মাহসীনা মমতাজ মারিয়া
বাংলাদেশের শিক্ষা অঙ্গনে গত দুই দশকে ইসলামিক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের বিস্তার শিক্ষার এক নতুন দ্বার উন্মোচন করে দিয়েছে এবং একই সাথে বেশ কিছু নতুন আলোচনারও জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশের ইসলামপ্রিয় পরিবারগুলোকে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা ও ইসলামী শিক্ষার সংমিশ্রনে এক নতুন শিক্ষা পদ্ধতির প্রতি আস্থা জোগাতে এ প্রতিষ্ঠানগুলো ভূমিকা রাখলেও নতুন করে কিছু প্রশ্নও উঠে আসছে; সচেতন শিক্ষক ও অভিভাবক মহল এসব ব্যাপারে তাঁদের উদ্বেগ জানিয়ে আসছেন অনেকদিন ধরেই। কোন ধরনের প্রতিষ্ঠানকে কী কী বৈশিষ্ট্য থাকলে প্রকৃত অর্থে একটি ইসলামিক প্রতিষ্ঠান বলা যায় তা নিয়ে আসলেও প্রশ্নের অবকাশ আছে। কেবল নামের সঙ্গে ‘ইসলামিক’ শব্দ জুড়ে দিলেই কি একটি স্কুল ইসলামিক হয়ে ওঠে? বাস্তবতা হলো, অনেক ক্ষেত্রে সেইসব স্কুলগুলোর সার্বিক ব্যাবস্থাপনায় ইসলামি জীবনব্যবস্থার সার্বজনীন অনুশীলন অনুপস্থিত থাকায় অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা বরঞ্চ আরও বিভ্রান্তিতে পড়ছেন।
আমার প্রায় দুই দশকের অভিজ্ঞতা থেকে আমি মনে করি, একটি ইসলামিক স্কুলে যদি নিচের বৈশিষ্ট্যগুলো থাকে, তাহলে এই প্রতিষ্ঠানগুলো সত্যিকার অর্থে আদর্শ মুসলিম প্রজন্ম তৈরিতে ভুমিকা রাখতে পারবে ইনশাআল্লাহ।
১. মৌলিক ইসলামিক জীবনব্যবস্থার পাঠ্যসূচী
প্রতিটি ইসলামিক স্কুলের নির্ধারিত পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি নিজস্ব পাঠ-পরিকল্পনা থাকা উচিত যেখানে প্রাথমিক ইসলামি আদব-কায়দা, আখলাক, মাসনুন দোয়া, সুন্নাহভিত্তিক জীবনধারার প্রাথমিক দিক নির্দেশিকা দেয়া থাকবে। এটি শুধু শিক্ষার্থী নয়, শিক্ষক, স্টাফ ও অভিভাবক সবার জন্য গাইডলাইন হিসেবে কাজ করবে। স্কুলে পা দেয়ার সময় থেকে শুরু করে স্কুল থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় পর্যন্ত প্রত্যেকে ন্যায়, ইনসাফ, মানবিকতা এবং আল্লাহভীরুতার সাথে কাজ করবে এবং একে অপরকে সাহায্য করবে।
২. অবকাঠামোগত সুবিধা
ইসলামিক স্কুলের জন্য কিছু বিশেষ অবকাঠামোগত ব্যবস্থা অপরিহার্য। যেমন—নামাজের জন্য আলাদা হলরুম, জায়নামাজ ও সাউন্ড সিস্টেমের ব্যবস্থা, সেন্ট্রাল আজানের প্রচলন, প্রতিটি ফ্লোরে অজুখানা, অফিস এক্সিকিউটিভ ও স্টাফদের জন্য জামাতের আয়োজন ইত্যাদি। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা শুধু নামাজই নয়, বরং শৃঙ্খলা ও সুন্নাহভিত্তিক জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হবে, সবার মধ্যে পারস্পরিক ভাতৃত্বের পরিবেশ তৈরি হবে। এসব সুযোগ-সুবিধার ব্যাবস্থা না করে নামাজের ঘোষণা দেওয়া প্রহসনের নামান্তর।
৩. নামাজ-পরবর্তী তারবিয়্যাহ সেশন
প্রতিদিন অথবা সপ্তাহে অন্তত ১/২ দিন জোহর নামাজের পর ছোট্ট নাসীহাহ বা তারবিয়্যাহ সেশন রাখা যেতে পারে। কখনও শিক্ষক, আবার কখনও শিক্ষার্থীরাই এসব সেশন পরিচালনা করলে তা আরও কার্যকর হবে। এ ক্ষেত্রে আলোচনার বিষয়বস্তু (বাৎসরিক কারিকুলাম) আগে থেকে তৈরি করে রাখা দরকার।
৪. তাহারাত ও পরিচ্ছন্নতার চর্চা
ইসলামিক স্কুলের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো শিক্ষার্থীদের তাহারাত ও পরিচ্ছন্নতায় যত্নবান করা। এ জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষকে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করতে হবে। নোংরা বা দুর্গন্ধযুক্ত বাথরুম ইসলামের শিক্ষা বহির্ভূত এবং শিক্ষার্থীর জন্য ক্ষতিকর। স্কুলের বাথরুম, অজুখানা ও অন্যান্য জায়গা পবিত্র ও পরিস্কার রাখার ক্ষেত্রে সবাইকে অনুপ্রাণিত করা উচিত যেন সবাই নিজের দায়িত্বে এর রক্ষণাবেক্ষণ করে। রাসুলের (সা.) আরেকটি সুন্নত এ ক্ষেত্রে ছাত্র-শিক্ষক সবাইকে সহোযোগিতা করতে পারে, সেটি হলো, যখনই প্রাকৃতিক প্রয়োজনে বাথরুমে যাবে, তখনই অজু করে ফিরে আসবে এবং এভাবে সারাদিন অজুর সঙ্গে থাকার চেষ্টা করবে।
৫. ইসলামিক দিবস উদযাপন
শুধু মার্কেটিংয়ের জন্য নয়, বরং ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক গুরুত্বের সাথে ও জ্ঞানার্জনের স্পৃহা জাগাতে ইসলামিক দিবসগুলো উদযাপন করতে হবে। এগুলোতে শিক্ষার্থীদের সরাসরি অংশগ্রহন তাদের ধর্মীয় চেতনা সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে।
৬. হাতে-কলমে ইসলামিক শিক্ষা
ইসলামিক শিক্ষা শুধু বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ না রেখে প্র্যাকটিক্যাল পদ্ধতিতে শেখাতে হবে। যেমন—অজু, তায়াম্মুম, জানাজার নামাজ, জুমা বা তারাবির নামাজ পরিচালনা ইত্যাদি বিষয়ে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ ও স্কুলে স্কুলে ‘শরিয়া ল্যাব’ বা এ জাতীয় সুযোগ চালু করার মাধ্যমে বাচ্চাদের ইসলামপ্রিয়তা বাড়ানো যেতে পারে। এটা তাদের আত্মবিশ্বাসী মুসলিম হয়ে উঠতে সাহায্য করবে।
৭. সমৃদ্ধ সিলেবাস ও কারিকুলাম
শুধু তাত্ত্বিক আলোচনায় সীমাবদ্ধ না থেকে ইসলামের ইতিহাস, সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি বিষয়কে মূল কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। এতে শিক্ষার্থীরা ইসলামের ঐতিহ্য ও বাস্তব প্রয়োগ সম্পর্কে ধারণা পাবে।
৮. ক্রস-কারিকুলার কার্যক্রম
স্কুলের ক্রস-কারিকুলার কার্যক্রমেও ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হওয়া জরুরি। শিক্ষা সফর, ক্লাব অ্যাক্টিভিটি, প্রতিযোগিতা বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ইসলামি মূল্যবোধকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বিশেষ করে ইসলামি সাহিত্য পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে ‘রিডিং ক্লাব’ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। বর্তমান প্রজন্মের কাছে দ্বীনি জীবনব্যাবস্থাকে অনেক বেশী প্রাসঙ্গিক ও যৌক্তিকভাবে তুলে ধরতে না পারলে জোর করে তাদের দ্বীন শেখানো যাবেনা।
৯. শিক্ষক-অভিভাবক-স্টাফ তারবিয়্যাহ
শিক্ষার্থীদের উন্নতির জন্য অভিভাবক ও শিক্ষকদেরও নিয়মিত তারবিয়্যাহ প্রয়োজন। এ জন্য সাপ্তাহিক বা মাসিক ভিত্তিতে শিক্ষকদের জন্য বিশেষ সেশন আয়োজন করা জরুরি। শিক্ষকরা নিজেদের ছাত্রদের সামনে আদর্শ অনুকরনীয় হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা না করে শুধু মুখে মুখে ইসলামী শিক্ষা পড়ালে আমাদের বাচ্চারাই আমাদের দ্বীচারিতায় বিরক্ত হয়ে যাবে। এ জন্য শিক্ষকদের সবার আগে শক্তিশালী রোল-মডেল হয়ে গড়ে উঠতে হবে।
১০. নতুন পরীক্ষা পদ্ধতি
ইসলামিক স্টাডিজে ওপেন বুক এক্সাম, প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা, প্রেজেন্টেশন বা ভাইভা চালু করলে শিক্ষার্থীদের কাছে ইসলাম একটি ‘সাবজেক্ট’ নয় বরং পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসেবে প্রতিফলিত হবে। তারা গবেষণাধর্মী পড়াশোনায় আরও আগ্রহী হবে।
১১. পরিবেশে আখলাক ও ইহসানের চর্চা
পুরো স্কুল পরিবেশে আখলাক, সবর, শোকর, আদল ও ইহসানের সজীব চর্চা থাকতে হবে। এর মাধ্যমেই প্রকৃত মুসলিম নেতৃত্ব গড়ে উঠতে পারে।
১২. ওয়ান-টু-ওয়ান মেন্টরিং সিস্টেম
ইসলামী সভ্যতার একটি ঐতিহ্য হলো মেন্টরিং। প্রতি ১০ জন (কম বেশী হতে পারে) শিক্ষার্থীর জন্য একজন নির্দিষ্ট শিক্ষক মেন্টর থাকলে তার জ্ঞান, চারিত্রিক গুনাবলী ও অন্যান্য ইবাদত বন্দেগীর দ্বারা তিনি ওই বাচ্চাদের সরাসরি আকৃষ্ট করতে পারবেন। এজন্য মেন্টর শিক্ষকদের বিশেষভাবে উৎসাহিত ও প্রণোদনা দেওয়া জরুরি।
উপসংহার
শুধু নামের সাথে ‘ইসলামিক’ শব্দ যুক্ত করলেই কোনো প্রতিষ্ঠান ইসলামিক হয়ে ওঠে না। একটি ইসলামিক স্কুলকে সত্যিকার অর্থে ইসলামিক করতে হলে প্রয়োজন বহুমাত্রিক প্রস্তুতি—কারিকুলাম, অবকাঠামো, শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক সবার অংশগ্রহণ, এবং সর্বোপরি আখলাক ও তাকওয়াভিত্তিক পরিবেশ। তাহলে এই স্কুলগুলো ইসলামি মূল্যবোধসম্পন্ন যোগ্য, আত্মবিশ্বাসী ও নৈতিকতায় দৃঢ় মানুষ উপহার দিতে সক্ষম হবে ইনশাআল্লাহ।
লেখক: ভাইস প্রিন্সিপাল, এভারোজ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা
ওএফএফ