ইসলামে আলোকিত মানুষের পরিচয়

8 hours ago 8
আলোকিত মানুষকে সবাই ভালোবাসে। আল্লাহর কাছেও আলোকিত মানুষরা সম্মানিত। মানুষও চায় নিজেকে আলোকিত মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে। কিন্তু আলোকিত মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখলেই আলোকিত মানুষ হওয়া সম্ভব হয় না; বরং এর জন্য সৎ, কর্মঠ, পরিশ্রমী, জ্ঞানী, সফল, নিষ্ঠাবান, প্রজ্ঞাবান, বিচক্ষণ, নিঃস্বার্থ, পরোপকারী ও সমাজসেবক হওয়ার মতো আদর্শিক বৈশিষ্ট্যাবলি অর্জন করতে হয়। সঙ্গে সঙ্গে কোরআন-হাদিসের নির্দেশিত পথ ও পন্থা অনুযায়ী জীবনযাপন করলেই শুধু প্রকৃত অর্থে আলোকিত মানুষ হওয়া যায়। এখানে কোরআন-হাদিসের দৃষ্টিকোণে আলোকিত মানুষের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হচ্ছে— বিশ্বাসীরা আলোর পথিক মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ নিখিল বিশ্বের স্রষ্টা ও প্রতিপালক। তিনি নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, সাগর, মহাসাগর, গাছপালা, তরুলতা, খাল-বিল ও ঝরনাধারাসহ সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। তিনি এক ও অদ্বিতীয়। তার কোনো শরিক নেই। তিনি একাই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। অতএব, যারা পরাক্রমশালী ও রাজাধিরাজ আল্লাহর একত্ববাদকে স্বীকার করে না, তারা নিজেদের প্রকৃত মালিক ও স্রষ্টার ব্যাপারে নিতান্ত অন্ধকারে রয়েছে। এমন লোকদের আলোকিত মানুষ বলা যায় না। মহান আল্লাহ শুধু এমন লোকদেরই আলোর পথপ্রদর্শন করেন, যারা তার প্রতি ইমান আনয়ন করে। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা ইমান এনেছে, আল্লাহ তাদের অভিভাবক। তাদের তিনি বের করে আনেন অন্ধকার থেকে আলোর দিকে। আর যারা কুফরি করে তাদের অভিভাবক হচ্ছে তাগুত। তারা তাদের আলো থেকে বের করে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়। এরাই হলো দোজখের অধিবাসী, চিরকাল তারা সেখানেই থাকবে।’ (সুরা বাকারা: আয়াত ২৫৭) তওবাকারীদের সুসংবাদ অন্যায়, অবিচার, পাপাচার, ব্যভিচার, খুন, ধর্ষণ, লুটতরাজ, ছিনতাই, রাহাজানি, মাদক, চোরাচালান, জুলুম-নির্যাতন, উৎপীড়ন ও নিপীড়নসহ যত অপরাধ রয়েছে, সব নিকষ কালো অন্ধকারে আচ্ছন্ন। এ কথা সত্য যে, প্রতিটি মানুষই কোনো না কোনো পাপকর্মে জড়িত। তবে যেসব লোক তওবা করে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড হতে ফিরে আসে, তারা আলোকিত মানুষ। পরকালে তওবাকারী লোকদের ডানে, বামে, সামনে ও পেছনে আলো ছোটাছুটি করতে থাকবে। এজন্য কৃত অপরাধ হতে তওবা করে ফিরে এসে আলোকিত মানুষ হওয়া বাঞ্ছনীয়। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা করো, আন্তরিক তওবা। আশা করা যায়, তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের মন্দ কর্মগুলো মোচন করে দেবেন। তোমাদের দাখিল করবেন জান্নাতে, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত। সেদিন আল্লাহ নবী (সা.) এবং তার বিশ্বাসী সহচরদের অপদস্থ করবেন না। তাদের আলো তাদের সামনে ও ডানদিকে ছোটাছুটি করবে। তারা বলবে, হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের আলোকে পূর্ণ করে দিন এবং আমাদের ক্ষমা করুন। নিশ্চয়ই আপনি সবকিছুর ওপর সর্বশক্তিমান।’ (সুরা তাহরিম: আয়াত ০৪) জ্ঞানের আলোয় যারা আলোকিত জ্ঞান হলো আলো আর মূর্খতা হলো অন্ধকার। অবশ্য পৃথিবীতে নানাধর্মী জ্ঞান রয়েছে। কিছু জ্ঞান মানুষকে উপকৃত ও আলোকিত করে। আর কিছু জ্ঞান মানুষকে অন্ধকারের পথে পরিচালিত করে। মহাজ্ঞানী আল্লাহ হতে বিমুখ করে নাস্তিকতা ও ধর্মহীনতার দিকে নিয়ে যায়। তাই আলোকিত মানুষ হতে হলে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। কোরআন-হাদিসের জ্ঞান অর্জন করে সে অনুযায়ী জীবন পরিচালিত করতে হবে। যেসব লোক মহাগ্রন্থ আল-কোরআন ও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহর জ্ঞান অর্জন করে সে অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করে; তারাই প্রকৃত অর্থে আলোকিত মানুষ। অজ্ঞতার অন্ধকার দূরীভূত করে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহতায়ালা সর্বপ্রথম নাজিল করেন—‘পাঠ করুন আপনার পালনকর্তার নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে। পাঠ করুন, আপনার পালনকর্তা মহা দয়ালু, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে, যা সে জানত না।’ (সুরা আলাক: আয়াত ১-৫) সৎ ব্যক্তিদের চেহারা উজ্জ্বল পৃথিবীতে কিছু মানুষ রয়েছে সৎকর্মশীল ও নেক্কার। তারা ইহ ও পরকালে আলোকিত মানুষ। পক্ষান্তরে, কিছু মানুষ রয়েছে অসৎকর্মে সদা নিমজ্জিত। বিভিন্ন অন্যায়, অবিচার ও পাপাচারে লিপ্ত। এমন লোকদের আলোকিত মানুষ বলা যায় না। পরকালে এমন পাপিষ্ঠ লোকদের চেহারা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে সৎলোকদের চেহারা হবে আলোকিত। তারা সহাস্য ও প্রফুল্ল থাকবে। তারা জান্নাতে স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনযাপন করতে থাকবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘অনেক মুখমণ্ডল সেদিন হবে উজ্জ্বল, সহাস্য ও প্রফুল্ল। আর অনেক মুখমণ্ডল সেদিন হবে ধূলি-ধূসরিত। তাদের কালিমা আচ্ছন্ন করে রাখবে। তারাই কাফের পাপিষ্ঠের দল।’ (সুরা আবাসা: আয়াত ৩৮-৪২) পুলসিরাতে যারা আলো পাবে মৃত্যুবরণ করার পর কবর, হাশর, কেয়ামত, পুলসিরাত, জাহান্নামসহ বিভিন্ন ঘাঁটি রয়েছে। প্রতিটি ব্যক্তিকে এসব ঘাঁটি অতিক্রম করে জান্নাতে পৌঁছতে হবে। এসব ঘাঁটি অতিক্রম করার সময় আলোর প্রয়োজন হবে। এসব সময়ে যারা আলো পাবেন, তারাই আলোকিত মানুষ। কপট বা মুনাফিক নয় এমন মুমিন লোকদের মহান আল্লাহ পরকালে আলো দান করবেন। তিনি তাদের আলোকিত করবেন। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘যেদিন কপট বিশ্বাসী পুরুষ ও কপট বিশ্বাসী নারীরা মুমিনদের বলবে, তোমরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করো, আমরাও কিছু আলো নেব তোমাদের আলো থেকে। বলা হবে, তোমরা পেছনে ফিরে যাও ও আলোর খোঁজ করো। অতঃপর উভয় দলের মাঝখানে খাড়া করা হবে একটি প্রাচীর, যার একটি দরজা হবে। তার অভ্যন্তরে থাকবে রহমত এবং বাইরে থাকবে আজাব।’ (সুরা হাদিদ: আয়াত ১৩) ওজু করলে চেহারা উজ্জ্বল হয় আমরা অনেকেই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করি। এসব নামাজ আদায় করতে গিয়ে অধিকাংশ সময় ওজু করতে হয়। ওজু করার রয়েছে অনেক ফজিলত। যেসব লোক ওজু করবে, আল্লাহতায়ালা কেয়ামতের দিন তাদের হাত, পা ও চেহারা আলোকিত করে দেবেন। পক্ষান্তরে যেসব লোক নামাজ পড়ে না এবং ওজু করা হতে বিরত থাকে, তাদের চেহারা কালিমালিপ্ত থাকবে। অতএব, যারা আলোকিত মানুষ হতে চায় তাদের ওজু করার বিকল্প নেই। হজরত নুয়াইম মুজমির (রহ.) বলেন, আমি আবু হুরায়রা (রা.)-এর সঙ্গে মসজিদের ছাদে উঠলাম। অতঃপর তিনি ওজু করে বললেন, আমি আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘কেয়ামতের দিন আমার উম্মতকে এমন অবস্থায় আহ্বান করা হবে যে, ওজুর প্রভাবে তাদের হাত-পা ও মুখমণ্ডল উজ্জ্বল থাকবে। তাই তোমাদের মধ্যে যে এ উজ্জ্বলতা বাড়িয়ে নিতে পারে, সে যেন তা করে।’ (বোখারি: হাদিস ১৩৬) জান্নাতে যারা আল্লাহকে দেখবে সাধারণত সুখী, সম্পদশালী, সফল ও স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনের অধিকারী ব্যক্তিদেরই আলোকিত মানুষ বলা হয়। আর যেসব লোক মহান আল্লাহর রহমতে জান্নাতে প্রবেশ করবে তাদের চেয়ে সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের অধিকারী আর কেউ হতে পারবে না। জান্নাতের অধিবাসী লোকজন হবেন আলোকিত মানুষ। মহান আল্লাহ জান্নাতের অধিবাসী লোকদের চেহারাগুলো আলোকোজ্জ্বল করে দেবেন। এ প্রসঙ্গে হজরত সুহায়ব (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘জান্নাতিরা যখন জান্নাতে প্রবেশ করবে তখন আল্লাহতায়ালা তাদের বলবেন, তোমরা কী চাও, আমি আরও অনুগ্রহ বাড়িয়ে দিই? তারা বলবে, আপনি কি আমাদের চেহারাগুলো আলোকোজ্জ্বল করে দেননি, আমাদের জান্নাতে দাখিল করেননি এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেননি? এরপর আল্লাহতায়ালা আবরণ তুলে নেবেন। আল্লাহর দর্শন লাভের চেয়ে অধিক পছন্দনীয় জিনিস আর কিছুই তাদের দেওয়া হয়নি।’ (মুসলিম: হাদিস ৩৩৮)। মহান আল্লাহ সবার হৃদয়ে ইমানের আলো জ্বালিয়ে দিন এবং আলোকিত মানুষ হওয়ার তওফিক দিন। লেখক: ইমাম ও খতিব
Read Entire Article