সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার পাটলী ইউনিয়নের বনগাঁও গ্রামে আশ্রয়ণ প্রকল্পের সরকারি ঘর পেয়ে অনেক দরিদ্র পরিবার উপকৃত হলেও কিছু অনিয়ম ও অসংগতি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রকৃত গৃহহীন ও দুস্থদের জন্য বরাদ্দ এসব ঘরের একটি অংশ কৌশলে দখল করে নিয়েছেন এমন কিছু ব্যক্তি, যাদের আসলে ঘরের প্রয়োজন নেই। বরং তাদের নিজস্ব জমি ও বাড়িঘর রয়েছে।
ফলে বরাদ্দকৃত ঘর তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকছে, অনেকে পরিবার নিয়ে অন্যত্র বসবাস করছেন, কেউ কেউ বিদেশে রয়েছেন।
সরেজমিন দেখা গেছে, আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৬০টি ঘরের মধ্যে ৮ থেকে ১০টি ঘর বছরের পর বছর তালাবদ্ধ। ঘরগুলোর বারান্দা আবর্জনায় পরিপূর্ণ, দরজায় মাকড়সার জাল জমেছে। প্রকৃতপক্ষে যারা এই ঘর পেয়েছেন, তাদের কেউ কেউ অন্যত্র চলে গেছেন, কেউ বিদেশে আছেন, আবার কেউ কেউ নিজের জমিতে বাড়ি বানিয়ে সেখানে থাকছেন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, সরকারি বরাদ্দ পাওয়া এসব ঘরে প্রকৃত দুস্থরা থাকতে পারছেন না। প্রকল্পের বাসিন্দাদের মধ্যে ১৪ নম্বর ঘরের বরাদ্দপ্রাপ্ত নূর মোহাম্মদ এবং ১৮ নম্বর ঘরের সেলিম আহমেদ ওমানে রয়েছেন। তারা কখনোই প্রকল্পের ঘরে থাকেননি। ২৭ নম্বর ঘরের জামাল আহমেদ নিজের বরাদ্দকৃত ঘর অন্যকে দিয়ে দিয়েছেন। আশ্রয়ণের উদ্দেশ্য অনুযায়ী এসব ঘর দারিদ্র্যপীড়িত ও গৃহহীনদের দেওয়া হলেও বাস্তবে অনেকেই সেই ঘরে থাকেন না, বরং অন্যত্র চলে গেছেন।
এলাকার বাসিন্দা সুজন মিয়া বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৬০টি ঘরের মধ্যে বেশ কিছু ঘরে কেউ থাকেন না। কেউ কেউ বরাদ্দ পাওয়া ঘর বিক্রি করারও চেষ্টা করছেন। প্রকৃত দুস্থদের এই ঘরগুলো বরাদ্দ দেওয়া উচিত।
স্থানীয় জরিপ উল্লাহ পীর বলেন, এই প্রকল্পে অন্তত ৭ থেকে ৮টি ঘর বছরের পর বছর তালাবদ্ধ পড়ে আছে। এখানে যারা থাকেন, তারা খুবই দরিদ্র এবং দিনমজুর শ্রেণির মানুষ। আর যারা থাকেন না, তাদের নিজেদের বাড়িঘর ও জমি রয়েছে, এমনকি দুজন ব্যক্তি বিদেশেও অবস্থান করছেন। সরকার যদি এসব ঘর বাতিল করে প্রকৃত দুস্থদের দিত, তাহলে তা অনেকের উপকারে আসত।
স্থানীয় ফিরোজ আলী বলেন, যারা ঘরে আসেন না, তাদের বরাদ্দ বাতিল করে প্রকৃত অসহায় পরিবারকে দেওয়া উচিত। আরেক বাসিন্দা পরিমল কর মনে করেন, উপজেলা প্রশাসনের উচিত তদন্ত করে এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। তার মতে, আশপাশে এমন অনেক অসহায় পরিবার রয়েছে, যারা সরকারি ঘর পাওয়ার যোগ্য কিন্তু সুযোগ পাচ্ছে না।
এদিকে, ১৪ নম্বর ঘরের নূর মোহাম্মদের স্ত্রী শিলা বেগম বলেন, আমাদের নিজের জমি রয়েছে এবং আমার স্বামী বিদেশে থাকেন। সরকারের দেওয়া গুচ্ছগ্রামের ঘর আমাদের নামে বরাদ্দ হলেও আমরা বাড়িতেই থাকি। ১৮ নম্বর ঘরের সেলিম আহমেদের ছেলে শামিম আহমেদ বলেন, আমার বাবা ওমানে থাকেন, আমরা চাচার বাড়িতে থাকি। সরকারি ঘর হয়েছে, কিন্তু সেখানে যাওয়া হয়নি।
গুচ্ছগ্রামের প্রতিবেশী সুজন মিয়া বলেন, আমাদের গুচ্ছগ্রামে অনেকের ঘর তালাবদ্ধ পড়ে থাকে। ১৪ নম্বর ঘরের নূর মোহাম্মদ ও ১৮ নম্বর ঘরের সেলিম আহমেদ ওমানে থাকেন, ২৭ নম্বর ঘরের জামাল আহমেদ নিজের বরাদ্দকৃত ঘরে থাকেন না, বরং অন্য একজন সেখানে বসবাস করছে। এই ঘরগুলো সবসময় তালাবদ্ধ থাকে।
এ বিষয়ে জগন্নাথপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা বরকত উল্লাহ কালবেলাকে বলেন, আমরা এ বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেছি। যাদের নিজস্ব ঘর রয়েছে বা যারা বিদেশে অবস্থান করছেন, তাদের নোটিশ দেওয়া হবে। যদি দেখা যায়, তারা প্রকল্পের নিয়ম লঙ্ঘন করে ঘর বরাদ্দ নিয়েছেন, তাহলে তা বাতিল করে অন্য অসহায় ব্যক্তিদের দেওয়া হবে।
উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রিয়াদ বিন ইব্রাহিম ভূঞা সা-আধ বলেন, আমাদের কাছে এ বিষয়ে অভিযোগ এসেছে। আমরা তদন্ত করে সত্যতা নিশ্চিত হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। আমাদের কাছে অনেক অসহায় পরিবারের আবেদন রয়েছে, কিন্তু ঘর সংকটের কারণে তাদের দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। যদি অনিয়ম ধরা পড়ে, তাহলে এই ঘর বাতিল করে প্রকৃত দুস্থদের বরাদ্দ দেওয়া হবে।
সার্বিকভাবে, জগন্নাথপুর উপজেলার এই আশ্রয়ণ প্রকল্পের বেশ কিছু ঘর তালাবদ্ধ থাকায় প্রকৃত দুস্থরা আশ্রয় পাচ্ছেন না। বিদেশে থাকা ব্যক্তি বা নিজস্ব জমি থাকা ব্যক্তিদের সরকারি ঘর বরাদ্দ পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ রয়েছে। প্রশাসন যদি যথাযথ তদন্ত করে প্রকৃত সুবিধাভোগীদের হাতে ঘর তুলে দেয়, তাহলে এই অনিয়ম রোধ করা সম্ভব হবে।