ইসলামে দায়িত্বশীল হওয়ার শিক্ষা

মুফতি ইফতেখারুল হক হাসনাইন দায়িত্বশীল মানুষ মানে যে নিজের প্রতি, পরিবারের প্রতি, সমাজের প্রতি এবং রাষ্ট্রের প্রতি সচেতনভাবে দায়িত্ব পালন করে। ইসলাম মানুষকে ধর্মীয় আনুগত্যের শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি একজন সচেতন, নীতিবান ও দায়িত্বশীল মানুষে রূপান্তরিত করে। ইসলামের দৃষ্টিতে দায়িত্বহীনতা অপরাধ, আর দায়িত্ব পালন ইবাদত হিসেবে গণ্য হয়। ইসলাম মানুষকে দায়িত্বশীল করে গড়ে তোলে নিম্নোক্ত উপায়ে— আত্মশুদ্ধি ইসলাম প্রথমে মানুষের অভ্যন্তরীণ জগতকে শুদ্ধ করে। নামাজ, রোজা, জাকাতের মতো ইবাদতগুলো যেমন ধর্মীয় রিচুয়াল, তেমনি আত্মনিয়ন্ত্রণের শিক্ষাও। নামাজ পাঁচবারের স্মরণে মানুষকে সময়ানুবর্তী, সংযমী ও দায়িত্বশীল করে। রাসুল (সা.) বলেছেন, নামাজ হলো দ্বীনের স্তম্ভ। (সুনানে তিরমিজি: ২৬১৬) নামাজের মাধ্যমে মানুষ নিজের কাজের প্রতি সচেতন হয়, অলসতা ত্যাগ করে। রোজা ধৈর্য, সহানুভূতি ও সংযম শেখায়, যা একজন মানুষকে সমাজের দুর্বলদের প্রতি দায়বদ্ধ করে। পরিবারের প্রতি দায়িত্ব ইসলাম বাবা-মা ও স্ত্রী-সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পালন ফরজ করে দিয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, পুরুষরা নারীদের দায়িত্বশীল, যেহেতু আল্লাহ তাদের মধ্যে একের ওপর অপরকে ব

ইসলামে দায়িত্বশীল হওয়ার শিক্ষা

মুফতি ইফতেখারুল হক হাসনাইন

দায়িত্বশীল মানুষ মানে যে নিজের প্রতি, পরিবারের প্রতি, সমাজের প্রতি এবং রাষ্ট্রের প্রতি সচেতনভাবে দায়িত্ব পালন করে। ইসলাম মানুষকে ধর্মীয় আনুগত্যের শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি একজন সচেতন, নীতিবান ও দায়িত্বশীল মানুষে রূপান্তরিত করে। ইসলামের দৃষ্টিতে দায়িত্বহীনতা অপরাধ, আর দায়িত্ব পালন ইবাদত হিসেবে গণ্য হয়।

ইসলাম মানুষকে দায়িত্বশীল করে গড়ে তোলে নিম্নোক্ত উপায়ে—

আত্মশুদ্ধি

ইসলাম প্রথমে মানুষের অভ্যন্তরীণ জগতকে শুদ্ধ করে। নামাজ, রোজা, জাকাতের মতো ইবাদতগুলো যেমন ধর্মীয় রিচুয়াল, তেমনি আত্মনিয়ন্ত্রণের শিক্ষাও। নামাজ পাঁচবারের স্মরণে মানুষকে সময়ানুবর্তী, সংযমী ও দায়িত্বশীল করে। রাসুল (সা.) বলেছেন, নামাজ হলো দ্বীনের স্তম্ভ। (সুনানে তিরমিজি: ২৬১৬) নামাজের মাধ্যমে মানুষ নিজের কাজের প্রতি সচেতন হয়, অলসতা ত্যাগ করে। রোজা ধৈর্য, সহানুভূতি ও সংযম শেখায়, যা একজন মানুষকে সমাজের দুর্বলদের প্রতি দায়বদ্ধ করে।

পরিবারের প্রতি দায়িত্ব

ইসলাম বাবা-মা ও স্ত্রী-সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পালন ফরজ করে দিয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, পুরুষরা নারীদের দায়িত্বশীল, যেহেতু আল্লাহ তাদের মধ্যে একের ওপর অপরকে বৈশিষ্ট্য দান করেছেন এবং যেহেতু তারা নিজের ধন সম্পদ থেকে তাদের জন্য ব্যয় করে থাকে। (সুরা নিসা: ৩৪)

আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, আমরা মানুষকে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে সদয় আচরণের নির্দেশ দিয়েছি। (সুরা লোকমান: ১৪)

সামাজিক দায়িত্ব

ইসলামে সমাজ একটি বৃহত্তর পরিবারের মতোই। প্রতিবেশী, দরিদ্র, এতিমের প্রতি দায়িত্ব পালন মুসলমানদের ওপর আবশ্যক। রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি সকালে উঠে তার প্রতিবেশীকে ক্ষুধার্ত রেখে পেট ভরে খায়, সে মুমিন নয়। (সহিহ মুসলিম: ৪৬) জাকাত ও সদকার মাধ্যমে সম্পদশালী মুসলমানরা দরিদ্রের প্রতি দায়িত্ব পালন করে। তাতে সমাজে অসমতা কমে।

আমানত রক্ষা, সত্যবাদিতা, প্রতিশ্রুতি পালন—এগুলোও সামাজিক দায়িত্বের অংশ। আল্লাহ তাআলা বলেন, হে ইমানদারগণ! তোমরা আমানতসমূহ যথাযথভাবে আদায় করো। (সুরা নিসা: ৫৮)

রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব

ইসলামি রাষ্ট্রের নাগরিকদের দায়িত্ব রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত থাকা, আর রাষ্ট্রের দায়িত্ব নাগরিকদের অধিকার রক্ষা করা। খলিফা ওমর (রা.) বলেছেন, যদি ফোরাত নদীর তীরে একটি কুকুরও ক্ষুধায় মারা যায়, তবে তার দায় ওমরের। (সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা)

নাগরিকের দায়িত্ব ট্যাক্স দেওয়া, আইন মানা, নিজে ভালো কাজ করা, অন্যকেও ভালো কাজ করতে বলা, নিজে খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকা এবং সামর্থ্য অনুযায়ী অন্যকেও বিরত রাখা।

শ্রম, শিক্ষা ও আখলাক

ইসলাম শ্রমকে ইবাদত বলে। হাদিসে এসেছে, কোনো ব্যক্তি তার হাতের উপার্জিত খাদ্যের চেয়ে উত্তম খাদ্য খায়নি। (সহিহ বুখারি: ২০৭২) সাধ্য অনুযায়ী শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জন করাও প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব। রাসুল (সা.) বলেছেন, জ্ঞান অন্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরজ। (ইবনে মাজাহ: ২২৪) শিক্ষা ও শ্রমের মাধ্যমে একজন মানুষ স্বনির্ভর, দক্ষ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ হয়।

আর আখলাক তথা সততা, ন্যায়পরায়ণতা, পরোপকারিতা—এগুলো মানুষকে দায়িত্বশীল হতে সাাহয্য করে।

দায়িত্বশীলতার ঐতিহাসিক উদাহরণ

ইসলামের ইতিহাস দায়িত্বশীল মানুষের উজ্জ্বল দৃষ্টান্তে ভরপুর। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে ছিলেন সর্বোত্তম উদাহরণ। হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় তিনি কাফেরদের সঙ্গে অসম শর্তে সন্ধি করেও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন, যা মুসলমানদের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দায়িত্বশীল হওয়ার শিক্ষা দেয়।

খলিফা আবু বকর (রা.) খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের পর এক ভাষণে বলেছিলেন, আপনাদের দুর্বলরা ততক্ষণ পর্যন্ত সবল যতক্ষণ পযন্ত আমি তাকে তার অধিকার আদায় করে দেই ইনশাআল্লাহ এবং আপনাদের শক্তিশালীরা ততক্ষণ পর্যন্ত দুর্বল যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তাদের কাছে থেকে পাওনা আদায় করে দেই ইনশাআল্লাহ।

খলিফা ওমরের (রা.) শাসনকালে একবার দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে তিনি নিজে কালো কাপড় পরে রাতে শহরে ঘুরে দরিদ্রদের খাদ্য সরবরাহ করতেন এবং বলতেন, আমি যদি আমার প্রজাদের জন্য দায়ী না হই, তবে খলিফা হওয়ার কী অর্থ?

সালাহউদ্দিন আইয়ুবি (রহ.) ক্রুসেড যুদ্ধের সময় শত্রু সৈন্যদের প্রতিও দয়া দেখিয়েছিলেন, তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন ও খাবার দিয়েছিলেন যা মানবিক দায়িত্বশীলতার উদাহরণ।

এসব ঐতিহাসিক উদাহরণ থেকে কিছুটা বোঝা যায় ইসলামের আদর্শ ও শিক্ষা একজন মানুষকে কতটা দায়িত্বশীল করে তুলতে পারে। আমরা যদি আমাদের সমাজে ইসলামের শিক্ষার প্রসার ঘটাই, ইসলামের শাশ্বত আদর্শের আলোয় মানুষকে আলোকিত করতে পারি, তাহলে সমাজে দায়িত্বশীল নাগরিকের সংখ্যা বাড়বে ইনশাআল্লাহ।

লেখক: মুহাদ্দিস, দারুল উলুম মাকবুলিয়া মাদরাসা, দেবিদ্বার, কুমিল্লা

ওএফএফ

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow