ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের টিকে থাকার কৌশল

2 months ago 13

একসময় হাতে ধরা সার্কিট বোর্ড, চোখে স্বপ্ন, মনে ছিল বিদ্যুতের ভাষা বুঝে পৃথিবী বদলে দেওয়ার সাহস। কিন্তু সময় বদলেছে। এখন পৃথিবী কথা বলছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ভাষায়। মেশিন শিখছে, সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, এমনকি প্রযুক্তির দিকনির্দেশনাও দিচ্ছে। এ দ্রুত বদলে যাওয়া জগতে প্রশ্ন উঠছে—ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের জায়গা কোথায়? টিকে থাকার জন্য কি শুধু বইয়ের সূত্র আর প্রজেক্টের রিপোর্টই যথেষ্ট? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টাই আজ সময়ের দাবি।

হৃদন আহমেদ দীর্ঘ ৭ বছরের কর্মজীবনে শিক্ষকতা ছাড়াও ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। বর্তমানে মেসার্স পাওয়ার হাব প্রতিষ্ঠানে ইলেকট্রিক্যাল ডিজাইন ও সাবস্টেশন কনসালট্যান্ট হিসেবে কর্মরত। তার মতে, এআইয়ের যুগে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদেরও নতুন করে নিজেকে চিনতে ও গড়তে হবে। কী কৌশল, দক্ষতা ও মানসিকতা হলে এ যুগে সফল হওয়া যাবে—এসব বিষয় নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফিচার লেখক মোহাম্মদ সোহেল রানা—

জাগো নিউজ: ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে এআইয়ের দাপট কেমন?
হৃদন আহমেদ: একটা সময় ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার মানেই ছিল কেবল মোটর, জেনারেটর আর পাওয়ার ফ্যাক্টর নিয়ে ব্যস্ততা। সেই সময়ে ভাবতাম ভবিষ্যৎ শুধু তার, ফেইজ আর ভোল্টেজ ড্রপেরই খেলা। কিন্তু সময় বদলেছে। হঠাৎ এক ঝড় উঠে এলো, যার নাম আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই)। এর বাংলা হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। শুরুতে মনে হয়েছিল, এটা বুঝি শুধু রোবটের জগতে সীমাবদ্ধ থাকবে। কিন্তু না, এখন তা সাবস্টেশনের কন্ট্রোলরুম থেকে শুরু করে, বাসার ব্রেকার বোর্ড, এমনকি ট্রান্সফরমার ডিজাইনেও ঢুকে পড়েছে। এআই শুধু সফটওয়্যার ডেভেলপারদের বিষয় নয়। বর্তমানে এআই ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের কাজেও বিপ্লব এনে দিচ্ছে। লোড ফোরকাস্টিং, ফল্ট লোকেশন, স্মার্ট গ্রিড ম্যানেজমেন্ট—এসব ক্ষেত্রেই চলছে এআইয়ের অদৃশ্য কিন্তু কার্যকর দাপট।

জাগো নিউজ: এআইয়ের যুগে টিকে থাকতে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের করণীয় কী?
হৃদন আহমেদ: এআইকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। পরিবর্তন মানেই সুযোগ। কেবল সার্টিফিকেট দিয়ে আর চাকরি মেলে না। এখন প্রয়োজন বাস্তব অভিজ্ঞতা ও আধুনিক টেকনোলজির সঙ্গে নিজেকে আপডেট করা। একজন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারকে এখন শুধু মোটর কানেকশন বোঝা নয়; জানতে হবে পিএলসি, এসসিএডিএ, আইওটি, অটোকার্ড ইলেকট্রিক্যালের মতো ইন্ডাস্ট্রিয়াল টুলস। পাশাপাশি ইটিএপি, ম্যাটল্যাব বা সিমুলিংকের মতো সফটওয়্যারে দক্ষতা থাকলে তা আপনাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে।

ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ভবিষ্যৎ এখন ‘হ্যান্ডস-অন প্র্যাকটিক্যাল স্কিল’র ওপর দাঁড়িয়ে। সেইসঙ্গে দরকার কমিউনিকেশন ও টিমওয়ার্কের মতো সফট স্কিল। যা আপনাকে একজন টেকনিক্যাল লিডার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে। এআইয়ের যুগে টিকে থাকতে চাইলে আপনাকে হতে হবে ‘টেক-স্মার্ট’ ও ‘ভ্যালু-ক্রিয়েটর’। তা করতে হলে কী কী লাগবে, চলুন একঝলকে দেখে নিই—
১. ব্যক্তিগত প্রজেক্ট তৈরি করুন, নিজে ডিজাইন করুন ছোট আকারের স্মার্ট বাস সিস্টেম, লোড শিফটিং সার্কিট বা স্মার্ট এনালাইজার।
২. ট্রেনিং করুন বিটাক, পাওয়ার হাব, এনার্জিপ্যাকের মতো জায়গায় হাতেকলমে কাজ শেখার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
৩. আপডেট থাকুন আইইইই বা ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং টাইমসের মতো জার্নাল পড়ুন।
৪. নেটওয়ার্ক তৈরি করুন, সেমিনারে অংশ নিন, লিঙ্কডইন ব্যবহার করুন, ফিল্ড এক্সপার্টদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন।

বিশ্বজুড়ে এখন যেসব প্রকৌশলী নেতৃত্ব দিচ্ছেন; তারা টেকনোলজি, সফট স্কিল ও ইনোভেশন—এ তিনটির মধ্যকার মেলবন্ধন তৈরিতে সফল। এআই শুধুই প্রতিযোগিতা নয়, এটি একটি সহযোগী টুল, যেটাকে কাজে লাগিয়ে আপনি সময় বাঁচাতে, ডেটা বিশ্লেষণ করতে এবং আরও নির্ভুল ডিজাইন তৈরি করতে পারবেন।

জাগো নিউজ: ভবিষ্যতে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের চাকরি ঝুঁকিতে পড়বে নাকি আরও দক্ষ করে তুলবে?
হৃদন আহমেদ: একজন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আজ আপনার সামনে অনেক রাস্তা খোলা। সেই রাস্তায় চলতে হলে লাগবে প্রযুক্তির গভীর জ্ঞান, বাস্তব অনুশীলন ও একটানা শেখার ইচ্ছা। একটা সময় লোড ক্যালকুলেশন, ক্যাবল সিলেকশন, ডিজাইন ড্রয়িং, প্রজেক্ট বাস্তবায়ন—সবই করেছি হাতেকলমে, ঘাম ঝরিয়ে। কিন্তু এখন এক ক্লিকেই সফটওয়্যার বলে দিচ্ছে, কত তারের প্রয়োজন, কোথায় ব্রেকার বসবে, কোন জায়গায় কী লোড আসতে পারে।

এতকিছুর পর প্রশ্ন দাঁড়ায়—ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়াররা ভবিষ্যতে ‘চাকরিহীন’ হয়ে যাব? না, মোটেও না। বরং আমার অভিজ্ঞতা বলে এআই আমাদের প্রতিস্থাপন নয় বরং সহযোগী হয়ে উঠছে। এআই আপনাকে হারাতে নয়, জিততে সাহায্য করবে, যদি আপনি প্রস্তুত থাকেন। যেসব কাজ একসময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নিয়ে করতাম, এখন এআই তা মুহূর্তেই করে দিচ্ছে। কিন্তু সিদ্ধান্ত তো আর এআই নিতে পারে না! একটা ভোল্টেজ স্যাগের পেছনে কারণ বোঝা, নিরাপত্তার সিদ্ধান্ত নেওয়া কিংবা মাঠ পর্যায়ে কাস্টমাইজড সমাধান বের করা এটা তো মানুষেরই কাজ।

তবে হ্যাঁ, একজন আধুনিক ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আপনাকে আর শুধু রেজিস্ট্যান্স আর ফ্রিকোয়েন্সি জানলেই চলবে না। এখন জানতে হবে পাইথন প্রোগ্রামিং, ডেটা অ্যানালাইসিস, অটোক্যাডে অটোমেশন, এমনকি পাওয়ার বিআই বা ম্যাটল্যাবে ডেটা বিশ্লেষণ। আমি নিজেও এখন নিয়মিত অনলাইন কোর্স করি, কোর্সেরা, ইউডেমি বা গুগলের এআই টুলস নিয়ে। আইইইই-এর পেপার পড়ি, ইউটিউবে প্রজেক্ট দেখি, আবার নিজেদের কাজেও নানা এআই ভিত্তিক সফটওয়্যার টেস্ট করি।

জাগো নিউজ: পড়াশোনার পাশাপাশি এআই ব্যবহার জানা কি জরুরি?
হৃদন আহমেদ: ইলেকট্রিক্যাল শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পাশাপাশি এআই ব্যবহার জানা জরুরি বলে মনে করছি। এআইকে ভয় না পেয়ে তাকে নিজের হাতিয়ার বানানোর চেষ্টা করতে হবে। এআই যদি ভবিষ্যতের ভাষা হয়, তাহলে আমাদের সেই ভাষায় কথা বলতে জানতে হবে। তাই ক্লাসের পড়ার পাশাপাশি এসব বিষয়ে জানতে হবে, শিখতে হবে। একই সঙ্গে নিজের মতো এআই দিয়ে প্রোজেক্ট তৈরি করার চেষ্টা করতে হবে। এককথায় ডিপ্লোমা শিক্ষার শুরু থেকেই এআইকে গুরুত্ব নিয়ে দেখতে হবে। ভবিষ্যতের জন্য ফেলে রাখলে চাকরির বাজারে আপনি পিছিয়ে পড়বেন।

যদি আমরা হাতেকলমে কাজ শিখে, এইআইকে বুঝে, বাস্তব অভিজ্ঞতাকে সামনে রেখে এগিয়ে চলতে পারি, তাহলে কোনো প্রযুক্তি আমাদের টপকাতে পারবে না। এআই কাজের ‘সহকারী’, প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। আজকের যুগে সবচেয়ে দামি জিনিস হলো সময় আর সিদ্ধান্ত। এআই সময় বাঁচায় আর আপনার অভিজ্ঞতা নেয় সঠিক সিদ্ধান্ত। এ দুইয়ের মেলবন্ধনেই গড়ে উঠবে আগামীর শ্রেষ্ঠ ইঞ্জিনিয়ারিং।

এসইউ/জেআইএম

Read Entire Article