামোফ্লাজ রচনার জন্য কোনো কোনো চাঁদরাত এসে
নিজহাতে চালিয়ে দেয় লাস্যময়ী আশা ভোঁসলে:
‘লা লা লা লা আ আ লা লা আ লা লা আকাশের সূর্য আছে যতদিন...’
কিংবা জোয়ারকণ্ঠ আবদুল জব্বার:
‘জানি কবিতার চেয়ে তুমি সুন্দরতম ওগো মোর ভাবনার নায়িকা...।’
জোছনার জানালায় চোখ মেলে শিঁক ধরে দাঁড়িয়ে থাকা
ময়না ভাবি হয়তো বোঝেন—
কত গানে কত প্রেম: হায়রে এসিভাই, এতদিন কই ছিলেন!
বলাকার পাখায় কান পেতে টেপ রেকর্ডারটি মাঝে মাঝে চেয়েছে
নতুন ভোরের নতুন প্রাণের সুর;
কখনো বেজেছে ভালোবাসার গন্তব্যমুখী গান:
‘অ্যায় মেরে হামসফর ইক জারা ইন্তেজার...’
কখনো উধাও রথে উঠে
জীবন হয়ে উঠেছে বেদনার ধূলি ঝেড়ে ফেলা সেলিন ডিওন:
‘I get wings to fly—Oh, oh I’m alive...
কত যে বদলি! কত যে বদলিজনিত বাধ্যতামূলক ভ্রমণ!
পিছে ফেলে আসা
কত পরিচিত নদী
যাপিত দুপুর
উদযাপিত সন্ধ্যা
কিংবা
জেগে থাকা রাত!
এলোমেলো হয়ে হারিয়ে যায় এলিফ্যান্ট রোডের
গানের ডালি
গীতালী
কিংবা
রাজশাহী নিউ মার্কেটের আফসার ইলেকট্রনিকস থেকে
বানিয়ে নেওয়া অনেক ক্যাসেট।
কিন্তু প্রতিবারই দুজনের বানানো সেই ক্যাসেটটি
চলে আসে নতুন ঠিকানায়
হাত ধরে অবমুক্তির আদেশের
যেভাবে বাধ্য হয়ে সব ছেড়ে আসা মায়ের সাথে
রয়ে যায় কোলের সন্তান: ওরে আমার লক্ষ্মীসোনা!
জীবন তারপরও তো সুবীর সেন: ‘এ জীবনে সবই যে হারায়...’
তো টেপ রেকর্ডারটি থাকলেও
সকলের অগোচরে বুকের ধনের সমান সেই ক্যাসেটটি
চলে গেছে নিরুদ্দেশে ফেলে রেখে তার
ভালোবাসার উঠোন যেভাবে সূর্যকে না জানিয়ে
নিখোঁজ হয়ে যান মধু মামা সশস্ত্র জোছনার রাতে—
ফিরে আসেননি আর জায়নামাজ বিছিয়ে
অপেক্ষায় থাকা বাড়িতে: হে আল্লাহ, তুমি আমার মধুকে ফিরিয়ে দাও!
জানি না কী মনে করে ভাতিজা নাহিদ সেই টেপ রেকর্ডারটি
রেখে দিয়েছে বৈঠকঘরের এককোণে যেভাবে
শীতলক্ষ্যার গন্ধজলে সংরক্ষিত আছে কিছু মসলিন দিন—
পদ্মার চরে দুপুরে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে কিছু চম্পাবতী রাত:
‘ও রে আমার নামটি চম্পাবতী বাবু—বাড়ি পদ্মাপার...’
কে বাজাবে? নাহিদ কি জানে—
সেলুলয়েডের কোনো ফিতা ছাড়াই ওই টেপ রেকর্ডার
ধারণ করে আছে তরুণ এক অফিসারের
অজস্র প্রেমময় অনুভব যেভাবে জলের এমবোস ছবি হয়ে
নীলনদের জলে বাঁধা পড়ে আছে
নেফারতিতির কত সোনালি অনুরাগের সকাল
রাঙা অভিমানের সাঁঝ আর সাদাকালো মিলনের রাত!
কৈশোরকে হটিয়ে যৌবনের সিংহাসন দখলের মতো আজ
টেপ রেকর্ডারের স্থান নিয়েছে ইউটিউব যুক্ত সেলফোন;
আর নার্গিস-মলি-পপি-কাকলী সবাইকে টা টা দিয়ে
অন্তরঙ্গতার সবখানি উঠোন রেজিস্ট্রি করে নিয়েছেন
গৌড়ীয় ভূগোলের এক শেহেরজাদ—
টেবিলে সোনালি কাবিন, দরোজায় লেখা—
‘অতীত এবং পরকীয়ার প্রবেশ নিষেধ।’
তারপরও বাৎসরিক কোনো স্মৃতির সন্ধ্যায়
হারানো ক্যাসেটটি প্লে হয়ে যায়
উদাস হাওয়ার টেপ রেকর্ডারে: ‘দিয়ে গেনু বসন্তের এই গানখানি...’
এসইউ/