আরাকান আর্মির মাদক সন্ত্রাসের কবলে বাংলাদেশ

এএইচএম ফারুক মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংঘাত ও ক্ষমতার পটপরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য নতুন কোনো খবর নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই সংঘাতের আড়ালে যে ভয়াবহ \'মাদক সন্ত্রাস\' দানা বেঁধেছে, তা বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাখাইনের প্রায় ৮০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণকারী সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘আরাকান আর্মি’ (এএ) এখন তাদের সামরিক ব্যয় মেটাতে পুরোদস্তুর ঝুঁকেছে মাদক বাণিজ্যের দিকে। আর তাদের এই মাদক সাম্রাজ্যের প্রধান টার্গেট ও বাজার হয়ে উঠেছে প্রতিবেশী বাংলাদেশ। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, আরাকান আর্মির মাদক অর্থনীতি যদি এখনই কঠোরহস্তে দমন করা না যায়, তবে আগামী এক দশকে বাংলাদেশ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত এক দীর্ঘমেয়াদি বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে। যুদ্ধের রসদ যখন ‘মাদক’ ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত আরাকান আর্মি বর্তমানে মিয়ানমারের অন্যতম শক্তিশালী নন-স্টেট অ্যাক্টর। জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাদের অভাবনীয় সাফল্যের পেছনে রয়েছে বিপুল অর্থের জোগান। আর এই অর্থের প্রধান উৎস—মাদক। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আরাকান আর্মি সরাসরি মাদক উৎপাদনের সাথে যুক্ত না থাকলেও,

আরাকান আর্মির মাদক সন্ত্রাসের কবলে বাংলাদেশ

এএইচএম ফারুক

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংঘাত ও ক্ষমতার পটপরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য নতুন কোনো খবর নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই সংঘাতের আড়ালে যে ভয়াবহ 'মাদক সন্ত্রাস' দানা বেঁধেছে, তা বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাখাইনের প্রায় ৮০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণকারী সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘আরাকান আর্মি’ (এএ) এখন তাদের সামরিক ব্যয় মেটাতে পুরোদস্তুর ঝুঁকেছে মাদক বাণিজ্যের দিকে। আর তাদের এই মাদক সাম্রাজ্যের প্রধান টার্গেট ও বাজার হয়ে উঠেছে প্রতিবেশী বাংলাদেশ।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, আরাকান আর্মির মাদক অর্থনীতি যদি এখনই কঠোরহস্তে দমন করা না যায়, তবে আগামী এক দশকে বাংলাদেশ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত এক দীর্ঘমেয়াদি বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে।

যুদ্ধের রসদ যখন ‘মাদক’

২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত আরাকান আর্মি বর্তমানে মিয়ানমারের অন্যতম শক্তিশালী নন-স্টেট অ্যাক্টর। জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাদের অভাবনীয় সাফল্যের পেছনে রয়েছে বিপুল অর্থের জোগান। আর এই অর্থের প্রধান উৎস—মাদক।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আরাকান আর্মি সরাসরি মাদক উৎপাদনের সাথে যুক্ত না থাকলেও, তারা একটি সুসংগঠিত ‘ট্যাক্সিং’ বা কর ব্যবস্থা চালু করেছে। মিয়ানমারের গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল ও শান রাজ্য থেকে আসা ইয়াবা ও ক্রিস্টাল মেথ (আইস) পাচারের রুটগুলোর নিয়ন্ত্রণ এখন তাদের হাতে। মাদক সিন্ডিকেটগুলোকে নিরাপত্তা দেওয়ার বিনিময়ে এবং ল্যাবগুলো থেকে তারা মোটা অংকের ‘সুরক্ষা কর’ আদায় করে। এটি তাদের জন্য একটি ‘উইন-উইন’ পরিস্থিতি—একদিকে আয় বাড়ছে, অন্যদিকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ঘনিষ্ঠ সিন্ডিকেটগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যাচ্ছে।

টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন: অরক্ষিত রুট ও নতুন কৌশল

বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ও সীমান্তের দুর্বলতাগুলো আরাকান আর্মির জন্য আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। টেকনাফ-কক্সবাজার রুট এখন ইয়াবার প্রধান ‘গেটওয়ে’ হিসেবে পরিচিত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী মাদক পাচারে তারা প্রধানত তিনটি পথ ব্যবহার করছে।

শুধু ইয়াবায় সীমাবদ্ধ নেই আরাকান আর্মির মাদক বাণিজ্য। এখন তারা উচ্চমাত্রার বিশুদ্ধ এবং ব্যয়বহুল মাদক ‘ক্রিস্টাল আইস’ বা মেথ ও লিকুইড ড্রাগ বাংলাদেশে পুশ করছে। তাদের কাছে ইয়াবার চেয়ে বহুগুণ লাভজনক এই মাদক দেশের যুবসমাজকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। এই ‘প্রোডাক্ট আপগ্রেডেশন’ আরাকান আর্মিকে আর্থিকভাবে আরও শক্তিশালী করে তুলছে। যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের সীমান্তে।

১. নাফ নদী ও জলসীমা। ২. টেকনাফ-হ্নীলা-হোয়াইক্যং এর পাহাড়ি রুট। ৩. সেন্টমার্টিন ও চট্টগ্রাম উপকূলঘেঁষা মেরিন রুট।

সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোকে এখন ‘লজিস্টিক হাব’ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ক্যাম্পের দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং মিয়ানমারে ফেরার অনিশ্চয়তাকে পুঁজি করে আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের মাদক পরিবহনে বা ‘বাহক’ হিসেবে ব্যবহার করছে।

ইয়াবার পর এবার ‘ক্রিস্টাল আইস’ বা মেথ

শুধু ইয়াবায় সীমাবদ্ধ নেই আরাকান আর্মির মাদক বাণিজ্য। এখন তারা উচ্চমাত্রার বিশুদ্ধ এবং ব্যয়বহুল মাদক ‘ক্রিস্টাল আইস’ বা মেথ ও লিকুইড ড্রাগ বাংলাদেশে পুশ করছে। তাদের কাছে ইয়াবার চেয়ে বহুগুণ লাভজনক এই মাদক দেশের যুবসমাজকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। এই ‘প্রোডাক্ট আপগ্রেডেশন’ আরাকান আর্মিকে আর্থিকভাবে আরও শক্তিশালী করে তুলছে। যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের সীমান্তে।

উদ্ধারের সামান্য নমুনা

মাদকের অন্যতম রুট কক্সবাজারের টেকনাফ অঞ্চল। সেখানে নিয়োজিত আছে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) টেকনাফ ব্যাটালিয়ন। এ বিষয়ে কথা বলেছিলাম অধিনায়ক লে. কর্নেল আশিকুর রহমান-এর সাথে। তিনি জানান ২০২০ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত সর্বমোট ৩ কোটি ৫৮ লাখ ৯৫ হাজার ২১৭ পিস ইয়াবা ট্যাবেলট এবং ১শ ৪৯ দশমিক ৯৩৩৮ কেজি ক্রিস্টাল মেথ আইস জব্দ করা হয়েছে। যার সিজার মূল্য মোট ১৮২৬ কোটি ৫২ লাখ ৫৫ হাজার ১০০ টাকা। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে ২ হাজার ৭৫৫ টি এবং আসামী-১ হাজার ৯৭৫ জন।

বাংলাদেশের ওপর বহুমুখী বিপর্যয়ের আশঙ্কা

নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, আরাকান আর্মির এই মাদক সন্ত্রাস বাংলাদেশের ওপর চারটি প্রধান নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

১. সামাজিক ও জনস্বাস্থ্য: দেশের বিশাল যুবগোষ্ঠী মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। যা ভবিষ্যৎ মানবসম্পদকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। বাড়ছে পারিবারিক সহিংসতা, চুরি, ছিনতাই ও খুনের মতো অপরাধ।

২. অর্থনৈতিক রক্তক্ষরণ: মাদক কেনার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ পুঁজি বা ক্যাপিটাল মিয়ানমারে পাচার হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে কালো টাকার বিশাল অর্থনীতি, যা দেশের অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর।

৩. জাতীয় নিরাপত্তা ও ক্রাইম-টেরর নেক্সাস: মাদক বিক্রির টাকায় আরাকান আর্মি অত্যাধুনিক অস্ত্র কিনছে। সীমান্তে তাদের শক্তি বৃদ্ধি মানেই বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকি। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সাথে তাদের যোগাযোগের খবর অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।

৪. কূটনৈতিক ভাবমূর্তি: আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলাদেশকে ‘মাদক ট্রানজিট নেশন’ হিসেবে চিহ্নিত করার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, যা বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে পারে।

করণীয় ও সুপারিশ

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আগেই কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-

প্রযুক্তিগত নজরদারি: নাফ নদী ও উপকূলীয় এলাকায় ড্রোন এবং আধুনিক রাডার সিস্টেমের মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টা নজরদারি নিশ্চিত করা।

আন্তর্জাতিক চাপ: চীন, ভারত ও আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোকে সাথে নিয়ে আরাকান আর্মির মাদক নেটওয়ার্ক ভাঙার জন্য আঞ্চলিক কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা।

জিরো টলারেন্স: দেশের অভ্যন্তরে যারা এই মাদকের ডিলার বা সিন্ডিকেটের অংশ, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান পরিচালনা করা এবং তাদের অর্থের উৎস বন্ধ করা।

ক্যাম্পের নিরাপত্তা: রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো এবং মাদক সংশ্লিষ্টতায় জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করা।

আরাকান আর্মির মাদক সন্ত্রাস কেবল একটি সীমান্ত সমস্যা নয়, এটি বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও ভবিষ্যতের প্রশ্ন। এখনই এটি প্রতিরোধ করা না গেলে, এই ‘মাদক বোমা’ ভবিষ্যতে বাংলাদেশে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে।

লেখক: সাংবাদিক, লেখক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

[email protected]

এইচআর/জেআইএম

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow