ইসলাম মানবাধিকার নিশ্চিত করতে বলে
ইসলাম শুধু ইবাদতনির্ভর একটি ধর্ম নয়। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা প্রদান করে। ইসলাম তার অনুসারীদের জীবনকে শুধু নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত কিংবা দাওয়াত ও তাবলিগের মাঝে সীমাবদ্ধ রাখেনি। বরং এই ধর্ম এমন এক পথ দেখায়, যা বিশ্বমানবতার শ্রেষ্ঠ আদর্শ—হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পথ। নবীজির জীবন ছিল এমন এক জীবন্ত আদর্শ, যেখানে ইবাদত ও মানবিক দায়িত্ববোধ একে অপরকে পরিপূরক করে গড়ে উঠেছিল। তিনি শুধু নামাজ-রোজার উপদেশ দেননি, বরং মানুষে মানুষে অধিকারবোধ, দায়িত্বশীলতা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের এক বাস্তব উদাহরণ উপস্থাপন করেছেন। তিনি মানবাধিকারের এমন এক ভারসাম্যপূর্ণ দর্শন দিয়েছেন, যেখানে ব্যক্তিগত ইবাদতের পাশাপাশি পারস্পরিক সম্পর্ক ও সামাজিক দায়বদ্ধতাও একই গুরুত্বে বিবেচিত হয়েছে। এই মহান দৃষ্টিভঙ্গি শুধু মুখের ভাষণে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি নিজের জীবনে তা বাস্তবায়ন করেছেন এবং সাহাবায়ে কেরামকেও এসব নৈতিক শিক্ষায় গড়ে তুলেছেন। তিনি তাদের শিখিয়েছেন—একজন প্রকৃত মুমিন শুধু নিজের পরিত্রাণে সচেষ্ট থা
ইসলাম শুধু ইবাদতনির্ভর একটি ধর্ম নয়। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা প্রদান করে। ইসলাম তার অনুসারীদের জীবনকে শুধু নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত কিংবা দাওয়াত ও তাবলিগের মাঝে সীমাবদ্ধ রাখেনি। বরং এই ধর্ম এমন এক পথ দেখায়, যা বিশ্বমানবতার শ্রেষ্ঠ আদর্শ—হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পথ। নবীজির জীবন ছিল এমন এক জীবন্ত আদর্শ, যেখানে ইবাদত ও মানবিক দায়িত্ববোধ একে অপরকে পরিপূরক করে গড়ে উঠেছিল। তিনি শুধু নামাজ-রোজার উপদেশ দেননি, বরং মানুষে মানুষে অধিকারবোধ, দায়িত্বশীলতা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের এক বাস্তব উদাহরণ উপস্থাপন করেছেন। তিনি মানবাধিকারের এমন এক ভারসাম্যপূর্ণ দর্শন দিয়েছেন, যেখানে ব্যক্তিগত ইবাদতের পাশাপাশি পারস্পরিক সম্পর্ক ও সামাজিক দায়বদ্ধতাও একই গুরুত্বে বিবেচিত হয়েছে।
এই মহান দৃষ্টিভঙ্গি শুধু মুখের ভাষণে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি নিজের জীবনে তা বাস্তবায়ন করেছেন এবং সাহাবায়ে কেরামকেও এসব নৈতিক শিক্ষায় গড়ে তুলেছেন। তিনি তাদের শিখিয়েছেন—একজন প্রকৃত মুমিন শুধু নিজের পরিত্রাণে সচেষ্ট থাকে না; বরং তার পাশের মানুষ, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র সবার কল্যাণ ও নিরাপত্তাও তার দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। এভাবেই ইসলাম একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও দায়িত্বশীল সমাজ বিনির্মাণের দিকে অগ্রসর হয়। যেখানে প্রতিটি ব্যক্তি অন্যের অধিকার রক্ষা করে, পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকে এবং একটি আদর্শ ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে সচেষ্ট হয়। নবীজির এ শিক্ষা আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। বরং আজকের বৈষম্যপূর্ণ পৃথিবীতে এ শিক্ষা আমাদের জন্য আরও অপরিহার্য। ইসলামে পুণ্যের যে সর্বাঙ্গীণ ধারণা দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে মানবসেবা, পারস্পরিক অধিকার, সামাজিক সহাবস্থান এবং জীবনযাত্রার আদর্শ পদ্ধতি। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘পুণ্য একমাত্র এই নয় যে, তোমরা নিজেদের মুখ কেবলা বা বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে ফেরাবে; বরং প্রকৃত পুণ্য এটাই যে, কেউ আল্লাহর প্রতি, কেয়ামতের দিনে, ফেরেশতাদের প্রতি, কিতাবের প্রতি ও নবীদের প্রতি ইমান আনবে এবং আল্লাহর মহব্বতে নিজের সম্পদ আত্মীয়স্বজন, এতিম, অভাবগ্রস্ত, মুসাফির, ভিক্ষুক এবং দাস মুক্তির কাজে ব্যয় করবে। যারা সালাত কায়েম করে, জাকাত দেয় এবং প্রতিশ্রুতি পূরণ করে, দুঃসময় ও সংকটে এবং জিহাদের সময় ধৈর্য ধরে—তারাই সত্যিকারের মুমিন এবং প্রকৃত পরহেজগার।’ (সুরা বাকারা: ১৭৭)।
একটি প্রশান্ত ও পরিতৃপ্ত জীবন গঠনের জন্য ইসলাম বারবার মানুষের অনুভূতি, সম্মান ও পারস্পরিক সহনশীলতার শিক্ষা দেয়। পাশাপাশি ইসলাম কঠোরভাবে নিষেধ করেছে এমন যে কোনো কাজ, যা মানুষের মনোভাবকে আঘাত করে বা ক্ষুদ্রতম কষ্ট দেয়। ইসলাম মানবতাকে কতটা উচ্চমর্যাদা দিয়েছে, তা এ থেকেই অনুমান করা যায় যে, ইসলাম তার অনুসারীদের জন্য প্রতিটি মানুষের নির্দিষ্ট অধিকার নির্ধারণ করেছে। যেমন—পিতা-মাতার অধিকার, সন্তানদের অধিকার, স্বামী-স্ত্রীর অধিকার, এতিমের অধিকার, অমুসলিমের অধিকার, প্রতিবেশীর অধিকার, মেহমানের অধিকার, মুসাফিরের অধিকার—অর্থাৎ, সবার জন্য পৃথক পৃথক অধিকার নির্ধারণ করে তাদের তা যথাযথভাবে পালন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
যদি মানুষ পরস্পরের অধিকার পালন না করে, তাহলে অবশ্যই দুনিয়ায় বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি সৃষ্টি হবে। যেমন—রাজা বা শাসক যদি নিজের দায়িত্ব যথাযথভাবে না পালন করে, তবে প্রজাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। স্বামী যদি স্ত্রীর অধিকার না দেয়, তাহলে স্ত্রীর জীবন দুনিয়ার জাহান্নামে পরিণত হবে। আর স্ত্রী যদি স্বামীর হক আদায় না করে, তবে স্বামীর জীবনের শান্তি বিনষ্ট হবে। প্রতিবেশীরা একে অপরের হক আদায় না করলে সমাজে ভালোবাসা ও শান্তির পরিবেশ নষ্ট হবে। একইভাবে মুসলমানরা যদি অমুসলিমদের অধিকার না মানে, তাহলে পৃথিবী ঘৃণা, বৈষম্য ও সংঘাতের অরণ্যে পরিণত হবে। ধনী যদি গরিবদের হক না দেয়, তাহলে গরিবরা অনাহারে দিন কাটাবে। ঠিক তেমনি, যদি পিতা-মাতা সন্তানের অধিকার না মানে, তাহলে সন্তান বিপথগামী, অবাধ্য ও অভিশাপস্বরূপ হয়ে উঠবে; আবার সন্তান যদি পিতা-মাতার হক আদায় না করে, তবে মা-বাবা বার্ধক্যে সহানুভূতি ও সান্ত্বনা পাবে না।
নবীজি (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘সেই ব্যক্তি পরিপূর্ণ মুমিন, যার দ্বারা মানুষ কষ্টপ্রাপ্ত না হয় এবং যার হাত ও জিহ্বা থেকে মানুষ নিরাপদ থাকে।’ (সহিহ বুখারি: ১০)। আরেক হাদিসে বলেন, ‘সর্বোত্তম মানুষ সে, যার দ্বারা অন্য মানুষ উপকৃত হয়।’ (মুজামু আউসাত, তাবরানি: ৫৭৮৭)। রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কোনো বিপদগ্রস্ত মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করে, আল্লাহতায়ালা কেয়ামতের দিনে তার দুঃখ-কষ্ট দূর করে দেবেন।’ আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসিবতে পতিত মানুষের জন্য সহজতা সৃষ্টি করে, আল্লাহ তার জন্য দুনিয়া ও আখিরাতের সহজতা সৃষ্টি করবেন। আল্লাহ সেই বান্দার সাহায্যে থাকেন, যে বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্যে নিয়োজিত থাকে।’ (সহিহ মুসলিম: ২৬৯৯)।
সারকথা হলো, এই পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলাই বিস্তৃত হবে এবং শান্তি কখনো টিকবে না। অতএব, শান্তি বজায় রাখতে হলে আবশ্যক যে, প্রত্যেক মানুষ অপরের প্রতি আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত অধিকারগুলো সঠিকভাবে পালন করে। এটাই ইসলামের মৌলিক শিক্ষা এবং নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রেরণার মূল উদ্দেশ্য। কোরআনি শিক্ষা থেকে দূরত্ব আজকের আমাদের বড় সংকট। আজ আমাদের মূল সংকট হলো, আমরা নিজেরাও কোরআনের শিক্ষার সঙ্গে যথাযথভাবে পরিচিত নই এবং বিশ্বমানবতাকে এ শিক্ষার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা আমরা যথার্থভাবে অনুভবও করছি না। অথচ ইসলাম যে পূর্ণাঙ্গ ও ভারসাম্যপূর্ণ মানবাধিকার-ব্যবস্থা দিয়েছে, তা পৃথিবীর অন্য কোনো ব্যবস্থায় তার ছিটেফোঁটাও পাওয়া যায় না।
লেখক: মাদ্রাসা শিক্ষক
What's Your Reaction?