উচ্চ মাধ্যমিকে ৩৫ লাখ আসন ফাঁকা থাকার দায় কার?

6 hours ago 4

দীর্ঘদিন ধরেই একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের আগে-পরে একদিকে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকগণ একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির বিষয়ে প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন থাকছে, ছুটাছুটি করছে, খোঁজখবর নিচ্ছে, অনেকগুলো আবেদন করছে, কাঙ্ক্ষিত প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে না পারলে মন খারাপ করছে; অপরদিকে একাদশ শ্রেণিতে অধ্যায়ন করানো হয় এমন অনেক অনেক কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণ ও কর্তাগণ শিক্ষার্থী বাড়ানোর জন্য প্রচার-প্রপাগান্ডা চালাচ্ছে এবং হন্যে হয়ে বিভিন্ন স্কুলে, মাদ্রাসায় ও শিক্ষার্থীদের বাড়িতে ছোটাছুটি করছে! অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা আরো ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চায়, আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আরো বেশি শিক্ষার্থী চায়। কিছু কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরে আরো ভালো ফলাফল দেখানোর জন্য আরো ভালো ভালো শিক্ষার্থী বাছাই করে নিতে চায়, পেয়ে যায়। অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিও কিংবা সচ্ছলতা ধরে রাখার জন্য কাঙ্ক্ষিত শিক্ষার্থী পায় না! বিশেষ বিবেচনায় টিকে থাকে।

শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের চাওয়া ও পাওয়ার মধ্যে ব্যাপক ব্যবধান বিদ্যমান। অত্যন্ত দুঃখজনক হচ্ছে, আমাদের অনিয়ম ও অপরিকল্পিত ক্রিয়া-কলাপের কারণেই ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে এই অশুভ ব্যবধান, বৃদ্ধি পাচ্ছে ব্যাপক অপচয়। প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে দেখা যায় যে, “সারা দেশে বর্তমানে ৯ হাজার ১৮১টি কলেজ ও মাদ্রাসায় একাদশ শ্রেণিতে মোট আসন রয়েছে ২২ লাখ। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এইচএসসি পর্যায়ে রয়েছে প্রায় ৯ লাখ আসন এবং সরকারি-বেসরকারি পলিটেকনিকে রয়েছে আরও ২ লাখ ৪১ হাজার আসন। সামগ্রিকভাবে একাদশে ভর্তিযোগ্য আসন রয়েছে প্রায় ৩৩ লাখ ২৫ হাজার।” [দৈনিক ইত্তেফাক, ১৪ জুলাই ২০২৫] অথচ এবার এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা ২০২৫ এ উত্তীর্ণ হয়েছে ১৩ লাখ ৩ হাজার ৪২৬ জন শিক্ষার্থী। পরে পুনঃনিরীক্ষণে উত্তীর্ণ আরও ৪,৯৮৩ জন অর্থাৎ মোট উত্তীর্ণ ১৩,০৮,৪০৯ জন।

এরমধ্যে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির জন্য প্রথম ধাপে সব মিলিয়ে আবেদন করেছে ১০ লাখ ৭৩ হাজার ৩৩৬ জন শিক্ষার্থী। পূর্বের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, পরবর্তী ধাপগুলোতে নতুন আবেদন তেমন বৃদ্ধি পায় না, প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের আবেদনই বেশি হয়। এতে দেখা যাচ্ছে ও বুঝা যাচ্ছে, প্রায় সাড়ে ২২ লাখ আসন শূন্য থাকছে, যা শিক্ষার্থীর ঘাটতিতে ভুগতে থাকা বেসরকারি কলেজগুলোর জন্য কঠিন বার্তা! অপরদিকে গত ২০২৪ সালে একাদশ শ্রেণিতে ফাঁকা আসনের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৩ লাখ; যা বর্তমানে দ্বাদশ শ্রেণিতে বিদ্যমান। অর্থাৎ একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি মিলে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে বর্তমানে ফাঁকা আসনের সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ৩৫ লক্ষাধিক।

প্রশ্ন হচ্ছে, সারা দেশে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ৩৫ লক্ষাধিক আসন শূন্য থাকার দায় কার? একদিকে বিপুল সংখ্যক আসন শূন্য থাকছে অপরদিকে আরো নতুন নতুন উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপিত হচ্ছে! একটু পিছনে তাকালেই দেখা যায় যে, গত ২০২২ সালে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির পরে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ আসন খালি ছিল। তখন এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাশ করেছিল ১৭ লাখ ৪৩ হাজার ৬১৯ জন শিক্ষার্থী। আর সারাদেশে একাদশ শ্রেণিতে মোট আসন ছিল ২৫ লাখের বেশি।

তখনো আমি এ বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করেছিলাম। আরো একটু পিছনে তাকালে দেখা যায় যে, গত ২০১৬ সালে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির পরে সারাদেশে প্রায় ৭ লাখ আসন ফাঁকা ছিল। তখন এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল ১৪ লাখ ৫৫ হাজার ৩৬৫ জন শিক্ষার্থী। একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির জন্য সরকারি-বেসরকারি কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মোট আসন ছিল ২১ লাখ ১৪ হাজার ২৬৫টি। তখনও আমি এ বিষয় নিয়ে লেখালেখি করেছিলাম। কিন্তু কেউ কর্ণপাত করেননি। অর্থাৎ ক্রমাগত অপরিকল্পিতভাবে কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হচ্ছে এবং ফাঁকা আসন বৃদ্ধি করা হচ্ছে; যা এখন ৩৫ লক্ষাধিক! দীর্ঘদিন ধরেই এমন অপরিকল্পিত কার্যক্রম চলে আসছে। এর পিছনে কোন অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা আবশ্যক।

যে করেই হোক দ্রুত কমিয়ে আনতে হবে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির ফাঁকা/অতিরিক্ত আসন। নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এ খাতের অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়। সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে করতে হবে নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনা। নিরসন করতে হবে সকল বৈষম্য, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি। সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে নিয়োগ করতে হবে অধিক যোগ্য শিক্ষক। দুর্বল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতি দিতে হবে অধিক মনোযোগ। মনে রাখতে হবে, দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে শিক্ষার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে অবশ্যই উন্নত করতে হবে সকল শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মান।-মো. রহমত উল্লাহ্

অনুমোদন, স্বীকৃতি, এমপিও, সচ্ছলতা ধরে রাখার আবশ্যকতায় নিজেদের প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী বৃদ্ধির জন্য শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি ছুটতে গিয়ে মর্যাদা হানি হচ্ছে বিভিন্ন কলেজ পর্যায়ের অনেক শিক্ষকের। অপরদিকে যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা ব্যবসামুখী, মানহীন, অনুমোদনহীন, প্রচারসর্বস্ব অনেক প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে প্রতারিত হচ্ছে অনেক শিক্ষার্থী। হাতেগোনা কিছু প্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী থাকায় ব্যাহত হচ্ছে মানসম্পন্ন পাঠদান, রমরমা হচ্ছে তাদের প্রাইভেট/কোচিং বাণিজ্য। অপরদিকে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই কাঙ্ক্ষিত শিক্ষার্থী না থাকায়, সচ্ছলতা না থাকায় মানসম্পন্ন শিক্ষক না থাকায়, চলছে দায়সারা পাঠদান। সেসব শিক্ষার্থীদেরও পড়তে হচ্ছে প্রাইভেট। এভাবেই গড়ে উঠেছে ব্যাপক শিক্ষা বাণিজ্য। অভিভাবকদের গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। ক্রমাগত আরো দামি পণ্যে পরিণত হচ্ছে শিক্ষা।

এদিকে কলেজ পর্যায়ের এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী থাকুক আর না থাকুক নিয়মিত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন দিতে হচ্ছে সরকারি কোষাগার থেকে। বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনের অতিরিক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন প্রদান শিক্ষকদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির অন্তরায়। শিক্ষকদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা কম থাকায় নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছে না অধিক যোগ্য-দক্ষ মানসম্পন্ন শিক্ষক। কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বৃদ্ধি করা যাচ্ছে না শিক্ষার মান। তৈরি করা যাচ্ছে না অধিক যোগ্য নাগরিক-কর্মী। বিভিন্ন মানদণ্ডে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় ক্রমাগত পিছিয়ে যাচ্ছি আমরা, পিছিয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশ।

দ্রুত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে সুষ্ঠু পরিকল্পনা। বাস্তবতার ভিত্তিতে প্রয়োজনে সংশোধন করতে হবে নতুন কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের, স্বীকৃতি প্রদানের ও নবায়নের বিধি-বিধান। কোনরূপ দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিকে প্রশ্রয় না দিয়ে কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে সকল নিয়ম। অনেক ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় যে, একই এলাকায়/এরিয়ায় উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের একাধিক কলেজ, একাধিক মাদ্রাসা ও একাধিক কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান। পৃথক পৃথক দপ্তর থেকে পৃথক পৃথক কর্তৃপক্ষ এ সকল প্রতিষ্ঠান স্থাপন, স্বীকৃতি প্রদান ও নবায়ন করার কারণে যদি এমনটি হয়ে থাকে তাহলে একই দপ্তর থেকে বা সংশ্লিষ্ট একাধিক দপ্তরের মধ্যে সমন্বয় করে এ সকল কার্যক্রম পরিচালনা করা অধিক যুক্তিযুক্ত হতে পারে। অর্থাৎ কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মিলে একাদশ শ্রেণিতে মোট কতটি আসন আগামী কতদিনে থাকা আবশ্যক তা পরিকল্পনা করে এ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের/পরিচালনার অনুমতি দেওয়া উচিত। বিদ্যমান যে সকল কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত শর্ত পূরণে বারবার ব্যর্থ হয় সেগুলোর অবস্থা ও অবস্থান বুঝে সম্ভব হলে একীভূত করার কথা ভাবতে হবে। যেগুলো একীভূত করা সম্ভব হবে না সেগুলো বন্ধ করে বিদ্যমান শিক্ষক-কর্মচারীদের বয়স শিথিল করে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শূন্য পদের বিপরীতে নিয়োগ/বদলি দেওয়া যেতে পারে।

বর্তমান বাস্তবতা হচ্ছে, যে করেই হোক দ্রুত কমিয়ে আনতে হবে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির ফাঁকা/অতিরিক্ত আসন। নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এ খাতের অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়। সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে করতে হবে নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনা। নিরসন করতে হবে সকল বৈষম্য, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি। সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে নিয়োগ করতে হবে অধিক যোগ্য শিক্ষক। দুর্বল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতি দিতে হবে অধিক মনোযোগ। মনে রাখতে হবে, দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে শিক্ষার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে অবশ্যই উন্নত করতে হবে সকল শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মান।

লেখক: অধ্যক্ষ, শিক্ষা গবেষক ও কলাম লেখক।

এইচআর/এমএস

Read Entire Article