সকাল নয়টা আর দশটার মাঝামাঝি। এত বেলা হয়ে যাওয়ার পরও আজ আর করিডোর ভেদ করে জানালার পর্দার ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে ঝলমলে সোনালি রোদ চোখে পড়ে অবন্তিকার ঘুম ভাঙেনি। কোনো এক রুমমেটের হাঁড়ি-পাতিলের টুংটাং আওয়াজ আর শুঁটকির কড়া গন্ধ নাকে পৌঁছে ঘুম ভেঙেছে। ঘুম ভাঙার পরেও সেই গন্ধ নাকে পৌঁছতে পারে। সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত নয়।
চোখ খুলেই প্রথম নজর পড়লো জানালার দিকে। নীল রঙের পর্দা ভেদ করে আলো গৃহে প্রবেশ করছে না। কেমন যেন অচেনা অন্ধকার ভাব। প্রতিদিন যে স্থানটি আলো ঝলমলে দেখে অভ্যস্ত; সে স্থানে এভাবে অন্ধকার। ব্যাপারটি অবন্তিকা মেনে নিতে পারছে না।
জানালার পাশেই করিডোরে তার ছোট ছোট পটে গাছ রাখা আছে। যদিও অল্প কয়েকটি। কিছু গাছের পট আবার জানালার গ্রিলের সাথে পাটের দড়ি দিয়ে বাঁধা। আজ এত অন্ধকার লাগছে কেন! গাছগুলোইবা কী অবস্থায় আছে! কৌতূহলবশত অবন্তিকা ঘরের মূল দরজাটা খুলে বাইরে গিয়ে একরকম বিস্ময়কর একটা ব্যাপারের সম্মুখীন হলো।
এত বড় বড় গাছ এখানে কে রেখেছে! অবন্তিকার গাছগুলোইবা কোথায়! ওখানে ছিল বড় একটি বালতিতে কাঠগোলাপ, সাদা জবা, কমলা রঙের রঙ্গন, অলকানন্দা, নয়নতারাসহ নাম না জানা ফুল এবং ফলের অনেক গাছ। এত খারাপ পরিস্থিতিতেও অবন্তিকা মেঝেতে পড়ে থাকা হলুদ রঙের আহত অলকানন্দা তুলে নিয়ে টেবিলের লকারে লুকিয়ে রাখা ডায়েরির ভাঁজে রেখেছে। ডায়েরির ভাঁজে অনেক শুকনো ফুল জমে আছে। কার জন্য রাখা হয়েছে, তা সে জানে না।
জীর্ণ ছোটখাটো বাগান। কিছুক্ষণ আগেই যেন এখানে ছোটখাটো ভূমিকম্প হয়েছিল। কোনোমতে গাছগুলো প্রাণে বেঁচে আছে। একে ছাদ বাগানও বলা যায় না। কারণ ওপরে তো খোলা আকাশ নেই। তবুও কেন যেন অবন্তিকার মনে হচ্ছে এ রকম জঙ্গল সে মিরপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেনে দেখেছিল। এখানের কাঠগোলাপ গাছটাও কোথাও একটা দেখেছিল। কোথায় যেন! কোথায়! ওহ, মনে পড়েছে। এটা তো চাঁদদের বারান্দার গাছটি।
চাঁদ হলো অবন্তিকার ছাত্রী। ওদের বারান্দায় বার্জারের সাদা রঙের বালতিতেই কাঠগোলাপ গাছটি দেখেছিল। গাছের গোড়ায় একটি ছোট পার্পল রঙের নয়নতারার গাছও ছিল। সেটাও তো এখানে বিদ্যমান। তবে সেই ধোলাইখাল পেরিয়ে লালমোহন সাহা স্ট্রিট হয়ে টিপু সুলতান রোডের কাছাকাছি সেই নয় তলার বাসার বারান্দা থেকে এখানে গাছটি কীভাবে এলো! উড়ে উড়ে এলো! কোনো উপায় তো নেই। অবন্তিকা ভেবেই নিলো, একরকম পট যে কারোর থাকতেই পারে। আর গাছও তো থাকতে পারে। কিন্তু এখানের একটা গাছও বেঁচে থাকবে না, যদি না এদের রোদে রাখা হয়। এটা প্রথম ভাববার বিষয়। পরবর্তী ভাববার বিষয় হলো যে, এই বড় গাছগুলো এখানে যে রেখেছে; সে বৃক্ষপ্রেমী অন্তত নয়।
অবন্তিকার ছোট পটের গাছগুলোকে সে দেওয়ালের দিকে চেপে রেখেছে গাদাগাদি করে। গাছের অবস্থা নাজেহাল। কয়েকটি গাছ হাত-পা ভেঙে গুরুতর আহত। ওদের অবস্থা দেখে অবন্তিকার কেঁদে ফেলার উপক্রম। মুখ দেখে বোঝা না গেলেও গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে অবন্তিকার বুকের মধ্যে কিছু হারিয়ে ফেলার শূন্যতা অনুভূত হচ্ছে। ক্রমান্বয়ে অনুভূতির প্রতিবিম্ব মুখেও কালো মেঘের মতো অন্ধকার হয়ে ফুটে উঠেছে। অবন্তিকা নিজেকে সামলাতে না পেরে কেঁদে ফেললো।
চারপাশ একদম জনশূন্য। অবন্তিকাকে সান্ত্বনা দিতেও কেউ আসছে না। গাছের জন্য কান্না করা এটা প্রথমবার নয়। এর আগেও সে গাছের জন্য কান্না করেছে। একবার তো বারান্দায় পানিতে কাঠি দিয়ে মিষ্টি আলু রেখেছিলো জেলির কাচের সেই ট্রান্সপারেন্ট পটে। মানে ওপরের কাগজটি তুলে সেই পটটাকে ট্রান্সপারেন্ট করা হয়েছে প্রথমে। কারণ ট্রান্সপারেন্ট পটে গাছ পানিতে রাখলে যে শেকড় বের হয়, সেই সাদা রঙের শেকড় দেখতে অবন্তিকার বেশ ভালো লাগে। পানি পরিবর্তন করার সময় অবন্তিকা শেকড়গুলো কেটে না ফেলে সেগুলো পরিষ্কার করে রাখে, যেন দেখতে সাদা লাগে।
ওভাবে মিষ্টি আলু রাখতে দেখে অবন্তিকার রুমমেট মুনিরা হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করেছিলো, ‘আপু ওকে ফাঁসি দেওয়ার মতো ঝুলায় রাখছেন কেন? ওর কী অপরাধ!’
অবন্তিকা হা হা করে অট্টহেসে উত্তর দিয়েছিলো, ‘ওর কোনো অপরাধ নেই রে! ওর থেকে সবুজ পাতা বের হবে। কিছুদিন পরে দেখো।’
সেই কাঠি দিয়ে ঝোলানো মিষ্টি আলু থেকে পাতা বেরিয়েছিল, শেকড়ও। প্রতিদিন রোদে পানি শুকিয়ে পটের অর্ধেক হয়ে যেত। অবন্তিকা সকালে আবার পটে পানি পূর্ণ করে দিতো। একদিন সকালে পটে পানি দিতে গিয়ে দেখলো সেখানে পটটি আর নেই। সাথে সাথে অবন্তিকা বারান্দা থেকে নিচের দিকে দেখার উদ্দেশ্যে ঘরে ওয়ারড্রবের ওপরে রাখা কালো ফ্রেমের চশমা নিয়ে কিছুক্ষণ নিছক চেষ্টা করেছে, নিচে কিছু দেখা যায় না কি তা বোঝার। কিন্তু কিছুই দেখা যায়নি। দশতলা থেকে কী আর নিচে কিছু স্পষ্ট দেখা যেতে পারে! সেদিন অবন্তিকা খুব কেঁদেছিল।
তখন রমজান মাস ছিল। ইফতারের আগে বিকেলের দিকে কথাটি অবন্তিকা তার বান্ধবী মালতীকে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলেছিলো। মালতির থেকেই জেনেছিল, ওভাবে পানিতে মিষ্টি আলু কাঠি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখলে সবুজ পাতা আসে। গাছ হয়। অবন্তিকার কথা শুনে মালতী জানালো, ‘তোর গাছে তো মাত্র পাতা আসছে, আমার গাছ গ্রিলে বাড়তে যাচ্ছিলো। এত বড় হইছিল। সেই গাছটিও বেঁধে না রাখার কারণে নিচে পড়ে গেছে। ভাগ্যিস কারোর মাথায় পড়েনি। আমি গাছটা না পেয়ে সাথে সাথে কান্না করে দিছি।’
মালতীর কথা শুনে অবন্তিকার কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়েছিল। উপলব্ধি করলো, মানুষের দুঃখ-কষ্ট শুনলে নিজের দুঃখ কমে। আজ অবন্তিকার সে কথা খুব মনে পড়ছে। ভাঙা গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে। আরও অনেক কথা মনে পড়ছে। লালমোহন সাহা স্ট্রিটের ইসকন মন্দিরের বিপরীত দিকের জীর্ণ দেওয়ালের পুরোনো সেই একতলা ভবনটির ছাদেও একটি কাঠগোলাপ গাছ আছে। সে গাছটি কীসের পটে লাগানো অবন্তিকা নিচে থেকে দেখে তা বুঝতে পারে না। তবে সে রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় জীর্ণ দেওয়ালের ওপরের দিকের বড় বড় সবুজ রঙের পাতাগুলো অবন্তিকার চোখকে সেদিকে আটকে রাখে। সে মোড়টি ক্রস করার আগে অবধি। অবন্তিকার জানতে ইচ্ছে করে সেই গাছটিতে কী রঙের ফুল হয়! একদিন অবশ্য রাস্তায় সাদা কাঠগোলাপ পড়ে থাকতে দেখেছে।
আজ আবার সেই পয়েনসেটিয়া গাছটির কথাও মনে পড়ছে। গাছটির নতুন পাতা এলে গোলাপি রঙের হয়। আস্তে আস্তে ম্যাচিউর হওয়ার সাথে সাথে পাতাগুলো সবুজ রঙের হয়ে যায়। গোলাপি পাতা আসার জন্য অবশ্যই গাছটিকে রোদে রাখা জরুরি। সবুজ আর গোলাপি রঙের পাতার কম্বিনেশনই ওই গাছের সৌন্দর্য। কিন্তু সে গাছটিও একদিন অবন্তিকাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। এরপর আর অবন্তিকা সে গাছ কিনে আনেনি।
আজ অবন্তিকার নিতু আপুকে খুব মনে পড়ছে। তার সাথেই প্রথম গাছ লাগানো শুরু করেছিল। করিডোরের জানালা থেকে বাংলাবাজার বালিকা বিদ্যালয়ের গায়ে ঘেঁষে থাকা ডাক অফিসটি পুরোপুরি দেখা যায়। পুনর্নির্মাণের উদ্দেশ্যে যখন অফিসটি ভাঙা হয়েছিল; তখন সেখান থেকে মাটি আনতে গিয়েছিলো অবন্তিকা আর নিতু। নিতু আপু গার্ড মামার সঙ্গে সে কী ভাব জমিয়েছিল মাটি আনার জন্য। ভূমিকম্প কবলিত বাগানের দিকে তাকিয়ে আজ অবন্তিকার স্মৃতিতে সেসব কথাবার্তা আনাগোনা করছে।
অবন্তিকার রুমের ঠিক সামনে মানে মুখোমুখি রুমটায় তার নিতু আপু থাকত। প্রায় দেড় বছর আগে সে চলে গেছে গ্রামের বাড়িতে। তার চলে যাওয়ার দু’দিন আগে অবন্তিকা খেয়াল করেছিলো, সে একা একা এখানে-সেখানে দাঁড়িয়ে কান্না করেছে। কিন্তু শতবার জিজ্ঞেস করার পরও কান্নার কারণ বলেনি। আজও তা রহস্য। নিতুকে অবন্তিকার নিজের বোনের মতো ভাবার একটা কারণ হলো, দুজনই গাছ পছন্দ করে। আরেকটা কারণ হলো, একবার অবন্তিকা তিন-চার দিন কী কারণে মনে নেই, হাসতেই পারেনি। মহাজাগতিক কোনো অদৃশ্য দুঃখ স্রোত তার হাসি কোথাও ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো। সেটা সে নিজেও খেয়াল করেনি। কয়েকদিন কেটে যাওয়ার পরে নিতু তাকে বললো, ‘অবন্তিকা আজ চারদিন পরে তোমাকে হাসতে দেখলাম, এত ভালো লাগছে আমার! কী হইছে তোমার, বলবা আমাকে!’
‘কী হইছে আমি তো তা নিজেও জানি না আপু।’
‘আচ্ছা তোমার জানতে হবে না। কিন্তু এভাবে গোমড়ামুখ করে থাইকো না প্লিজ! আমার দেখতে ভালো লাগে না।’
অবন্তিকা সেদিন হেসে জবাব দিয়েছিল, ‘আপু আপনি ব্যাপারটা খেয়াল করছেন এটাই আমার জন্য আনন্দের।’
নিতু চলে যাওয়ায় অবন্তিকা খুব কষ্ট পেয়েছিল। মাস চারেক আগে অবন্তিকার বিভাগের একজন নতুন জুনিয়র এসেছে তার নিতু আপুর সিটে। মেয়েটির নাম নীলা। মেয়েটি শান্ত স্বভাবের। এ কয়েকদিনেই অবন্তিকার মনে জায়গা করে নিয়েছে নিজের আচরণ দিয়ে। এমনিতে জুনিয়রদের পছন্দ করে না সে। কিন্তু নীলা অন্যরকম। হয়তো নিতু আপুর সিটে উঠেছে তাই। এটা অবন্তিকার ভাবনা। এভাবে গাদাগাদি করা এতগুলো গাছ এখানে দেখে হতবিহ্বল অবন্তিকার চোখে পড়লো, নীলা রুম থেকে বেরোচ্ছে। দুশ্চিন্তায় বিপর্যস্ত অবন্তিকা নীলাকে শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করলো, ‘এই গাছগুলো এখানে কে রেখেছে জানো?’
এ মুহূর্তে অবন্তিকা মোটেই শান্ত নয়। অশান্ত বিটখিটে ভাবটা কারোর সামনে প্রকাশ করলে যে কেউ তাকে অ্যাগ্রেসিভ ভাবতে পারে। এটা অবন্তিকা বুঝেছে অনেক ক্ষেত্রেই। কিন্তু আসলে সে একদমই অ্যাগ্রেসিভ নয়, কারোর প্রতিই নয়। তাই সে নিজের সাথে যুদ্ধ করে হলেও আচরণে মানুষ তার মনের অবস্থার ছিটেফোঁটাও বুঝবে না, এমন একটা ভঙ্গিতে সবার সাথে কথা বলার চেষ্টা করে। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। নীলা উত্তর দিলো, ‘আপু আমি তো একটু আগেই ঘুম থেকে উঠলাম। কে গাছ রেখেছে জানি না। তবে আমাদের রুমে নতুন মেয়ে এসেছে আজকে সকাল সকাল। হতে পারে, গাছগুলো ওই আপুটার।’
‘আচ্ছা যাও।’
অবন্তিকা ভাবলো আপুকে আমি কী বলবো! তাকে বলতে হবে, গাছগুলো একপাশে গুছিয়ে রাখতে। আমার গাছের জন্য স্পেস দিতে। গাছগুলো তো এখানে মরে যাবে। কারণ অবন্তিকা আগেও এখানে কাঠগোলাপ, লেবু গাছ, জবা গাছ, পয়েনসেটিয়া, নয়নতারা এমনকি মরিচ গাছও ওখানে রেখেছিলো। কিছুদিন যাওয়ার পরে তাদের প্রাণ অদৃশ্যে মিলে গেল, থেকে গেল শুকনো কিছু ডাল। ব্যাপারটি অবন্তিকাকে জঘন্যভাবে ব্যথিত করেছে। গাছগুলোও এখানে টিকে থাকতে পারবে না। কারণ এখানে এ ধরনের গাছের বৃদ্ধি এমনকি বেঁচে থাকার মতোও পর্যাপ্ত সূর্যের আলো নেই।
অবন্তিকা এ মুহূর্তে ভাবছে, এভাবে গাদাগাদি করে গাছ রাখা মেয়েটি কি তার সিনিয়র হবে নাকি জুনিয়র। ব্যাচমেট হলে সব থেকে বেশি ভালো হয়। জুনিয়র হলে সমস্যা, জুনিয়রদের সাথে কোনো ব্যাপারে তর্ক-বিতর্ক করতে রীতিমতো ভয় লাগে। কোনো কিছু যদি এমন বলে ফেলে বেয়াদবী ধরনের। তাহলে সে কোনো উত্তর দিতে পারবে না। বরং অযথাই কষ্ট পাবে মনে মনে। যেটা সে চায় না। নীলার থেকে জেনেছে যে, মেয়েটি অবন্তিকার থেকেও সিনিয়র। এটা স্বস্তির ব্যাপার। সিনিয়র কথা শোনালেও সমস্যা নেই। অবন্তিকা হজম করতে পারবে, সে ভরসা তার আছে।
সেদিন সময়টা দুপুরের আগে নাকি বিকেল, তা বুঝতে পারছে না অবন্তিকা। নীলা মেয়েটিকে দেখিয়ে দিলো। অবন্তিকা প্রশ্ন করার সাহস পাচ্ছে না। কারণ কিছুদিন আগেই একটি খারাপ পরিস্থিতি ঘটেছে। সিনিয়র ব্যাচের ফেয়ারওয়েল প্রোগ্রামে ব্যক্তিগত কারণে অবন্তিকা অংশগ্রহণ করতে পারেনি। এ কারণবশত অবন্তিকাকে বিদায়প্রার্থী ব্যাচের শিক্ষার্থীরা একটু আড়চোখে দেখতে শুরু করেছে। অনুষ্ঠানের দিন দুপুরবেলা অবন্তিকা ঘরে বসে খাচ্ছিলো। তখন সিনিয়র একজন মেয়ে জোরে জোরে অবন্তিকা অবন্তিকা বলে চিৎকার করে তাকে ডাকছিলো। ডেকে ধমকের সুরে বললো, ‘এই গাছগুলো এখান থেকে সরাচ্ছো না কেন? তোমাদের রুমের সামনের কোণায় ছিল, তা-ই ঠিক ছিল। এখন প্রোগ্রাম শেষ করে নাচানাচি করে এসে সবগুলো এখানে বসে রেস্ট করবে। এগুলো তুমি মাঝখানে কেন রেখেছো, সরাও এগুলো!’
অবন্তিকার রাগে অথবা জেদে চিৎকার করতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান্তভাবে জবাব দিলো, ‘এগুলো আমি এখানে রাখিনি।’
মেয়েটি আরেকটু রাগানোর জন্য অবন্তিকাকে বললো, ‘এখন যদি আমি এগুলো ফেলে দেই!’
অবন্তিকা কোনো প্রকার তোয়াক্কা করছে না, তা বোঝানোর জন্য উত্তর দিলো, ‘হ্যাঁ, ফেলে দেন।’
প্রোগ্রামে ঝামেলা হতে পারে ভেবে অবন্তিকা নিজের গাছগুলো আগেই সরিয়ে রেখেছিলো। কিছু ঘরে আর কিছু অন্যান্য জানালার আশেপাশে। অবন্তিকা লক্ষ্য করলো সেদিন সারাদিন এবং রাত একটা নাগাদ, গাছগুলো কেউ ফেলে দেয় নাকি। ওই গাছ রাখার অংশে কেউ নাচ-গানের পরে রেস্ট নিতে আসে নাকি। কেউ তা করেনি। তখন অবন্তিকা বুঝলো, আসলে ব্যাপারটি অবন্তিকাকে কথা শোনানোর উপায়মাত্র। গাছের অজুহাতে কথা শোনানো। এই আর কি। আবার কথা শোনাবে সেই ভয়ে অবন্তিকা নতুন গাছ রাখা মেয়েটিকে কিছু বলতে সাহস পাচ্ছে না। অনেক ভেবেচিন্তে সে মেয়েটিকে প্রশ্ন করলো, ‘আপু গাছগুলো আপনার?’
প্রশ্নটা মেয়েটির ভালো লাগেনি। বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে উত্তর দিলো, ‘হ্যাঁ আমার! তো কী হইছে?’
‘কিছুই হয়নি, আপনি এখানে গাছ রাখার আগে আমার গাছগুলো তো সুন্দরভাবে রাখতে পারতেন আপু। এভাবে আমার গাছগুলো নষ্ট করে আবার প্রশ্ন করছেন কী হয়েছে!’
অবন্তিকার এভাবে কথায় মেয়েটি রেগে গেল, ‘জায়গাটি ফ্লোরের সবার। যে কেউ ইচ্ছে হলেই এখানে যা খুশি রাখতে পারে। তোমার গাছের প্রতি এত দরদ থাকলে নিজেদের বারান্দায় রাখো অথবা নিজেদের ঘরে। এখানে গাছ রাখলে যে কেউ এগুলো ভাঙবে অথবা যা খুশি করবে। তুমি কাউকে কথা শোনাতে পারবে না। আমি তোমার গাছ ভেঙেছি, ইচ্ছে হলে আবার ভাঙবো, তুমি এ নিয়ে কিছু বলতে পারবে না।’
অবন্তিকা রাগ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে বড় বড় চোখ করে ক্রোধান্বিত কণ্ঠে উত্তর দিলো, ‘আমি হাউজ টিউটরকে কমপ্লেইন করবো, আপনি এটা করতে পারেন না। আমাকে বললেই আমি স্পেস করে দিতাম গাছ রাখার জন্য।’
বেলা তখন দুটা বেজে পঞ্চাশ মিনিট। সাড়ে তিনটায় বাস। অবন্তিকা ইউনিভার্সিটি বাসে বাসায় যাবে। মিতাকে আগে বলে রেখেছিলো তাকে ডেকে দিতে। মিতা এসে অবন্তিকাকে ডাকছে, ঘুম থেকে তোলার উদ্দেশ্যে। ‘এই মিয়া কি বিড়বিড় করতাছো ঘুমের মধ্যে!’
এলোপাথাড়ি বিছানায় শায়িত অবন্তিকা হকচকিয়ে চোখ খুলে দেখলো মিতা তার সামনে বসে আছে। এ মুহূর্তে মিতাকে তার মনে হচ্ছে সেই ডাইনি মেয়েটির মতো। যার সাথে এতক্ষণ বাকবিতণ্ডায় মত্ত ছিল। চোখ মুছতে মুছতে নিশ্চিত হলো এটা মিতা। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে দৌড়ে চলে গেল করিডোরে। তীব্র হৃৎস্পন্দন হচ্ছে। ঘুমের মধ্যে ঘটে যাওয়া কোন্দলের রেশ এখনো কাটেনি। অবন্তিকার একটাই চিন্তা, গাছগুলো ঠিক আছে তো।
করিডোরে গিয়ে দেখলো সবকিছু ঠিকঠাক। যেমন দেখে ঘুমিয়েছিল তেমনই আছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে অবন্তিকা সবকিছু মনে করার চেষ্টা করছে। কী ঘটেছে একটু আগে! বাতাসে ভেসে আসা বুড়িগঙ্গার কিঞ্চিৎ চাপা গন্ধ আর রোদের ঝলকানিতে অবন্তিকার উপলব্ধি হলো, এতক্ষণ যা কিছু ঘটছিল তা বাস্তব নয়, স্বপ্ন। অবন্তিকার বিছানায় একটা সবুজ রঙের ডায়েরি রাখা আছে। ডায়েরিটা খোলা। খোলা পৃষ্ঠার ওপরে লেখা, ‘প্লান্টোফাইল’। তারপর ‘প্রিয় আগন্তুক’ লিখে কমা দেওয়া। তারপর আর মিতা পড়তে পারেনি। অবন্তিকা চলে এসেছে। এসে দাঁড়িয়ে থেকেই মিতাকে বললো, ‘ডায়েরিটা দাও।’ তার মধ্যে কালো কালির বলপেনও ছিল। বলপেনটা নিয়ে চিঠির পৃষ্ঠাটা উল্টিয়ে পরের পৃষ্ঠায় অবন্তিকা লিখলো, ‘অ্যাম আই রিয়েলি আ প্লান্টোফাইল? না হলে বৃক্ষ দুর্যোগ স্বপ্নে দ্যাখে কেউ!’ ডায়েরিটা বিছানায় রেখে ঘোর কাটানোর উদ্দেশ্যে ফ্রেশ হতে যাবে, এমন সময় মিতাকে এতক্ষণ ঘটে যাওয়া অবাস্তব ঘটনাপ্রবাহ ব্যাখ্যা করলো। ‘আর বলিও না মিতা, দিনের বেলা ঘুমাইলেই এমন হয়, ঘুমাইলাম এক ঘণ্টা, মনে হচ্ছে তিন দিন পর্যন্ত একটানা ঘুমাচ্ছি, আর স্বপ্নে দেখে ফেলছি গত দুই বছরের সব ইতিহাস।’ বলতে বলতে অবন্তিকা ফ্রেশ হতে চলে যায়।
মিতা অবন্তিকার অবর্তমানে চিঠিটি পড়ছে। যেখানে লেখা ছিল:
‘প্রিয় আগন্তুক,
এখন চন্দ্রালোকিত মধ্যরাত, নিস্তব্ধতার চাদরে ঢেকে গেছে চারদিক। জানতে ইচ্ছে করছে তুমি ঘুমাচ্ছো নাকি জেগে আছো। তবে তা জানার কোনো উপায় নেই। কারণ আমি জানি না তুমি কে, অচেনাকে চিঠি লেখা নেশা হয়ে গেছে আজকাল। ভেবে নিচ্ছি তুমি জেগে আছো, কোনো জানালার গ্রিল ধরে বাইরে তাকিয়ে চাঁদ দেখছো। করিডোরের জানালা দিয়ে পূর্ণ চাঁদ দেখা যাচ্ছে। চাঁদের আলোতে গাছগুলো লাজুক ভঙিতে ঝিরিঝিরি হাওয়ার ইশারায় সামান্য নড়ছে। এই আবহাওয়া আমাকে ডায়েরি অবধি টেনে এনেছে। এখন না ঘুমালে সকালে ক্লাসে ঘুম পাবে। তবুও তোমায় লিখতে খুব ইচ্ছে করছে। বেশ কিছুদিন ব্যস্ততায় তোমায় লেখা হচ্ছে না। কিন্তু তুমি সারাক্ষণ আমার সঙ্গেই জড়িয়ে থাক। প্রতিটি ক্ষণে আমার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা আমি সন্তর্পণে তোমায় জানিয়ে দিই। কখনো আকাশের সঙ্গে কথা বলে, কখনোবা নদীর সঙ্গে, অথবা গভীর রাতের ঝিরিঝিরি বাতাসের সঙ্গেও উড়িয়ে দিই আমার কথা তোমার ঠিকানায়। তবে আমি অনিশ্চিত সে কথাগুলো আদৌ তুমি অবধি পৌঁছে কি না! তবুও পাঠাই, আত্মতুষ্টির উদ্দেশ্যে।
কিছুদিন যাবত একটা নতুন শব্দ আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে শব্দটি মানুষ শুনলে হাসবে। তাই তোমাকে লিখছি। যে গান অথবা মিউজিক পছন্দ করে; সে যদি মেলোফাইল হয়। যে সিনেমা পছন্দ করে; সে যদি সিনেফাইল হয়। যে মহাকাশ পছন্দ করে; সে যদি অ্যাস্ট্রোফাইল হয়। তাহলে যে গাছ লাগাতে অথবা প্লান্টিং পছন্দ করে; সে প্লান্টোফাইল হবে না কেন! সে নিশ্চয়ই প্লান্টোফাইল, বলো! তুমি যদি একবার আমার সাথে একমত হতে। তাহলে শব্দটাকে আমার পুরোপুরি যৌক্তিক এবং সঠিক মনে হতো। পরের শুক্রবার যদি অঝোরে বৃষ্টি হয়, তাহলে আমি ভেবে নেব তুমি আমার সাঙ্গে মত পোষণ করেছো।
তোমাকে আরও কিছু বলার আছে, তুমি কিন্তু আমার গাছের প্রতি বিরক্ত হবে না কখনো। গাছের সঙ্গে কাটানো সময় নিয়ে হিংসাও করবে না। আমি অসুস্থ হলে তুমি গাছের যত্ন নেবে। আমাদের ঘরে দুটি প্রশস্ত জানালা থাকবে, একটি জানালার সাথে লেগে থাকবে আমার পড়ার টেবিল আর সাথে বইয়ের সেলফ। সে সেলফে শরৎচন্দ্রের পরিণীতা বইটি অবশ্যই থাকবে। পরিণীতা উপন্যাসের শেখর আর ললিতা দুটি চরিত্রই আমার ভীষণ পছন্দের। অন্যদিকে একটি গাছের সেলফ থাকবে। সেখানে স্নেকপ্লান্ট, মানিপ্লান্ট, ক্যালাডিয়াম, জেব্রিনা, ভেরিগেটেড লাকি বাম্বোসহ আরও অনেক ইনডোর প্লান্ট থাকবে। সবুজ আর সাদা রঙের কম্বিনেশনে হওয়া স্পাইডার প্লান্টও থাকবে।
পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে পড়লে আমি বিনোদন স্বরূপ গাছের দিকে তাকিয়ে থাকবো কিছুক্ষণ। তারপর ওদের একটু যত্ন নিয়ে নিজেকে শান্ত করবো। আমার মাঝেমধ্যে খুব চিন্তা হয় জানো! আমার যখন বাচ্চা-কাচ্চা হবে; তখন আমি বাচ্চার যত্ন নেবো নাকি গাছের! ভেবেচিন্তে একটি বিষয় ঠিক করেছি। আমি আমার বাচ্চাকে কথা বলা শেখানোর সাথে সাথে গাছের যত্ন নেওয়া শেখাবো। তাকে জানতে হবে, পৃথিবীতে গাছপালা আছে বলেই আছে মানবপ্রাণের অস্তিত্ব। আল্লাহ একটিকে আরেকটির পরিপূরক হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। গাছ কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ না করলে পৃথিবী বিষাক্ত হয়ে যেত! অক্সিজেনের অভাবে ক্রমান্বয়ে প্রাণীর অস্তিত্ব হয়ে যেত বিলীন। আজ আর লিখছি না। তুমি যেখানেই আছো, অনেক ভালো থেকো।’
এ লেখার পরের পৃষ্ঠায়ই অবন্তিকা লিখেছে, ‘অ্যাম আই রিয়েলি আ প্লান্টোফাইল?’ মিতার লেখাটি পড়া শেষ হতে না হতেই অবন্তিকা ঘরে প্রবেশ করে। মিতার হাতে ডায়েরিটা দেখতে পেয়ে প্রচণ্ডভাবে রেগে যায়। অগ্নিস্ফূলিঙ্গের মতো অক্ষিযুগলে মিতার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে ওঠে, ‘মিতা!’ সাথে সাথে মিতার হাত থেকে ডায়েরিটা মেঝেতে পড়ে যায়। অবন্তিকা হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে ডায়েরিটা মেঝে থেকে তুলে অত্যন্ত রাগী কণ্ঠে মিতাকে বলে, ‘অন্যের ব্যক্তিগত ডায়েরি কেন ধরেছো তুমি? ইউ কান্ট ডু দিস মিতা।’
লেখক: শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
এসইউ/এএসএম