বর্তমান প্রযুক্তির যুগে ইঞ্জিনিয়ারিং টেকনোলজির মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শাখা হচ্ছে ইলেকট্রনিক। আধুনিক জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে স্মার্টফোন, কম্পিউটার, চিকিৎসা যন্ত্রপাতি, স্যাটেলাইট, রোবটিক্স। এসব প্রযুক্তিতে ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারদের আছে অমূল্য অবদান। তাই সময়ের সঙ্গে বিশ্বজুড়ে বাড়ছে এ টেকনোলজির ইঞ্জিনিয়ারদের চাহিদা। কিন্তু অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে—ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং আসলে কী? এ টেকনোলজির কাজ কী? এ বিষয়ে ডিগ্রি অর্জনের পর শিক্ষার্থীর ক্যারিয়ার কেমন হতে পারে? এ ছাড়া আরও অনেক প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খায়। সেসব নিয়েই আজকের আয়োজন—
ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং কী?
ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং এমন একটি শাখা, যা বিদ্যুৎ, বৈদ্যুতিন সংকেত এবং বিভিন্ন ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও সিস্টেম তৈরি এবং উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ট্রানজিস্টর, ডায়োড, রেজিস্টর, ক্যাপাসিটর, ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট এবং মাইক্রোপ্রসেসরের মতো উপাদান ব্যবহার করে বৈদ্যুতিক সার্কিট ডিজাইন ও বিশ্লেষণ করাই এ টেকনোলজির মূল ভিত্তি। ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়াররা নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং বিদ্যমান প্রযুক্তিকে আরও দক্ষ ও কার্যকর করে তোলার জন্য কাজ করেন। সব মিলিয়ে বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তিনির্ভর সমাজ গড়তে এ টেকনোলজির গুরুত্ব অপরিসীম।
যেসব বিষয়ে পড়ানো হয়
ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং একটি অত্যন্ত বিস্তৃত ও প্রযুক্তিনির্ভর শাখা, যেখানে বৈদ্যুতিক সার্কিট, যন্ত্রপাতি, কম্পিউটার সিস্টেমসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়। এ শাখায় পড়ানো হয় এমন বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো:
১. ইলেকট্রনিক সার্কিট
২. অ্যানালগ সিগন্যাল প্রক্রিয়াকরণ
৩. ডিজিটাল ইলেকট্রনিক
৪. মাইক্রোপ্রসেসর এবং মাইক্রোকন্ট্রোলার
৫. পাওয়ার ইলেকট্রনিক্স
৬. অডিও এবং ভিডিও সিগন্যাল প্রক্রিয়াকরণ
৭. কমিউনিকেশন সিস্টেম
৮. নেটওয়ার্কিং এবং কন্ট্রোল সিস্টেম
৯. ইলেকট্রনিক টেস্টিং এবং মেজারমেন্ট
১০. এমবেডেড সিস্টেম
১১. রোবোটিক্স
১২. পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তি।
ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ভবিষ্যৎ কেমন?
আধুনিক জীবনযাত্রা, শিল্প, স্বাস্থ্যসেবা, যোগাযোগ এবং শিক্ষা ব্যবস্থায় ইলেকট্রনিক প্রযুক্তির অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অনস্বীকার্য। বিশ্বের প্রতিটি উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে এ খাতের পরিধি ও চাহিদা দ্রুত বাড়ছে এবং ভবিষ্যতে এ চাহিদা আরও বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে।
ইলেকট্রনিক প্রযুক্তি খুবই প্রয়োজনীয় ও চাহিদাসম্পন্ন পেশা, যা ছাড়া পুরো বিশ্বই অসচল। এ কারণে এ পেশার ভবিষ্যৎকে বলা যায় অত্যন্ত উজ্জ্বল ও সম্ভাবনাময়। ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়াররা শুধু প্রযুক্তি খাতে নয় বরং মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নেও ভূমিকা রাখতে সক্ষম। সব মিলিয়ে বলা যায়, আগামী দিনে ইলেকট্রনিক প্রযুক্তি হবে বিশ্ব পরিবর্তনের অন্যতম চালিকাশক্তি। এর মাধ্যমে গড়ে উঠবে একটি আধুনিক, টেকসই ও প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্ব।
ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারের কর্মসংস্থান
বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারদের কর্মসংস্থানও বাড়ছে। একজন দক্ষ ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার টেলিযোগাযোগ, চিকিৎসা সরঞ্জাম উৎপাদন, অটোমেশন শিল্প, উপগ্রহ প্রযুক্তি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত, তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এবং ইলেকট্রনিক্স পণ্যের উৎপাদন ও রক্ষণাবেক্ষণ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন খাতে কাজ করার সুযোগ পান।
বর্তমান যুগে স্মার্ট ডিভাইস, ইন্টারনেট অব থিংস, রোবটিক্স এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো আধুনিক প্রযুক্তির বিকাশে ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারদের ভূমিকা অপরিসীম। এ প্রযুক্তিগুলোর পেছনে থাকা জটিল ডিজাইন, সেন্সর সিস্টেম, সিগন্যাল প্রসেসিং এবং হার্ডওয়্যার নির্মাণে তাদের অবদান গুরুত্বপূর্ণ।
আরও পড়ুন
সরকারির পাশাপাশি বেসরকারিতেও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য আছে বিশাল কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। এ ছাড়া উন্নত দেশগুলোতে দক্ষ ও আধুনিক প্রযুক্তিতে পারদর্শী ইঞ্জিনিয়ারদের কদর অনেক বেশি। এদিকে তরুণ ইঞ্জিনিয়াররা উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছেন এবং নতুন নতুন উদ্ভাবনী প্রযুক্তির মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টির পথ তৈরি করছেন। সব মিলিয়ে বলা যায়, এ টেকনোলজির কর্মসংস্থানের সুযোগ দিন দিন বাড়ছে।
সরকারি চাকরি
১. বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন
২. বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড
৩. বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন
৪. বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ
৫. বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ
৬. বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট
৭. ইউটিলিটি প্রতিষ্ঠান
৮. ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়
৯. বাংলাদেশ রেলওয়ে।
বেসরকারি চাকরি
১. ইলেকট্রনিক্স পণ্য উৎপাদন ও রিসার্চ প্রতিষ্ঠান: এ সেক্টরে মূলত সার্কিট ডিজাইন, পিসিবি অ্যাসেম্বলি, পণ্য উন্নয়ন ও গবেষণামূলক কাজ হয়।
২. টেলিকমিউনিকেশন সেক্টর: এখানে নেটওয়ার্ক ইঞ্জিনিয়ারিং, ট্রান্সমিশন ও অপারেশন্সের কাজ করা হয়।
৩. স্মার্ট প্রযুক্তি: এখানে নতুন প্রযুক্তির ডিভাইস, স্মার্ট হোম সলিউশন ও অটোমেশন প্রজেক্ট নিয়ে কাজ হয়।
৪. ইন্ডাস্ট্রিয়াল অটোমেশন ও পাওয়ার ইলেকট্রনিক্স: কারখানার স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি, পিএলসি বা এসসিএডিএ সিস্টেম ও বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কাজ হয়।
৫. ইলেকট্রনিক্স সার্ভিসিং ও টেকনিক্যাল সাপোর্ট প্রতিষ্ঠান: এ প্রতিষ্ঠানগুলো হোম অ্যাপ্লায়েন্স, অফিস ইক্যুইপমেন্ট এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল যন্ত্রপাতি সার্ভিস দিয়ে থাকে।
অন্য ক্যারিয়ার
প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারি-বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতার মাধ্যমে ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ আছে। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন কারিগরি ট্রেনিং সেন্টারেও চাকরি করতে পারবেন। শুধু তা-ই নয়, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশেও চাকরি সুযোগ আছে। ভালো দক্ষতা, হাতেকলমে অভিজ্ঞতা এবং কমিউনিকেশন স্কিল থাকলে খুব সহজেই এ টেকনোলজি নিয়ে ভালো ক্যারিয়ার গড়া সম্ভব।
কারা পড়বেন
যারা প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে ভালোবাসেন এবং বিভিন্ন ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি কীভাবে কাজ করে তা জানতে আগ্রহী; তাদের জন্য ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং। যাদের গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানে ভালো দক্ষতা আছে এবং যুক্তিভিত্তিক চিন্তা করতে পছন্দ করেন। এ ছাড়া নতুন কিছু উদ্ভাবনের আগ্রহ আছে, তাদের জন্য এ টেকনোলজি উপযুক্ত একটি বিষয়।
কোথায় পড়বেন
যদি ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার বা ডিপ্লোমা ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার হতে চান, তাহলে ৪ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং অথবা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৪ বছর মেয়াদি বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করতে হবে। ডিপ্লোমা ইন ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার পড়ার জন্য সরকারি ও বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট আছে। ডিপ্লোমা শেষে সরকারিভাবে ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (ডুয়েট) বিএসসি করার সুযোগ আছে। এ ছাড়া দেশের অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও বিএসসি করা যাবে।
এসইউ/এমএস