ইসরায়েলের ভয়াবহ তাণ্ডব, স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন কি সম্ভব
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত নতুন এক মোড়ে দাঁড়িয়েছে। জেরুজালেমের পূর্বে মালে আদুমিম বসতিতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন—‘কোনও ফিলিস্তিন রাষ্ট্র থাকবে না, এই ভূমি আমাদের।’ বসতি সম্প্রসারণের জন্য তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষরও করেছেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী, বিতর্কিত ‘ই১’ এলাকায় ৩ হাজার ৪০০ নতুন বাড়ি তৈরি হবে। এতে পশ্চিম তীর বিভক্ত হয়ে পড়বে এবং পূর্ব জেরুজালেম থেকে বিচ্ছিন্ন হবে। অথচ ফিলিস্তিনিরা বহুদিন ধরে তাদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে দেখে আসছেন। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ১৯৬৭ সালের পর নির্মিত এসব বসতিই অবৈধ, কিন্তু ইসরায়েল বারবার তা অগ্রাহ্য করছে। এমন বাস্তবতা আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন উত্তেজনা তৈরি করেছে।
পশ্চিম তীরে বসতি সম্প্রসারণ
নেতানিয়াহুর বসতি সম্প্রসারণের চিন্তা ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনাকে শেষ করছে। কারণ ই১ এলাকার বসতি নির্মাণ পূর্ব জেরুজালেমকে পশ্চিম তীরের বাকী অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। এছাড়া আশপাশের ইসরায়েলি বসতিগুলোর সঙ্গে সংযোগ তৈরি হয়ে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড আরও সংকুচিত হবে। ফিলিস্তিনিরা পূর্ব জেরুজালেমকে ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে দেখেন। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, ১৯৬৭ সালের পর গড়ে ওঠা সব ইহুদি বসতি অবৈধ। কিন্তু নেতানিয়াহু দীর্ঘদিন ধরে অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে বসতি সম্প্রসারণের পক্ষে এবং শান্তি প্রচেষ্টার বিরোধী ছিলেন। ১৯৯০-এর দশকের অসলো চুক্তি এবং পরে বিভিন্ন শান্তি উদ্যোগে তিনি সরব বিরোধিতা করেছেন।
ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র নাবিল আবু রুদেইনা নেতানিয়াহুর পদক্ষেপকে ‘সমগ্র অঞ্চলকে গভীর সংকটে ঠেলে দেওয়া’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়নি এমন দেশগুলোকে তা দ্রুত করার আহ্বান জানান।
ইসরায়েলের দ্বৈত কৌশল
পশ্চিম তীরে বসতি সম্প্রসারণের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সহিংসতা আরও জোরালো হয়েছে। গাজা সিটিতে ইসরায়েলের ব্যাপক হামলায় সর্বশেষ ৬১ জন নিহত হয়েছেন। শহরের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ভোর থেকে টানা বোমাবর্ষণ চলছে। ট্যাংক, যুদ্ধবিমান ও নৌবাহিনী একযোগে অভিযানে যোগ দেওয়ায় অসংখ্য বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে। ইসরায়েলের চলমান যুদ্ধে এখন পর্যন্ত অন্তত ৬৫ হাজার ৬২ ফিলিস্তিনি নিহত এবং ১ লাখ ৬৫ হাজার ৬৯৭ জন আহত হয়েছেন। বহু মানুষ এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়ে আছেন। গাজা উপত্যকা দীর্ঘদিন ধরে খাদ্য, পানি, বিদ্যুৎ ও চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত। ইসরায়েলের ‘স্বেচ্ছায় অভিবাসন’ নীতিকে সমালোচকরা জাতিগত নিধনের আরেক রূপ হিসেবে দেখছেন।
এটিই জায়নিজমের সীমাহীন কৌশলের আসল চেহারা। এই যুদ্ধ দুই স্তম্ভে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমটি হলো গ্রেটার ইসরায়েল, যা সরাসরি ভূখণ্ড দখল ও বসতি নির্মাণের পরিকল্পনা; পশ্চিম তীর, গাজা, জর্ডান নদীর পূর্ব পর্যন্ত অঞ্চলকে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্য। দ্বিতীয়টি হলো গ্রেট ইসরায়েল, যা কূটনীতি, বাণিজ্য, গোয়েন্দা সহযোগিতা ও নিরাপত্তা চুক্তির মাধ্যমে আরব বিশ্বের সার্বভৌমত্ব হরণ করে। একদিকে জমি কেড়ে নেওয়া, অন্যদিকে রাজনৈতিক ও কৌশলগত সিদ্ধান্তের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল।
এই দ্বৈত কৌশল নতুন নয়; এর বীজ বপন হয়েছিল বহু আগে। ১৯২৩ সালে জেফ জাবোটিনস্কি তার দ্য আয়রন ওয়াল প্রবন্ধে স্পষ্ট করে লিখেছিলেন, জায়নিস্ট উপনিবেশায়ন সবসময় স্থানীয় জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হবে, এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান কোনো সমাধান নয়— লক্ষ্য হবে পূর্ণ দখল।
গাজার মানবিক বিপর্যয়
ইসরায়েলের সামরিক অভিযান ও হুমকির মুখে গাজা নগরী ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন প্রায় দুই লাখ ফিলিস্তিনি। গাজার ১০ লাখ বাসিন্দার মধ্যে এটি একটি বড় অংশ। স্থানীয়রা এলাকা ছেড়ে পালানোর সময় তীব্র মানসিক ও শারীরিক চাপের মধ্যে রয়েছেন। স্থানীয় বাসিন্দারা দুই বছর ধরে স্থায়ীভাবে কোথাও থাকতে পারছেন না, ঘুমাতে পারছেন না। এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় পালাতে হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর অনুমোদিত ‘ধাপে ধাপে’ গাজা দখল পরিকল্পনা করেছেন। পরিকল্পনার প্রথম ধাপে গাজা সিটি দখল, প্রায় এক মিলিয়ন বাসিন্দাকে দক্ষিণে সরিয়ে নেওয়া, শহর ঘেরাও এবং আবাসিক এলাকায় প্রবেশ অন্তর্ভুক্ত। দ্বিতীয় ধাপে কেন্দ্রীয় গাজার শরণার্থী শিবিরগুলো নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার কথা রয়েছে, যেগুলোর অনেকটাই ইতোমধ্যে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কিত এবং যুদ্ধবিরতি আনার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে আহ্বান জানিয়েছে।
জাতিসংঘের ভূমিকা
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গাজার ৮৭ শতাংশ এলাকা এরইমধ্যে ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে বা সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশের আওতায়। সংস্থাটি সতর্ক করে বলেছে, আরও সামরিক অগ্রগতি ‘বিপর্যয়কর পরিণতি’ ডেকে আনতে পারে।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একটি ঘোষণায় ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও ইসরায়েলের হামাসবিরোধী কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেছে। ঘোষণার পক্ষে ভোট পড়েছে ১৪২টি দেশ, বিপক্ষে মাত্র ১০টি, ১২টি দেশ বিরত ছিলেন।
এই প্রস্তাবে গাজায় বেসামরিক মানুষ ও স্থাপনার ওপর ইসরায়েলি হামলা, ভূখণ্ডের অবরোধ, এবং মানুষদের অনাহারে রাখার নিন্দা জানানো হয়েছে। ইসরায়েল এই প্রস্তাবকে একতরফা ও নাটক বলে অভিহিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রও এটি সময়োপযোগী বা কার্যকর উদ্যোগ হিসেবে দেখছে না।
ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর পদক্ষেপ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা কার্যত শেষ করার লক্ষ্যে নেওয়া হয়েছে। ফিলিস্তিনি জনগণ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই উদ্যোগকে শান্তি বিরোধী হিসেবে দেখছে। জাতিসংঘ, ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম ও মাল্টা প্রক্রিয়ায় সমর্থন জানাচ্ছে। কিন্তু ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র ও কিছু আরব দেশ এ উদ্যোগকে সমালোচনা করছে।
এদিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সমর্থন বৃদ্ধির ফলে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি অর্জনের রাজনৈতিক ভিত্তি শক্ত হচ্ছে। তবে ইসরায়েলি প্রতিক্রিয়ার কারণে বাস্তবায়ন এখনও কঠিন।
তথ্যসূত্র : আল জাজিরা, রয়টার্স